Site icon The Bangladesh Chronicle

ভারতের নির্বাচন: মোদি-হাওয়া ওঠেনি, তাই মুসলমান জুজু

To go with 'India-Election-Modi' by Adam PLOWRIGHT (FILES) In this photograph taken on Aporil 5, 2014, Chief Minister of the western Indian state of Gujarat and Bharatiya Janata Party (BJP) Prime Ministerial Candidate Narendra Modi gestures as he attends a BJP workers gathering in Gandhinagar, some 30kms. from Ahmedabad. To admirers he is a Thatcherite reformer set to jolt India from the economic doldrums, while his opponents liken him to Putin or even Hitler. Indian election frontrunner Narendra Modi divides opinion like few other politicians. The rise of one of India's most polarising public figures even split his own party, where worries about his controversial past and abrasive personality meant he had to overcome heavy internal dissent. AFP PHOTO/Sam PANTHAKY/FILES

নরেন্দ্র মোদি

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণ শেষ হতেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক জল্পনা। হতাশাচ্ছন্ন বিরোধীরা আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছেন। বিজেপি কিছুটা চিন্তিত। দুই শিবিরের আশা ও চিন্তার কারণ ভোটের হার কম হওয়া। সকালটা দেখে বাকি দিন কেমন যাবে বলা গেলেও ভারতের লোকসভার ভোটের প্রথম পর্ব দেখে বলা সম্ভব নয়, বাকি পর্বগুলোয় ভোটার চরিত্র কেমন হবে। এবার আবার সাত দফায় ভোট।

প্রথম দফায় যে ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১০২টি কেন্দ্রে ভোট হলো, তার হার আগের তুলনায় যথেষ্ট কম। রাজ্যওয়ারি ভোট যেমন কম, তেমনই কম শতাংশের গড়। ২০১৯ সালের গড় ছিল ৬৬ শতাংশের মতো, এবার ৬৩। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের কেন্দ্রগুলোয় ১০ বছর ধরে বিজেপির দুর্ভেদ্য গড়। অথচ সেখানে কোথাও কোথাও ভোটের হার ৮ শতাংশ কমে গেছে! বিজেপি এতে বেশ চিন্তিত।

বিজেপি বুঝেছে যে আগেরবারের মতো মোদি-হাওয়া এখনো ওঠেনি। তাদের নজরে আরও ধরা পড়েছে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ভোটের লাইনে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের আধিক্য বেশি। ফলে প্রশ্ন জাগছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী না হয়েও যাঁরা মোদিকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা এবার নিরুৎসাহিত বোধ করে ঘরে বসে রইলেন কি না। রাজনীতির পরিভাষায় এসব ‘ফ্লোটিং ভোটার’ই জয়ের মার্জিন বাড়ান। তাঁরা মুখ ফেরালে জয় সহজলভ্য হওয়া কঠিন।

বিরোধীরা কিন্তু উৎফুল্ল। তারা মনে করছে, মোদির ‘জুমলাবাজি’ (ভাঁওতা) মানুষ ধরে ফেলেছে। চাকরিবাকরির হাল শোচনীয়। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে। সাধারণের সুরাহার জন্য যাবতীয় প্রতিশ্রুতি একটাও পূরণ হয়নি। ফলে মোদির গ্যারান্টিতে মানুষ ভুলছে না। তাই ভোটের হার কমেছে। তাই বিলকুল হাওয়া নেই। ‘চারশ পার’ স্লোগানও তাই অলীক কল্পনা। প্রথম দফার ভোটের হার দেখেই উপসংহারে পৌঁছে তারা জানিয়েছে, এটা হতে চলেছে মোদির বিরুদ্ধে অনাস্থাজ্ঞাপনের ভোট।

