Site icon The Bangladesh Chronicle

ভারতের নির্বাচনে ধ্রুব রাঠির প্রভাব কতটা কাজ করেছে

ধ্রুব রাঠি

গত ১৬ মে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত একটা লেখার শিরোনাম ছিল ‘সোশ্যাল মিডিয়াস ইমপ্যাক্ট অন ইন্ডিয়ান পলিটিকস’। লেখাটি শুরুই হয়েছিল উত্তর প্রদেশের এক তরুণের উদ্ধৃতি দিয়ে। সেই তরুণ বলেন, কংগ্রেস যদি এবার নির্বাচনে জেতে, তা হবে ধ্রুব রাঠির কারণে।

চোখ–কান খোলা রাখা পাঠকেরা এরই মধ্যে ধ্রুব রাঠি সম্পর্কে কমবেশি জেনে গেছেন বলে ধারণা করা যায়। ৪ জুন ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করায় সেটাও সবার জানা।

এনডিএ জোট সরকার গঠন করার মতো প্রয়োজনীয় আসন পেলেও বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। অপর দিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘ইনডিয়া’ জোট দুই শতাধিক আসন পেয়েছে। সরকার টিকিয়ে রাখতে এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হবে।

লক্ষণীয় যে প্রায় ‘অজেয়’ হয়ে ওঠা মোদি ও বিজেপির বিরুদ্ধে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সমানে সমান লড়াইকে কংগ্রেসসহ বিরোধীদের ‘জয়’ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এতে ধ্রুব রাঠির মতো একজন ইউটিউবারের ভূমিকা কতটুকু?

রাজনীতিতে কোনো দল বা ব্যক্তির সফল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি অনুসারে ন্যারেটিভ (বয়ান বা বক্তব্য) তৈরি করা এবং সেটা মানুষের কাছে পৌঁছানো। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের বড় ধরনের ভূমিকা থাকে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভারতে প্রায় এক দশক ধরে মূল ধারার বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম বিজেপির পক্ষে একতরফাভাবে ন্যারেটিভ তৈরি ও তা প্রচার করে গেছে। এসব সংবাদমাধ্যমের ‘মোদি–ভক্তি’ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে দেশে ও দেশের বাইরে তারা ‘গোদি মিডিয়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

এ রকম এক প্রেক্ষাপটে ধ্রুব রাঠির উত্থান। বেশ অনেক বছর ধরে শিক্ষা ও ভ্রমণসংক্রান্ত বিষয়ে ভিডিও বানানো ধ্রুব রাঠি ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ইউটিউবে রাজনীতি নিয়ে তাঁর ভিডিও আপলোড করেছিলেন। তবে তিনি বেশি আলোচনায় বা লাইমলাইটে আসেন এবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে।

দেশটির নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত মার্চে ‘ইজ ইন্ডিয়া বিকামিং আ ডিক্টেটরশিপ? (ভারত কি স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে?)’ নামে একটি ভিডিও আপলোড করেন ধ্রুব রাঠি।

মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কীভাবে বিরোধীদের দমন–পীড়ন করছে এবং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে স্বৈরতন্ত্র কায়েমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ভিডিওটিতে তিনি সেটার ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করেন। এরপর পুরো নির্বাচনের সময়জুড়ে (১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন) ধ্রুব রাঠি একের পর এক বিস্ফোরক ভিডিও নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হয়েছেন।

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, ‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল জেইলড! ডিক্টেটরশিপ কনফার্মড’, ‘হাউ মিলিয়নস অব ইনডিয়ানস ওয়্যার ব্রেনওয়াশড?’, ‘রিয়েলিটি অব ‘‘মেরা আবদুল’’: দ্য হিন্দু–মুসলিম ব্রেনওয়াশ অ্যাজেন্ডা’, ‘রিয়েলিটি অব নরেন্দ্র মোদি: হাউ ইনডিয়ানস ওয়্যার ফুলড!’ এবং ‘দ্য নরেন্দ্র মোদি ফাইলস: আ ডিক্টেটর মেন্টালিটি’।

ইউটিউবে এসব ভিডিও এখন পর্যন্ত ভিউ হয়েছে দেড় কোটি থেকে প্রায় আড়াই কোটি বার।

ভিডিওগুলোর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের নামে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির বিষয়টি কোটি কোটি মানুষের কাছে উন্মোচন করেন ধ্রুব রাঠি।

বিজেপির আইটি সেল ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কীভাবে পরিকল্পিত উপায়ে মোদিকে নিয়ে মিথ তৈরি করেছে, সেটাও তুলে ধরেন তিনি। এর ফলে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে বিজেপি ও মোদিকে নিয়ে যে ধরনের ন্যারেটিভ চালু ছিল, তা দারুণভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

