বাংলাদেশের দক্ষিণে সাগরের মধ্যে একটি পানি ছুঁই ছুঁই দ্বীপে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অনেককে আশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার বড় ধরণের যে অবকাঠামো গড়ে তুলেছে, তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে দেশে-বিদেশে।
বঙ্গোপসাগরের বুকে গজিয়ে ওঠা এই দ্বীপ, যার নাম ভাসানচর, তা ওই অঞ্চলে নবগঠিত যেসব চর রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে এই চরের বয়স মাত্র ২০ বছর।
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর কয়েক মাস পর থেকেই ভাসানচর জায়গাটি আলোচনায় চলে আসে।
ভাসানচর জায়গাটি কেমন? – গত দুই বছর যাবত এসব প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কারণ এই দ্বীপ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ধারণা খুবই কম।
নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া এক লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীকে ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য এরই মধ্যে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেখানে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য ভাসানচরে যেসব সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো দেখানোর জন্য সরকারী একটি সংস্থা কয়েকদিন আগে ঢাকার বেশ কিছু সাংবাদিকের জন্য ভাসানচর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে।
ভাসানচরে যাত্রা সহজ নয়
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত নৌবাহিনীর বোট ক্লাব থেকে সকাল ১০টায় ভাসানচরের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।
নৌবাহিনীর একটি বড় জাহাজে করে এই যাত্রা শুরু হয়।
কর্ণফুলী নদীর মোহনা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে দিকে জাহাজ যতই এগুতে থাকে, ততই দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যায় লোকালয়। বঙ্গোপসাগরে ঢুকে মাঝে মধ্যে একটি দুটি মালবাহী বড় জাহাজ চোখে পড়ে।
নৌবাহিনীর বড় জাহাজে করে যাত্রা করলেও সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল।
দীর্ঘ তিন ঘণ্টা চলার পর আমাদের জাহাজটি ভাসানচরে এসে পৌঁছায়।
এই যাত্রার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, বড় নৌযান ছাড়া ভাসানচরে যাত্রা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারতো।
এবং আরও মনে হয়েছে যে এই পথে নিয়মিত যাতায়াত বেশ কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
ভাসানচর দেখতে কেমন?
গত প্রায় তিন বছরে ভাসানচরের চেহারা আমূল বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
চরে পৌঁছে দেখা গেল গেল, নৌবাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও সেখানে কিছু নির্মাণ শ্রমিক ও মহিষ চড়ানো রাখালও রয়েছেন।
গত পাঁচ বছর যাবত এই চরে মহিষের রাখাল হিসেবে কাজ করছেন তাজুল হক।
তিনি বলেন, “বিস্তর জায়গা এই খানে। আমরা আগে ছিলাম স্বর্ণদ্বীপ। সেখানে সেনাবাহিনী আসার পরে আমাদের বললো, আপনারা অন্য চরে চলে যান। তখন আমরা এখানে আসলাম।”
কক্সবাজার থেকে এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে এই প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার।
এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প, আর এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে।
এই প্রকল্পের পরিচালক কমোডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান যে ভাসানচরে সব ধরনের স্থাপনার নির্মাণ কাজ হয়েছে।
“এখানে যে কোন সময় রোহিঙ্গাদের আনা যাবে। আমাদের তরফ থেকে সব কাজ শেষ হয়ে গেছে,” বলেন কমোডোর চৌধুরী।
এই চরে এক লক্ষ রোহিঙ্গার জন্য ১২০টি ক্লাস্টার বা গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১,৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়ে। প্রতিটি ঘরে রয়েছে ১৬টি কক্ষ – সামনে ৮টি এবং পেছনের দিকে আরও ৮টি।
রান্নার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে চুলার জায়গা বরাদ্দ করা আছে। আর প্রতি ৮টি কক্ষের জন্য তিনটি টয়লেট এবং দু’টি গোসলখানা রয়েছে।
প্রতিটি কক্ষে দুটো ডাবল বাঙ্কার বা দোতলা খাট রয়েছে। অর্থাৎ একটি কক্ষে চারজন থাকতে পারবেন। যদি একটি পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজনের বেশি হয়, তাহলে তাদের জন্য দুটো কক্ষ বরাদ্দ করা হবে।
রান্নাঘর, গোসলখানা এবং টয়লেটে পানির সরবরাহ রয়েছে।
এর পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাস্টারে একটি করে পুকুর রয়েছে। এসব পুকুরের গভীরতা ১০ ফুট। এসব পুকুরে পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা যাবে।
প্রতিটি ক্লাস্টার একই আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। সব ঘর দেখতে একই রকম। প্রতিটি ঘরের সামনে বেশ চওড়া রাস্তা রয়েছে। এসব রাস্তার প্রশস্ততা ২০ থেকে ২৫ ফুট।
বাংলাদেশের কোন গ্রামে সাধারণত এই ধরণের রাস্তা দেখা যায় না।
ঝড় – জলোচ্ছ্বাসে কী হবে?
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারে অবস্থিত শরনার্থী ক্যাম্পগুলোর তুলনায় যে অনেক ভালো, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের খুপড়ি ঘরগুলোতে বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও ভাসানচরে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু ভাসানচরে নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে, বড় ধরণের ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় এই চরের কী অবস্থা হবে?