প্রথম দফার ভোট হয় ১৯ এপ্রিল। সাত দিন পর ২৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার ভোট। এই সাত দিন ধরে ভারতের গণ ও সামাজিক মাধ্যমগুলো গমগম করছে দুটি বিষয় নিয়ে। একটি মোদিকে হঠাতে ‘পশ্চিমা চক্রান্ত’, দ্বিতীয়টি হিন্দুদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের বিলিয়ে দেওয়ার ‘কংগ্রেসি প্রতিশ্রুতি’। লক্ষণীয় যে দুটি প্রসঙ্গেরই উত্থাপক প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই।

তাঁকে হঠাতে ‘পশ্চিমা চক্রান্তের’ তত্ত্বটি মোদি প্রথম শোনালেন প্রথম দফার ভোটের পরদিন কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশের জনসভায়। এর আগে এমন অভিযোগ তিনি কখনো করেননি।

মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ, আইনের শাসন, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি নিয়ে পশ্চিমের গণতন্ত্রী দেশ ও প্রতিষ্ঠান যখনই প্রশ্ন করেছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবাদ করেছে। কূটনীতিকদের ডেকে পাঠিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে সরব হতে দেখা যায়নি।

এই প্রথম তিনি প্রকাশ্যে বললেন, এ দেশের ‘প্রভাবশালী মহলের’ সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিমা শক্তি তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু তারা সফল হচ্ছে না, কারণ দেশের মা-বোনেদের আশীর্বাদ ও ভালোবাসা তাঁর সঙ্গে রয়েছে। তাঁরাই তাঁর রক্ষাকবচ।

ভোটের আবহেও পশ্চিমা গণমাধ্যম সরব। যেমন, দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ‘ক্ষোভ দমিয়ে জয়ী হওয়া গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর’। দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ‘গণতন্ত্রের ধাত্রী মোটেই ভালো নেই’। তাদের প্রশ্ন ‘বিজেপি কি সবচেয়ে নির্মম ও দক্ষ’ রাজনৈতিক দল? রয়টার্স মোদি-মিথ নস্যাৎ করে বলেছে, ‘মোদি থাকুন না থাকুন, ভারতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে’।

ব্লুমবার্গ ব্যাখ্যা করেছে, ক্রোড়পতি মিডিয়া ব্যারনরা কীভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গলা টিপে ধরেছে। কীভাবে কর্তৃত্ববাদের দিকে ভারতকে ঠেলে দিয়েছে। ফ্রান্সের লে মঁদ বলেছে, ‘আজকের ভারত নামেই গণতন্ত্রী’।

টাইমস প্রশ্ন রেখেছে, উত্থিত ভারতে মোদির স্বৈরাচার পশ্চিম ঠেকাতে পারবে কি না। লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউস আগেই বলেছে, ‘মোদির ভারত উদারত্ব হারাচ্ছে’। সুইডেনের ‘ভি ডেম ইনস্টিটিউট’ও জানিয়েছে, ভারত এখন ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রী’। মোদির ‘মিথ্যার বেসাতির’ ফিরিস্তি দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস।

এই বিস্তর সমালোচনার মুখে মোদির ‘চক্রান্ততত্ত্ব’ যে আলটপকা মন্তব্য নয়, তা বোঝা গেল এক দিন পর। বিজেপির ‘ইকোসিস্টেম’-এর অংশীদার যাঁরা, সংবাদপত্রে তাঁরা এ নিয়ে নিবন্ধ লিখলেন। সেই লেখার সারার্থ, মোদির নেতৃত্বে ভারতের উদয় পশ্চিমের শক্তিদের শঙ্কিত করে তুলেছে। উত্থিত ভারত বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। মোদি তাই তাদের চক্ষুশূল। তাঁর বৈধতা ঘিরে তাই এত প্রশ্ন। দেশের চক্রান্তকারীদের হাতে হাত মিলিয়ে তাই এত ষড়যন্ত্র। এটাই ‘টুলকিট পলিটিকস’।

