Site icon The Bangladesh Chronicle

ভারত মহাসাগর অঞ্চল : কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতা ও বাংলাদেশ


ইতিহাস সাক্ষী, যেসব দেশ নৌ-শক্তিতে শক্তিমত্তা অর্জন করেছে, পরাশক্তি হবার দৌড়ে তারাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থেকেছে। তাই, আকাশ ও স্থলপথে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়নের পরও নৌপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখন স্থলভাগের চেয়ে সমুদ্র অর্থনীতির দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। আমেরিকান ভূ-কৌশলবিদ আলফ্রেড মাহান ও রবার্ট কাপলানসহ ১৯ ও ২০ শতকের অনেক বিশ্লেষক জোর দিয়ে বলেছিলেন, ২১ শতকে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের ক্ষেত্র হবে ভারত মহাসাগর।

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের দেশগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। কিন্তু ভূরাজনীতির চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে কার্যকর আঞ্চলিক সহযোগিতার যে কাঠামো দরকার, তা অনুপস্থিত। সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ভারত মহাসাগরের উপক‚লীয় দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থা ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) ষষ্ঠ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের জ্যেষ্ঠ ফেলো ডেভিডব্রু স্টার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আঞ্চলিক কাঠামো দরকার বলে উল্লেখ করেন।

আইওআরএ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাগুলো একে অপরের পরিপূরক। কারণ আইওআরএ-এর কভারেজ এলাকা ইন্দো-প্যাসিফিকের জন্য পিভট হিসাবে কাজ করে। ভারত মহাসাগরের অস্রেলিয়া থেকে পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকার উপক‚ল পর্যন্ত ওআরএর পরিধি বিস্তৃত। ভৌগোলিকভাবে ভারত এর কেন্দ্রে অবস্থিত। বঙ্গোপসাগরের কেন্দ্রে কৌশলগত অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলের প্রতিযোগী শক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। রাশিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটির সদস্য নয়, কিন্তু ডায়লগ পার্টনার।

ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। পারস্য উপসাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী পর্যন্ত এই তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগরটি ৩৮টি দেশের আবাসস্থল, বিশ্বের পাঁচটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে তিনটির অবস্থান এখানে। এ অঞ্চলে বিশ্ব জনসংখ্যার ৬৪% এবং বৈশ্বিক জিডিপির ৬০% রয়েছে। বৈশ্বিক সমুদ্র বাণিজ্যের ৮০% এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হয়, বিশ্বের তেল বাণিজ্যের ৮০% এবং এক লাখ বাণিজ্যিক জাহাজ প্রতি বছর এই পথের ওপরই নির্ভর করে।

গত কয়েক বছরে বিশ্ব নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ব ধীরে ধীরে মেরুকরণ, ক্ষমতা, সম্পদ ও আধিপত্যের ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর তাই সমুদ্রপথ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় ভারত মহাসাগরের কৌশলগত তাৎপর্যও বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রথমত, এই অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চেকপয়েন্ট যেমন হরমুজ প্রণালী, মালাক্কা প্রণালী, লোম্বক এবং সুন্দা প্রণালী। এগুলোতে যেকোনো ধরনের ব্যাঘাতের প্রভাব অকল্পনীয়। দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্যপ্রবাহ সুরক্ষিত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো ভারত মহাসাগর অঞ্চল। তাই সামুদ্রিক নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

ব্যবসা-বাণিজ্য, সমুদ্রসম্পদ আহরণ, প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে নিজেদের আধিপত্য জোরদার করার জন্য ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের পরাশক্তি ও প্রভাবশালী দেশগুলোর পুরো মনোযোগ এখন ভারত মহাসাগর ও এতদঞ্চলের দেশগুলোর দিকে। তাদের আধিপত্য বিস্তার করা নিয়ে নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভারত মহাসাগর ও চীন সাগরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

উদীয়মান শক্তি থেকে পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের সাথে সাথে দেশটি তার নতুন নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করছে। দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি দেশটির লক্ষ্য এখন ভারত মহাসাগরেও তার প্রভাব বৃদ্ধি করা কারণ চীনের তেল আমদানির প্রায় ৮০% যেমন এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউরোপের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছে তার রফতানির প্রায় ৯৫% পথও এটি।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) ঘোষণা, অকাস ও কোয়াডের মতো নতুন চীন-বিরোধী সামরিক জোটের উত্থান এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে।

বাংলাদেশ এ অঞ্চলে অত্যর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ফলে পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশকে তাদের পাশে পাওয়ার জন্য অতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেকটা নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। বলা যায়, একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান রক্ষা করে চলেছে। তবে ভবিষ্যতে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের অবস্থান ও অংশীদারত্ব কেমন হবে, সেটাই প্রশ্ন।

