Site icon The Bangladesh Chronicle

ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে ধীরগতি, অনিশ্চয়তা

ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে  ধীরগতি, অনিশ্চয়তা

ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থছাড় না করা, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের খবরদারি ইত্যাদি কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর। এদিকে কঠিন শর্ত ও সময়মতো অর্থছাড় না হওয়ায় ছয়টি প্রকল্প বাদ দিতে হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ। প্রকল্পগুলোর ভারতীয় ঠিকাদার ও কর্মীরা ওই সময় বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। কয়েকজন ঢাকা এলেও নিরাপত্তার কারণে ভারতীয় হাইকমিশন তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এলওসির আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

যোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতে, কঠিন শর্তের এলওসিতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো এখনই বন্ধ করা উচিত। বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো কতটা মানসম্পন্ন, অর্থনৈতিকভাবে উপযোগী, সে বিষয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মূলত রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। বাস্তবে ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তাদের নেই। এলওসির শর্ত অনুযায়ী, ৭৫ শতাংশ সরঞ্জাম ও সেবা ভারত থেকে আনতে হয়। কিন্তু অনেক সরঞ্জাম ভারতে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও আবার মান ভালো নয়। তাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে চায় বাংলাদেশ। এসব নিয়েই অনেক দিন ধরে প্রকল্পের কাজে অচলাবস্থা চলছে। সরকার পরিবর্তনের সময় চলে যাওয়া ভারতীয় কিছু কর্মী ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা সমস্যার কথা বলে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশন তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। প্রকল্পে ভারতীয় কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ভারতীয় এলওসির প্রথম চুক্তি হয় ২০১০ সালে। ঋণের অর্থমূল্য ধরা হয় ৮৬ কোটি ডলার। দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি হয় ২০১৬ সালে। এতে অর্থমূল্য ধরা হয় ২০০ কোটি ডলার। তৃতীয় এলওসির চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। অর্থমূল্য ধরা হয় ৪৫০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মোট ঋণের পরিমাণ ৭৩৬ কোটি ডলার।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব ঋণ চুক্তির আওতায় অর্থছাড় হয় ১৬৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রথম এলওসির আওতায় অর্থছাড়ের পরিমাণ ৮০ কোটি ডলার। দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ৪০ কোটি ডলার এবং তৃতীয় এলসির আওতায় ৪৫ কোটি ডলার ছাড় করা হয়। মোট ছাড়ের পরিমাণ ১৬৫ কোটি ডলার। এর পর আরও ২০ কোটি ডলার ছাড় হয়। এ নিয়ে তিন এলওসির আওতায় অর্থ ছাড়ের পরিমাণ ১৮৫ কোটি ডলার। এসব ঋণের সুদহার ১ শতাংশ ও প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। খেলাপি হলে ২ শতাংশ হারে সুদ ধার্য রয়েছে। পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

তিন এলওসির আওতায় মোট ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ১৫টির। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাদ দেওয়া হয় চারটি প্রকল্প। প্রথম দুটি এলওসিতে বাস, ট্রাক, ট্রেনের ইঞ্জিন, বগি, ড্রেজারসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্পই বেশি। সরাসরি ভারত থেকে এসব বাস, ট্রাক, ট্রেনের ইঞ্জিন, বগি কেনা হয়। তৃতীয় এলওসিতে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বেশি। এর মধ্যে রেলের পাঁচটি প্রকল্প রয়েছে।

ইতোমধ্যে প্রথম এলওসির অর্থ পরিশোধ শুরু করেছে বাংলাদেশ। শিডিউল অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প ছাড়া বাকি পাঁচটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ কবে টাকা পাওয়া যাবে, কবে ভারতীয় কর্মীরা আসবেন, কবে ঠিকাদারের তালিকা পাওয়া যাবে; সবকিছুই এখন অনিশ্চিত।

যোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মনে করেন, কঠিন শর্তের এলওসি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। এর মাধ্যমে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। এখনও যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়নি, সেগুলো এক্ষুনি বন্ধ করা দরকার।

সমকালকে তিনি আরও বলেন, যেসব প্রকল্প ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে, সেগুলো কতটা মানসম্পন্ন, টেকসই এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উপযোগিতা রয়েছে কিনা, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ দরকার। এলওসির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রযুক্তি, প্রকৌশল– কোনো খাতেই বাংলাদেশের মানুষের লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। ঋণের শর্ত অনুযায়ী প্রায় সব কিছুই ভারতীয়। ফলে এখনই বাস্তবায়ন শেষ না হওয়া প্রকল্প বাদ না দিলে মাথাপিছু ঋণের দায় আরও বাড়বে। জনগণের অর্থেই এ দায় পরিশোধ করতে হবে।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এলওসির ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে প্রকল্পে কেনাকাটার ৭৫ শতাংশই ভারত থেকে আনতে হবে। বিশেষ করে নির্মাণ প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকেই করতে হয়। শুধু ভারতের ঠিকাদাররাই এতে অংশ নিতে পারেন। প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রণয়ন, নকশা তৈরি ও দরপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। লোকবলেরও বড় অংশ ভারতীয় নাগরিক। এসব মেলাতে গিয়েই প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে না। এ নিয়ে দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকেও কোনো সুরাহা হয়নি।

ইআরডির শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এসব প্রকল্পের কাজ পান শুধু ভারতীয় ঠিকাদাররা। তারা ইচ্ছামতো দর বাড়িয়ে ব্যয় প্রস্তাব করেন। এতে প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ‘সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন অবকাঠামো’ এমন একটি প্যাকেজ। এ প্যাকেজের জন্য ভারতীয় ঠিকাদাররা বেশি দর প্রস্তাব করেন। পরে বাধ্য হয়ে এই প্যাকেজটি ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এসব কারণে এটিসহ ছয়টি প্রকল্প এলওসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া অন্যান্য প্রকল্প– জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন; যশোর, কক্সবাজার, পাবনা ও নোয়াখালীতে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট পৃথক হাসাপাতাল নির্মাণ প্রকল্প। আরও কিছু প্রকল্প বাদ দেওয়া হতে পারে। প্রকল্প পর্যালোচনা শেষে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ইআরডির ‘ফ্লো অব এক্সটারনাল রিসোর্সেস ইনটু বাংলাদেশ’ প্রতিবেদন অনুসারে, স্বাধীনতার পর থেকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ভারত সরকার প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ঋণ ছাড় করেছে ২১৪ কোটি ডলার। প্রতিশ্রুত অর্থের প্রায় ৭৩ শতাংশ ছাড় করা হয়নি।

ইআরডি প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য বলছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার মোট ঋণের মধ্যে ভারতীয় ঋণের অংশ ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ভারত প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থ ছাড় করেছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ উন্নয়ন সহযোগীর মধ্যে সবচেয়ে কম। এ সময় নতুন ঋণের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি ভারত। ইআরডি এশিয়া উইংয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আগামী অর্থবছরের এডিপিতেও ভারতীয় কোনো ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না।

samakal

Exit mobile version