১০ বছর রাজত্বের পর হাওয়াহীন ভোট আবহে এ ধরনের বিদেশি চক্রান্ত, দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহের আখ্যান কতটা ফলদায়ী হবে, সে সংশয় বিজেপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে রয়েছে। তাই পরদিন থেকেই মোদি আঁকড়ে ধরলেন অতি পরিচিত ও বহু পরীক্ষিত হিন্দু-মুসলমান ‘ন্যারেটিভ’কে।

কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারে আদৌ যা বলা হয়নি, তা শুনিয়ে ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ভাষণের অপপ্রয়োগ ও অপব্যাখ্যা ঘটিয়ে তিনি বললেন, ওরা ক্ষমতায় এলে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। সেই সম্পদ তাদের দেবে, যারা বেশি বেশি বাচ্চার জন্ম দেয়, যারা ‘ঘুসপেটিয়া’, অর্থাৎ অবৈধভাবে এ দেশে এসেছে, মানে অনুপ্রবেশকারী।

মোদি এখানেই থামেননি। আরও ভয় দেখিয়ে বলেছেন যে কংগ্রেস নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, ক্ষমতায় এলে ঘরে ঘরে গিয়ে জরিপ করে দেখবে, কার কত সোনা-রুপা আছে। সব কেড়ে নেবে। মা-বোনেদের গলার মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত। তারপর তা বিলিয়ে দেবে মুসলমানদের মধ্যে। কারণ, মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের সম্পদের ওপর প্রথম অধিকার মুসলমানদের। মোদির কথায়, এটা ‘শহুরে নকশাল’ মনোবৃত্তি। তারা মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রও কাড়তে ছাড়বে না। এরপরই জনতাকে তাঁর প্রশ্ন, ‘আপনারা এই কাণ্ড হতে দেবেন কি?’

বিপুল জয় সম্পর্কে বিজেপি যে সংশয়ী ও নার্ভাস, সম্ভবত এটা তারই লক্ষণ। ভোটারদের অনাগ্রহ কাটিয়ে পরের পর্বগুলোয় হাওয়া তুলতে তাই ‘চক্রান্ততত্ত্ব’ ও ‘মুসলমান জুজু’ হাতিয়ার। এসব কথা মোদি স্বাচ্ছন্দ্যে বলতে পারছেন নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন করে দিতে পেরেছেন বলে।

সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটির (সিএসডিএস) সাম্প্রতিক জরিপ দেখাচ্ছে, মুসলমানদের ১০ শতাংশ ভোটও বিজেপি পায় না। যতই তারা পসমন্দাদের(নিম্নবর্গের মুসলমান) মন পাওয়ার চেষ্টা করুক, তা সময়ের বৃথা অপচয়।

ভোটের লাইনে মুসলমানদের প্রবল উপস্থিতি যদি এমনই থাকে এবং হিন্দুদের উৎসাহে জোয়ার না আসে, তা হলে বিপদ অনিবার্য। তাই হিন্দুত্বের জাগরণে তিনি হিন্দুদের মনে ভয় সঞ্চারে সচেষ্ট।

মোদি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, বিরোধী প্রচারে রোটি-কাপড়া-মাকানের সঙ্গে বিজলি-সড়ক-পানি যেমন প্রাধান্য পাচ্ছে, তেমনই উঠে আসছে বেকারত্বের জ্বালা, মূল্যবৃদ্ধির কোপ, দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং এক শতাংশ ধনী মানুষের আরও ধনী হওয়ার কাহিনি। এই বোঝার ওপর শাকের আঁটি নির্বাচনী বন্ড। এগুলোর একটার জবাবও তাঁর কাছে নেই। যা আছে, তা ধর্মীয় মেরুকরণ।

বিরোধীদের শঙ্কা, মেরুকরণের চেষ্টা বেড়ে যাবে। তারপরও মোদির পক্ষে হাওয়া না বইলে কে বলতে পারে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা সংঘর্ষই শেষ পন্থা কি না? ভোট আবহে সেই উদাহরণ তো ভূরি ভূরি। ভোট শেষ হতেও তো এখনো অনেক বাকি।

prothom alo

Exit mobile version