আইওআর-এর ছোট বা মধ্যম শক্তির বেশির ভাগ দেশ যারা তাদের বৈদেশিক নীতি হিসাবে বহুপাক্ষিকতাকে সমর্থন করে এবং বড় শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেকে জড়াতে চায় না, আইওআরএ-র মতো একটি বহুপাক্ষিক ফোরাম তাদের স্বার্থ হাসিলে কার্যকরী প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। যেহেতু প্রধান প্রতিযোগী দেশসমূহ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া আইওআরএ-এর সরাসরি সদস্য বা ডায়ালগ পার্টনার তাই সংস্থাটি নিয়মিত সংলাপের ব্যবস্থা ও ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে সংশয় প্রশমনে অবদান রাখতে পারে।

ভারত মহাসাগর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এই অঞ্চলের সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং এলাকার ঘটনাবলি ও শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন-রূপান্তরের দিকে নজর রাখছে। সন্দেহ নেই, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার কেউ চাইবে না, এখানে শক্তির কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হোক। কারণ আমরা জানি, ভারত-চীন ছাড়াও ভারত মহাসাগরের সীমারেখা পারস্য উপসাগরের উপক‚লে অবস্থিত জিসিসিভুক্ত ৬টি দেশও বিশ্বরাজনীতি এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে একদিকে রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা; অন্যদিকে রয়েছে প্রচলিত-অপ্রচলিত নিরাপত্তা ঝুঁকি। এ অঞ্চল বায়োহ্যাজার্ডস, সাইবার ওয়ারফেয়ার, সামুদ্রিক জলদস্যুতা, সন্ত্রাসবাদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কাঁচামাল সংগ্রহে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, খাদ্যচাহিদা, সুপেয় পানির নিরাপত্তা, সমুদ্রকেন্দ্রিক নিরাপত্তার হুমকি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রদূষণের মতো কারণগুলো সমুদ্রের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তাই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

জি-২০এর পাঁচটি সদস্য আইওআর’র সরাসরি সদস্য এবং নয়টি দেশ ডায়ালগ পার্টনার। ফলে সংস্থাটি একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে জি-২০সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং চীনের সফট পাওয়ারসমূহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়নে কাজে লাগানো যাবে।
এ অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অভাবনীয় সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও, আড়াই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই অঞ্চলের বিশাল বাজার তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি। বর্তমানে আন্তঃআইওআরএ বাণিজ্য অনুপাত হলো ৩৫%, যা ইইউ (৬০%) এবং উত্তর আমেরিকার (৪০%) তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। সুতরাং, আন্তঃ-আইওআরএ বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে গতিশীলতা পুনর্বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধা দূর করে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য একটি আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি গড়ে তোলা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী সামুদ্রিক লিগ্যাসি রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে, দেশটি বঙ্গোপসাগরের উপক‚লে তথা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। দায়িত্বশীল অংশীদার হিসেবে ঢাকা সবসময় ভারত মহাসাগরে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা প্রত্যাখ্যান করে এবং এই অঞ্চলে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দেশের এক তরফা আধিপত্য দেখতে চায় না। ১৯৭৩ সালে কমনওয়েলথ সম্মেলনে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত মহাসাগরকে ‘জোন অব পিস’ বা শান্তির অঞ্চল হিসাবে প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন।

বাংলাদেশ সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিষয়ে তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছে, ঢাকা কোনো বিশেষ দেশ বা ব্লকের আধিপত্যমুক্ত একটি উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারত মহাসাগর দেখতে চায়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সঠিক পথে আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করে। প্রথমত, বাংলাদেশ অবাধ ও নিরাপত্তার বিষয়টি পরিষ্কার করেছে। দ্বিতীয়ত, কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়-এই নীতি বজায় রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে।
এই অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে, একটি প্রতিযোগিতামুক্ত, শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং অন্তর্ভুক্ত ভারত মহাসাগর অঞ্চল শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র অঞ্চলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-চীন-ভারতের নানামুখী দ্ব›েদ্বর কারণে বাংলাদেশের পক্ষে সহজে নিজের স্বার্থ বজায় রাখা ও আদায় করা সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে ক‚টনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

