গত শুক্রবারে রাজধানীর বিজয়নগরে গণ অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর বর্বর হামলা চালায় পুলিশ ও সেনাসদস্যরা। এতে দলটির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। এর মধ্যে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের অবস্থা ছিল গুরুতর। তিনি এখন চিকিৎসাধীন। তার মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। নাকের হাড় ভেঙে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার জ্ঞান ফিরেছে। এখন অবস্থা উন্নতির দিকে। তবে আশঙ্কামুক্ত নন। তার চিকিৎসায় উচ্চপর্যায়ের বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
নুরুল হকের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি তার সাথে কথাও বলেছেন। এর আগে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম নুরুল হককে দেখতে যান। সরকারের তরফ থেকে এত বড় বড় লোক এখন বিগলিতপ্রাণ। নুরুল হকের ওপর ওই বেপরোয়া হামলা কিভাবে হলো? কেন হলো? সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। সরকারের লোকরা যদি নুরুল হকের রাজনৈতিক অবস্থান ও তার নেতৃত্বের কুশলতা জানেন এবং প্রকাশ্যে ওই সম্মান ও সমীহ প্রদর্শন করেন, তাহলে পরে হামলাটি করল কে? গত বছর থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যাসওয়েলের ভাষায় প্রশ্ন করছেন নাগরিক সাধারণ এই সরকারে- Who takes decision when & how?
এই সরকারের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে চার ধরনের অংশীজন বেরিয়ে আসে। আর তা হলো উপদেষ্টা পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল বিশেষত বিএনপি এবং সেনাবাহিনী। প্রথম তিনটি স্টেকহোল্ডারের দৃশ্যমান ভূমিকা আছে। সরকারের আদেশ-নিষেধে এদের দেখাশোনা মেলে। কিন্তু ডিপ স্টেট বলে কথিত সেনাবাহিনীর দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা নেই। থাকার কথাও নয়। তবে যেহেতু তারা রাষ্ট্রব্যবস্থায় শক্তি প্রয়োগের বৈধ অধিকারী সত্তা, সেহেতু তাদের অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০২৪ সালের গণবিপ্লবের পর সঙ্গতভাবেই তারা উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একটি অনিবার্য রক্তপাতকে এড়িয়ে বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব সামরিক বাহিনীর। প্রথাগতভাবে সেনাবাহিনী এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে দূরত্ব স্বীকৃত। সে কারণেই সেনাবাহিনী সতত স্বাভাবিক শাসক নয়। আর শাসন অধিকার একমাত্র রাজনীতিবিদদের। সে শাসন সম্মতির, শক্তির নয়। ভিপি নুরের ওপর হামলার প্রধান ব্যক্তি যেহেতু সেনাবাহিনীর এবং হামলাপরবর্তী দৌড়ঝাঁপও তাদের থেকে। সুতরাং সঙ্গতভাবেই প্রশ্নটি উত্থাপন করা যায়।
ভিপি নুরের ওপর জঘন্য হামলার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে অভাবনীয় তোলপাড় পরিলক্ষিত হয়। বেগম খালেদা জিয়া ভিপি নুরের অবস্থার খোঁজখবর নেন। তাকে হাসপাতালে দেখতে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান। হাসপাতালে আরো হাজির জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, হেফাজতে ইসলামসহ অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক উত্তরণের এক নাজুক সময়ের মধ্যে আছি। যার প্রথম পদক্ষেপ জাতীয় নির্বাচন। সম্মিলিতভাবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, আজকের ঘটনার মতো অস্থিতিশীল ঘটনাগুলো যেন আর না ঘটে এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়।’ গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চর্চাকে ব্যাহত করে এমন কোনো কর্মকাণ্ড বিএনপি সমর্থন করে না।’ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, ‘নুরুল হকের ওপর হামলা পরিকল্পিত ঘটনা, যার উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসন করা।’ হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়। বিক্ষোভ করেছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও জুলাই মঞ্চ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। এসব বিবৃতি ও বিক্ষোভ থেকে তীব্র ঘৃণা ও নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। এদের সম্মিলিত আওয়াজ হচ্ছে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং চৌদ্দ দলের দোসররা কোনো রাজনীতি করতে পারবে না। আরো বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের সম্মুখসারির নেতারা ও অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ওপর এ ধরনের নৃশংস হামলা অভাবিত। অনেকে এটিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করেন। আরো বলা হয়, এ হামলা জুলাই শহীদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
