গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাস যোদ্ধারা হামলা চালানো পর এক্সে যেসব মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে এর বড় একটি অংশই আসছে ভারত থেকে। দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এটা করছেন বলে আল জাজিরার একটি বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। এ ধরনের প্রচারণার জন্য একটি পেশাদার গোষ্ঠী গড়ে তোলা হয়েছে। এই গোষ্ঠীটি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে, হোয়াটসঅ্যাপে বিদ্বেষধর্মী প্রচার চালায়।
এ ধরনের অসংখ্য ভুয়া তথ্যের একটি হচ্ছে এক ইহুদি শিশুকে অপহরণ এবং একটি ট্রাকের পেছনে এক শিশুকে হত্যার কথা প্রচার। যারা এটা করছেন তাদের বড় একটি অংশ ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এক্সে ভেরিফায়েড বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকেও এরকম প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ইসলামবিদ্বেষী অপপ্রচারই বেশি
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারে নেমেছে এমন বেশ কিছু ভেরিফায়েড এক্স অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করছে ভারতের নির্ভরযোগ্য ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান বুম।
তারা বলছে, অনলাইনে নিয়মিত মিথ্যা প্রচার চালায় এমন বহু ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ এখন ফিলিস্তিনবিরোধী প্রচারে নেমেছেন। তারা ইসরায়েলের সমর্থনে প্রচার চালাচ্ছেন। তাদের প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের নিষ্ঠুর হিসেবে দেখানো।
উদাহরণ হিসেবে একটি অ্যাকাউন্টের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে একটি ভিডিও শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা অল্পবয়সী মেয়েদের যৌন দাসী হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রকৃতপক্ষে এটি জেরুসালেমে একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঘুরতে যাওয়ার ভিডিও। অস্পষ্ট ভিডিওটি ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় মেয়েরা একে অন্যের সঙ্গে হাসাহাসি করছে এবং ফোন ব্যবহার করছে।
আপলোড করার পর এই ভিডিওটি কয়েক হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে। এক্সে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কাছে ভিডিওটি পৌঁছেছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে এর বেশিরভাগই ভারত থেকে পরিচালিত।
ভারত থেকে পরিচালিত ‘অ্যাংরি স্যাফরন’ নামের একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল থেকেও ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে। এই চ্যানেলটির পরিচালনাকারীরা নিজেদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে দাবি করে।
এক ইহুদি শিশুকে অপহরণের মিথ্যা দাবি করা হয়েছে এমন একটি ভিডিও শুধুমাত্র একটি অ্যাকাউন্ট থেকেই ১০ লাখ ভিউ পেয়েছে। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এই ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি ভিউ পেয়েছে এর ১০টির মধ্যে সাতটির বায়োগ্রাফিতে ভারতের পতাকার ছবি রয়েছে। অর্থাৎ, খুব সম্ভবত এই অ্যাকাউন্টগুলো ভারত থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ওই সাত অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি ৩০ লাখের বেশি ভিউ পেয়েছে।
যাচাই করে দেখা গেছে, ভিডিওটি গত সেপ্টেম্বর মাসের। এটি যে গাজার কোথাও ধারণ করা হয়নি সেটিও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় বিদ্বেষের উর্বরভূমি ভারত
ভুয়া ভিডিও প্রচারকারী অ্যাকাউন্টগুলোর পুরোনো পোস্ট ঘেঁটে দেখা যায়, এসব অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারীরা ইসলামবিদ্বেষ ছড়াতে প্রচুর সময় ব্যয় করেন।
হামাস যোদ্ধারা এক শিশুকে হত্যা করছে বলে মিথ্যা দাবি করে ‘মিস্টার সিনহা’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। এই পোস্টের হ্যাশট্যাগ হিসেবে লেখা হয়েছে #IslamIsTheProblem।
জেরুসালেমের স্কুলের মেয়েদের ভিডিও আপলোড করা অ্যাকাউন্টের পুরোনো পোস্টেও ইসলামবিদ্বেষ ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। এরকম একটি পোস্টে লেখা হয়েছে: ‘মুসলমান মেয়েরা যখন হিন্দু হিসেবে ধর্মান্তরিত হন তখন তারা সুখের জীবন কাটায়। আর হিন্দু মেয়েরা যখন ধর্মান্তরিত হয় তখন তাদের দেহ পাওয়া যায় স্যুটকেস বা ফ্রিজে।’
কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে আরও ভয়ঙ্করভাবে ফিলিস্তিনবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য হিসেবে পরিচয় দেওয়া একটি অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে হবে ইসরায়েলকে।’
ভারতে ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে ব্যাপকভাবে ইসলামবিদ্বেষ বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সংগঠন ইসলামিক কাউন্সিল অব ভিক্টোরিয়া জানায়, ইসলাম বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত টুইট করা হয় এর বেশিরভাগের সঙ্গেই ভারতের সংযোগ পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনিদের দুর্দশায় দেখে তারা আবার ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একটি তুলনা দিয়ে তারা বলেছে, আলোর দিকে পোকামাকড় যেভাবে আকৃষ্ট হয় ওই গোষ্ঠীটিও সামাজিক মাধ্যমে সেভাবে আচরণ করছে।
এই প্রচারের একটি অংশ আসছে বিজেপির আইটি সেল থেকে যারা বিদ্বেষে উসকানি দিচ্ছে।
এদের ব্যাপারে ভারতের ফ্যাক্ট চেকিং সংবাদপ্রতিষ্ঠান অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা টুইট করে বলেছেন, ‘ভারতে যারা মিথ্যা প্রচার চালায় তারা এখন মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গায় ইসরায়েলের পক্ষে প্রচারে নেমেছে। আশা করা যায় বিশ্ববাসী বুঝতে পারবে, ভারতের ডানপন্থীরা দেশটিকে কীভাবে মিথ্যা তথ্যের বৈশ্বিক রাজধানী বানিয়ে ফেলেছে।’
ডেইলি স্টার