আইওআরএ অঞ্চল সম্পদের উৎপাদন ও ব্যবহার উভয়েরই পাওয়ার হাউজ হিসেবে গড়ে উঠছে। তাই, সদস্যদের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক গড়ে তোলার অনেক সুযোগ রয়েছে। এই ফোরামের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া, আসিয়ান, উপসাগরীয় দেশ, ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশ এবং অন্যান্য আফ্রিকান দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ঢাকা নতুন নতুন মিত্রের সন্ধান পেতে পারে।
আইওআরএ-এর পরিধি বাংলাদেশকে তার চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল করতে সাহায্য করবে। ২০১৮ সালে, বাংলাদেশ তার নদী ও মহাসাগরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই করতে তার দীর্ঘতম নীতি, ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ এখন সুনীল অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে, যা আইওআরএর একটি অগ্রাধিকার ক্ষেত্র। পাশাপাশি, বাংলাদেশ যেহেতু বারবার দুর্যোগ সমস্যার সম্মুখীন হয়, ঢাকা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তার সক্ষমতা তৈরি করতে পারে। অধিকন্তু, নিজ দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহজতর করতে এই ফোরামে বাংলাদেশ নানাবিধ উদ্যোগ নিতে পারে।

সুনীল অর্থনীতিকে খাদ্য নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লেন্সের মাধ্যমে দেখা হয়। সুতরাং, বাংলাদেশকে দুটি শীর্ষ আঞ্চলিক সংস্থা বিমসটেক এবং আইওআরএ-র সাথে আঞ্চলিক সামুদ্রিক সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশগুলো সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে আরো উপকৃত হবে।

বৈশ্বিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সার সঙ্কট সা¤প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বের সব দেশের জন্য অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এসব বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে বর্তমানে আইওআরএ-এর এমন একটি অবস্থা নেয়ার সময় এসেছে যেখানে এটি একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভারত মহাসাগর গড়ে তুলতে জনগণকেন্দ্রিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেবে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষকে নয়।
ঢাকায় ষষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন

ঢাকায় দুই দিনব্যাপী (১২-১৩মে) ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স (আইওসি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, অংশীদারত্ব এবং সমৃদ্ধি’। মরিশাসের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ২৫টি দেশের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি ছাড়াও ডি-৮, সার্ক ও বিমসটেকের প্রতিনিধিসহ প্রায় ১৫০ জন বিদেশি অতিথি এ সম্মেলনে অংশ নেন। পরাশক্তি ও প্রভাবশালী দেশগুলো যখন এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষে নেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় এ কনফারেন্স অনুষ্ঠান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সম্মেলনটি এমন সময় হলো যখন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ ঘোষণা করেছে যেটির লক্ষ্য হলো এ অঞ্চলে সম্পৃক্ততার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব, জাপান ও ভারতের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং অন্যান্য দেশের অভিন্ন সমস্যাগুলোর সমাধান করা।

ঢাকায় সম্মেলেনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধা জোরদার, কার্যকর অংশীদারত্ব গড়ে তোলার পাশাপাশি এ অঞ্চলের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্য সামুদ্রিক ক‚টনীতি জোরদারের আহ্বান জানান। তিনি ভাষণে ছয়টি বিষয়ে জোর দেন। ১. উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য শক্তিশালী সমুদ্র ক‚টনীতি গড়ে তোলা, ২. জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, ৩. টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে শক্তিশালী অংশীদারত্বের ভিত তৈরি, ৪. সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নৌ ও বিমান চলাচলের বিস্তৃতি, ৫. শান্তির সংস্কৃতি চর্চা ও জনবান্ধব উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন এবং ৬. বিশ্বের অর্ধেক নারী সম্প্রদায়কে সব ধরনের কাজে অংশীদারত্বে রাখার নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্বসম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থনও চান। এটিকে বৈশ্বিক সমস্যা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে তাদের বোঝা টানা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই, রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে টেকসই পদ্ধতিতে প্রত্যাবাসনে সক্রিয় বৈশ্বিক সহায়তা প্রয়োজন।

সম্মেলেনে ভারত মহাসাগরকে সামুদ্রিক সংযোগ প্রকল্পের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ যে কোনো বৈরী পরিস্থিতি উত্তরণে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। এটিকে সম্মেলনের প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়নে সমান সুযোগ থাকা অপরিহার্য। বিশেষ করে সামুদ্রিক অর্থনীতি, পারস্পরিক ক‚টনীতি, শারি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমান অংশীদারত্বমূলক অবস্থান নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। সব দেশের অংশীদারত্ব, সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ও সমতা থাকতে হবে।

সন্দেহ নেই, বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের কোনো একক শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা ঠিক হবে না। সবক্ষেত্রে সমতাভিত্তিক অংশীদারত্বে থাকতে হবে। বাংলাদেশকে আইওসি’র সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়া, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত দিকগুলো অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য ত্রিমুখী ভারসাম্য বিবেচনায় চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর ঢাকা সম্মেলন এ অঞ্চলের দেশগুলোর নিরাপত্তা এবং সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের পথ রচনা ও সদস্য দেশগুলোর বন্ধুত্ব জোরদারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলে তা হবে বড় অর্জন।

লেখক : প্রফেসর ইমেরিটাস ও সাবেক ভিসি, আইআইইউসি

Exit mobile version