প্রকল্প পরিচালক কমোডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, গত ১৭১ বছরের ঘূর্ণিঝড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। “এখনও পর্যন্ত কোন ঘূর্ণিঝড়ের আই (কেন্দ্র) এই এলাকার উপর দিয়ে যায়নি।”
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যাতে ব্যবহার করা যায়, সেই লক্ষ্য নিয়ে ভাসানচরে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ১২০টি শেল্টার হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে।
কমোডোর চৌধুরী জানান, এসব শেল্টারহোম ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের মধ্যেও টিকে থাকবে।
জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে ভাসানচরকে রক্ষার জন্য চারপাশে নয় ফুট উচ্চতার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বাঁধ ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হবে বলে জানালেন কর্মকর্তারা।
প্রকল্প পরিচালক কমোডোর চৌধুরী বলেন, অনেক শক্তিশালী ঝড় এই চরের উপর দিয়ে গেলে অবকাঠামোর ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না।
এই চর যাতে ভাঙনের কবলে না পড়ে, সেজন্য প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে শোর প্রোটেকশন স্থাপন বা তীর রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সমুদ্রের যে পাশ থেকে ঢেউ চরে আঘাত করে, সেই পাশেই শোর প্রোটেকশন দেয়া হয়েছে।
শোর প্রোটেকশন থেকে ৫০০ মিটার ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
ভাসানচরে আলিশান বাড়ি
ভাসানচরে ঢুকে কিছুদূর অগ্রসর হলেই একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি সবার চোখে পড়বে। মনে প্রশ্ন জাগে, যে চরে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বসবাস করবে সেখানে এমন একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা কেন?
নৌবাহিনীর সদস্যরা জানান, এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য। তারা যখন ভাসানচর পরিদর্শনে আসবেন, তখন ওই বাড়িতে বিশ্রাম নিতে পারবেন।
নৌবাহিনীর এক সদস্য জানান, এই বাড়ি নির্মাণ এবং সাজসজ্জা করতে আট কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির জন্য আলাদা কক্ষ রয়েছে বলে তিনি জানান।
নৌবাহিনীর ওই সদস্য জানান, “এখানে নৌবাহিনী প্রধানের নিচে কেউ থাকতে পারবে না।”
রোহিঙ্গাদের দেখা মেলেনি
প্রায় চার মাস আগে সাগরে ভাসমান ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে তারা নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আছেন।
সাংবাদিকদের এই সফরে সেসব রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমনকি চরের কোন স্থাপনায় রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, সেটিও সাংবাদিকদের জানানো হয়নি।
সম্প্রতি এসব রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে কক্সবাজারে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে বিক্ষোভ করেছে।
সম্প্রতি ভাসানচরে বসবাসরত কয়েকজন রোহিঙ্গার বরাত দিয়ে লন্ডন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করে যে সেখানে রোহিঙ্গা নারীদের উপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের তরফ থেকে প্রকল্প পরিচালক কমোডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হয়। কমোডোর চৌধুরী এ ধরণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন যে ভাসানচরে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে, তাদের বেশ যত্নসহকারে রাখা হয়েছে।
তবে মাঝে মধ্যেই রোহিঙ্গারা ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণ’ করে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এনজিও–রা কাজ করতে পারবে?
কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের শিবিরগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সহায়তা করার জন্য বর্তমানে ১০০’র বেশি দেশি-বিদেশী এনজিও কাজ করছে।
এসব এনজিও ভাসানচরে কাজ করতে পারবে কি-না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কারণ এখনো পর্যন্ত ভাসানচরে এনজিওদের জন্য কোন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি।
এনজিওরা যদি সেখানে কাজ করতে চায় তাহলে তাদের জন্য অফিস নির্মাণ কারা করবে, এ বিষয়টি এখনও পুরোপুরি অস্পষ্ট।
সরকারি জমি বরাদ্দ এবং নৌবাহিনীর সহায়তা ছাড়া ভাসানচরে এনজিওদের জন্য স্থাপনা নির্মাণ করা অসম্ভব।
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য বাসস্থান নির্মাণের পাশাপাশি জাতিসংঘ প্রতিনিধি, রেডক্রস এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনারের অফিসের জন্য একটি করে ভবন বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
কক্সবাজারে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাস্তবতা বিবেচনা করলে ভাসানচরে গিয়ে কাজ করা অসম্ভব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, “সমুদ্রপথে ভাসানচরে যেতে সময় লাগে অন্তত তিন ঘণ্টা। বড় জাহাজ ছাড়া এই পথে যাতায়াত করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া এখানে নিয়মিত যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। তাহলে আমাদের কর্মীরা কীভাবে যাতায়াত করবে?”
শুধু এনজিও কর্মীদের জন্যই নয়, সরকারী কর্মকর্তাদের জন্যও ভাসানচরে যাতায়াত বেশ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভাসানচরে পুলিশের একটি থানা স্থাপন করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার এক পুলিশ সদস্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, বছরের মধ্যে নয় মাস এই চরে যাতায়াত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ প্রায়শই সমুদ্র উত্তাল থাকে।
রোহিঙ্গারা না গেলে কী হবে?
ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে এবং এক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হলো যে কোন ধরণের জোর-জবরদস্তি করা হবে না। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেখানে রোহিঙ্গাদের যাওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গাদের দৃষ্টিতে ভাসানচর একটি ‘কারাগার’। চারপাশে সমুদ্র বেষ্টিত এই দ্বীপে থাকতে চায় না রোহিঙ্গারা।
তাই এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে যে যদি রোহিঙ্গাদের সেখানে শেষ পর্যন্ত নেয়া সম্ভব না হয়, তাহলে ভাসানচরে হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচ করার অর্থ কী দাঁড়াবে।
এর পরিস্কার কোন উত্তর নেই।
তবে কমোডোর চৌধুরী জানালেন যে রোহিঙ্গারা যখন নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবেন, তখন বাংলাদেশের অন্যান্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতোই এটি ব্যবহার করা হবে।