নুরুল হকের ওপর এই অমানবিক হামলা মূল রাজনীতিতেও উত্তাপ ছড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক সভায় গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের ওপর হামলায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। এ ঘটনার রেশ ধরে রাজনীতিতে যে উত্তাপ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা প্রশমনের জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলের বৈঠকের আয়োজন করা হয়। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য যে বৈঠক আহূত হয় সে বৈঠকে উত্তেজনা এতটুকু প্রশমিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে। বিএনপি ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে আস্থাবান রয়েছে। তবে তারা আগের মতোই সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো সংসদের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের পক্ষে। তবে দলটি বলেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বৈধ বা সাংবিধানিক কোনো উপায় থাকলে তারা তা মেনে নেবে। অপর দিকে জামায়াতে ইসলামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে একমত হলেও দেশ একটি নীলনকশার নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে। তারা সংসদ নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, সনদ বাস্তবায়নে গণভোট এবং সংসদের উভয়পক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে। এনসিপি বলেছে, তারা চায় আগামী যে নির্বাচন হবে সেটি যেন গণপরিষদ নির্বাচন হয়।
নুরুল হক নুরের ওপর হামলা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এতটাই ঘোলা করেছে যে, প্রধান উপদেষ্টা আবার নিশ্চিত করেছেন যে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বৈঠকে জামায়াত ও এনসিপি আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলেছে। তবে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধকরণের বিপক্ষে কথা বলেছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক শেষে বলেছেন, একটি শক্তি নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। তারা নির্বাচনী পরিবেশ বিঘিœত হতে পারে এমন অযৌক্তিক দাবিদাওয়ার বিষয়ে সজাগ থাকতে বলেছে সরকারকে। বৈঠক-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য করণীয়, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে আলোচন হয়েছে। তারা জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, বিচার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আরো বলেন, জুলাই সনদ অর্জন না করে নির্বাচনের ট্রেন ছেড়ে দেয়াটা একধরনের ভুল সিদ্ধান্ত।
নুরুল হকের ওপর হামলা ও রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক- এসব ঘটনার মাঝে আরেকটি ঘটনা জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আর তা হচ্ছে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের দৌড়ঝাঁপ। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর-আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেনাপ্রধান প্রথমে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন, পরে সেনাপ্রধান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে সেনাপ্রধান তার সাম্প্রতিক চীন সফরের বিষয় সাংবিধানিক কর্তৃত্বের কাছে তুলে ধরেন। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং তা উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত মতবিনিময় করেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলোচনায় সেনাপ্রধান আশ্বস্ত করেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। এ ছাড়া সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ চলমান উন্নয়নমূলক কার্যক্রমসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। একই সাথে তিনি গুজবের প্রতি মনোযোগ না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পুরো সেনাবাহিনী সরকারের সব উদ্যোগ ও কর্মসূচি সফল করতে বদ্ধপরিকর।
নুরুল হক নুরের ওপর এই আকস্মিক, অযাচিত ও বেপরোয়া হামলায় গোটা জাতি উৎকণ্ঠিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। আমাদের প্রত্যাশা আমরা আর কোনো বিপর্যয় দেখতে চাই না। এটিই যেন শেষ ঘটনা হয়, নাগরিকসাধারণ তা আশ্বস্ত হতে চায়। নুরের জন্য হাজারো মানুষের দোয়া আছে। নুরুল হকের প্রতি হামলার পর যে রাজনৈতিক ঐক্য ও সহানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে, বঙ্গভবন থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তা তার আগামী দিনের চলার পথের পাথেয় হোক এই আশা-আশীর্বাদ আমাদের সবার।
বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকা গৌরবের এবং অগৌরবের। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বিজয় সহজ করে। বিগত ৫০ বছরে সেনাবাহিনী দুর্যোগে ও দুর্ভোগে জনগণের প্রতি অবারিত হাত সম্প্রসারিত করেছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তির অভিলাষ পূরণে সেনাশাসন জারি হয়েছে, সেটি গৌরবের নয়। সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস ও ভালোবাসাকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সেনাপ্রধানের আহ্বান গুজবে কান না দেয়া। অপ্রিয় হলেও সত্যি, যেকোনো সঙ্কট ও শঙ্কায় মানুষ সেনাবাহিনীর দিকে তাকায়। বিগত ১৭ বছর সময়ে ও অসময়ে মানুষ চাতক পাখির মতো উত্তর বাড়ির দিকে তাকিয়েছে। তবে সে সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। আজকে দেশে বেসামরিক কর্তৃত্ব (Civilian Supremacy) এবং সেনাবাহিনীর পেশাদারত্ব (Professionalism) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং গুজব কখনোই সত্যি হবে না। নাগরিকসাধারণ দৃঢ়ভাবেই তা বিশ্বাস করে।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়