বিজেপি ও মোদির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক বছর ধরে আরও অনেকেই সক্রিয় রয়েছেন। কিন্তু ধ্রুব রাঠি এত দ্রুত কীভাবে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলেন এবং জনপ্রিয় হলেন? এ ক্ষেত্রে তাঁর কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যেতে পারে।

ধ্রুব রাঠি ভিডিওতে খুব সহজ–সরল ভাষায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। আপাতদৃষ্টে কঠিন বিষয়গুলোও তিনি সাধারণের বোধগম্য করে উপস্থাপন করেন। এর ফলে কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক বা প্রবীণ, উচ্চশিক্ষিত থেকে স্বল্পশিক্ষিত, শহর থেকে গ্রামের বাসিন্দা সব শ্রেণির মানুষ যাঁরা ইউটিউব দেখেন, তাঁদের কাছেই ধ্রুব রাঠি তাঁর বার্তা কমবেশি পৌঁছে দিতে পেরেছেন।

ধ্রুব রাঠি তাঁর বক্তব্যে একধরনের বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভিডিওতে যা বলেছেন বা দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসবের রেফারেন্স বা সূত্র উল্লেখ করেছেন। কোনো মনগড়া তথ্য দেওয়া বা ভবিষ্যদ্বাণী করা থেকে তিনি সচেতনভাবেই বিরত ছিলেন। এর ফলে মোদিভক্তরা যুক্তি দিয়ে তাঁর বক্তব্যকে মোকাবিলা করতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন।

মোদির তীব্র সমালোচনা করলেও ধ্রুব রাঠির ভাষা যেমন ছিল সহজ–সরল, তেমনি পরিশীলিত। গালিগালাজ করা বা পাল্টা ঘৃণা–বিদ্বেষ ছড়ানোর কোনো চেষ্টা বা প্রবণতা তাঁর মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। এটা তাঁর একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে।

মোদি ও বিজেপির সমালোচনা করলেও ধ্রুব রাঠির বক্তব্যে অন্য কোনো দলের প্রতি পক্ষপাত দেখা যায়নি। দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা করতে এবং স্বৈরতন্ত্রকে ঠেকাতে চান, বারবার তিনি এ কথাই বলেছেন। এমন অবস্থানের কারণে তাঁকে বিজেপিবিরোধী কোনো দলের সমর্থক বা পক্ষপাতদুষ্ট বলে চিহ্নিত করা যায়নি।

ধ্রুব রাঠি তাঁর ভিডিওগুলোয় স্পষ্টভাবে বলেছেন যে বিজেপির বদলে যদি অন্য কোনো দল ক্ষমতায় আসে এবং সেই দলও যদি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি তাদের বিরুদ্ধেও সমানভাবে সোচ্চার হবেন। এই বক্তব্যে গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার প্রকাশ পেয়েছে এবং দেশে–বিদেশে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।

এত কিছুর পরও ধ্রুব রাঠি একাই ‘মোদি–ম্যাজিক’ ঠেকিয়ে দিয়েছেন, এ কথা বলা বাড়াবাড়ি হবে। তিনি নিজেও সেটা দাবি করেননি।

নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগের দিন ‘মাই ফাইনাল মেসেজ বিফোর ২০২৪ ইলেকশন রেজাল্টস’ ভিডিওতে তিনি ভারতের বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যমের বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে তাঁদের কাজের প্রশংসা করেন। তিনি একা নন, সবাই মিলেই যে গণতন্ত্র রক্ষার চেষ্টা করছেন, স্পষ্টভাবে সেটা বুঝিয়ে দেন ধ্রুব রাঠি।

লক্ষণীয় হলো, কোনো প্রতিষ্ঠিত মিথ ভেঙে ফেললে বা নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করলেই যে রাজনৈতিক লড়াই, বিশেষ করে ভোটের লড়াইয়ে সফল হওয়া যাবে, এমনটা হলফ করে বলা যায় না। পাশাপাশি যেটা প্রয়োজন হয় তা হলো, মাঠে–ময়দানে সক্রিয় উপস্থিতি ও রাজনৈতিক তৎপরতা। এবার কংগ্রেসসহ ভারতের বিভিন্ন বিরোধী দলকে তেমন ভূমিকায় দেখা গেছে।

ভারতে ধ্রুব রাঠির ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশেও অনেকের মধ্যে আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাও করেছেন। সেই তুলনা কতটা প্রাসঙ্গিক বা যৌক্তিক, তা নিয়ে তর্ক–বিতর্ক হতে পারে, ভিন্নমত থাকতে পারে।

কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, ধ্রুব রাঠি সেটার একটি আদর্শ উদাহরণ হয়ে থাকবেন।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
  • prothom alo
Exit mobile version