Site icon The Bangladesh Chronicle

ভারতের স্বার্থ যতটা সুরক্ষিত হয়েছে, বাংলাদেশের ততটা হয়নি

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেছেন, রোল মডেল বা আদর্শ বলতে এমন কিছুকে বোঝায়, যা অন্যরা অনুসরণ করতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক সম্পর্ককে প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে রোল মডেল বলা হচ্ছে। গত ১৫ বছরে দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক যে অসাধারণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সম্পর্ক তো শুধু সরকারের মধ্যেই সীমিত নয়, জনগণের সঙ্গেও জড়িত। এই সময়কালে ভারতের স্বার্থ যতটা সুরক্ষিত হয়েছে, বাংলাদেশের বিষয়গুলো ততটা হয়নি। ফলে দুই দেশের সম্পর্ককে রোল মডেল বলা যায় না বলে মনে করেন তিনি।

রোববার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: প্রতিবেশীর জন্য কি রোল মডেল?’ শীর্ষক এক জনবক্তৃতায় এসব কথা বলেন তৌহিদ হোসেন। সাবেক এই কূটনীতিক প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যে বাংলাদেশ ও ভারতের গত পাঁচ দশকের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এরপর বর্তমান সংকটের মূল্যায়ন করেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান, ’৭৫–এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই দেশের সম্পর্কের বাঁক বদল ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু পর্যন্ত সম্পর্কের নিম্নগতির প্রসঙ্গ টানেন সাবেক কূটনীতিক তৌহিদ হোসেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেভাবে অবদান রেখেছিল, তা নিয়ে যতটা কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের জনগণের থাকা উচিত ছিল, তাতে ঘাটতি আছে বলে ভারতের একাংশ অখুশি। এমন বোধ ভারতের একাংশের মধ্যে এখনো বিদ্যমান।

সাবেক এই কূটনীতিক মনে করেন, বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্ক আবার মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের মতো ঘটনা ওই সময়ে ঘটেছিল।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ইতিহাস বলে দেয়, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঢাকায় আওয়ামী লীগ আর দিল্লিতে কংগ্রেস সরকারে থাকাটা সম্পর্কের জন্য সেরা ‘কম্বিনেশন’ (যুক্ততা) । দুই সরকারের ইচ্ছা ছিল সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়া। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

উলফার মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীদের শিবির সরিয়ে দিয়েছে। ১০ ট্রাক মামলার রায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা দিয়েছে। অনেকগুলো সফরের মধ্য দিয়ে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। দেরিতে হলেও সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু তিস্তার মতো অভিন্ন নদীর পানি চুক্তি সই হয়নি। বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পণ্যের জন্য সমান ক্ষেত্র ভারতে নিশ্চিত হয়নি। সামগ্রিকভাবে ভারতের স্বার্থ যেভাবে রক্ষা হয়েছে, সেভাবে সুরক্ষিত হয়নি বাংলাদেশের স্বার্থ। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভারতের জন্য সহায়ক হলে বাংলাদেশের জন্য ততটা নয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর না হওয়ার জন্য এই কূটনীতিক ভারতের মানসিকতাকে দায়ী করেন। তাঁর মতে, একটি বড় রাষ্ট্র বাস্তবে তার পরিসর, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির কারণে বৃহৎ হতে পারে। কিন্তু এ কারণে সবার সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী আচরণ করতে হবে, এর কোনো মানে হয় না।

তৌহিদ হোসেন বলেন, যে দেশ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল, সে দেশের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ–বিক্ষোভের তো যৌক্তিক কারণ থাকতেই পারে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচে ভারত হেরে গেলে বাংলাদেশের লোকজনের তো উল্লাস করার কথা ছিল না! ভারতের প্রতিই তো বেশি সমর্থন থাকা উচিত ছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বয়কট ইন্ডিয়া’ যখন হয়, বুঝতে হবে ভারতকে নিয়ে জনগণের ক্ষোভ আছে। ভারতের পদক্ষেপে বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়া, পানির সমস্যা ঝুলে থাকা এসব বাংলাদেশের জনগণকে নাখোশ করে। নাগরিকত্ব আইন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে। কিন্তু বাংলাভাষী বিদেশি মানে তো বাংলাদেশকে বোঝায়। নাগারিকত্ব আইন নিয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষ আছে।

সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব মনে করেন, ভারত জোরালোভাবে চায়নি তাই ব্রিকসে বাংলাদেশ সদস্য হতে পারেনি বলে বাংলাদেশের জনগণের একটা অংশ মনে করে। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা বা হস্তক্ষেপ তো কারও অজানা নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল। ২০১৮ সালের ‘অভিনব নির্বাচনেও’ ভারতের যুক্ততা আছে বলে লোকজনের একাংশ সন্দেহ করে। আর ২০২৪ সালেও ভারত জোরালোভাবে পাশে থেকেছে বলে সরকার নির্বাচন করতে পেরেছে।

prothom alo

Exit mobile version