আনিকা মাহজাবিন ও ফাতেমা–তুজ–জিনিয়া
উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ৬ হাজার ৫৬৬টি ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ওপর ভিসা নীতি কার্যকরের ফলে যুক্তরাষ্ট্রগামী শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিধিনিষেধে উল্লেখিত বিষয়গুলোর আওতায় যেসব শিক্ষার্থী পড়বেন, তাদের ওপরও আরোপিত হতে পারে ভিসা নীতি—এমনটাই বলছেন শিক্ষাবিদরা। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দাবি, উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসা নীতির কোনো প্রভাব পড়বে না।
যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যানবিষয়ক ওপেন ডোরস রিপোর্ট-২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিগত ১০ বছরে প্রায় ৭১ হাজার ৫০০ জনের বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেশটিতে পাড়ি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩ হাজার ৮২৮ জন, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ৪ হাজার ৮০২, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ৫ হাজার ৪৫৫, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ৬ হাজার ৫১৩, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ৭ হাজার ১৪৩, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৭ হাজার ৪৯৬, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ২৪৯, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৮৩৮, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৫৯৮ এবং ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ১০ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী শিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।
প্রতিবেদনটিতে আরো দেখা যায়, যেসব শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন তাদের বড় অংশই স্নাতক সম্পন্ন করে গেছেন। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে যেসব শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন তাদের মধ্যে ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট, ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, ১৩ শতাংশ ওপিটি (অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং) এবং ১ শতাংশ নন-ডিগ্রি ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্তকারী যেকোনো বাংলাদেশীর ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হতে পারে। তার এ মন্তব্যের পরই দেশটিতে পড়তে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ওপর ভিসা নীতির প্রভাব পড়বে কিনা তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, ভিসা নীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রগামী শিক্ষার্থীদের ওপর।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভিসা বিধিনিষেধ হলো রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে যেসব শিক্ষার্থী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবে এবং তাদের যদি ভিসা নীতিতে উল্লেখিত বিষয়গুলোয় কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থাকে, তাহলে তারা স্যাংশনের আওতাভুক্ত হবেই। সেটি স্পষ্ট করেই বলা আছে। তবে ভিসা নীতি যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্য এখানে সবার কথাই বলা আছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রগামী কোনো শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের ওপর ভিসা নীতি আরোপিত হলে এর প্রভাবও তাদের ওপর পড়বে, যা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।’
ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিশ্বের ৫৮টি দেশে পড়তে গেছেন। ওপেন ডোরসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একই বছর বাংলাদেশ থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গেছেন ১০ হাজার ৫৯৭ জন শিক্ষার্থী।
যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ভিসা নিষেধাজ্ঞায় কেবল বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠী নয়, এটি যেকোনো ব্যক্তির ওপরই প্রয়োগ হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ নীতিটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত এমন যেকোনো ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। তাৎপর্যপূর্ণ শব্দটি যে কেউ। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অধীনে, ব্যক্তিগত ভিসার রেকর্ডগুলো গোপনীয় এবং কে প্রভাবিত বা কে হবেন—সে সম্পর্কে আমরা বিশদ বিবরণ দিতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যদি কেউ ক্ষুণ্ন করেন, তারা এ নীতির আওতাধীন। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যরাও ভিসা বিধিনিষেধের আওতাধীন হতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কর্মের মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, সহিংসতা ব্যবহার করে জনগণকে তাদের সংগঠনের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখা। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বা মতামত প্রকাশ করা থেকে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা মিডিয়াকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থার ব্যবহার।’
ব্রায়ান শিলার জানান, ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে হবে কিনা তা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্নকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ব্যাপক, ভালো এবং সত্য-পরীক্ষিত কেস বাই কেস পর্যালোচনার ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।