Site icon The Bangladesh Chronicle

ভর্তুকির বন্ডে সুদ ব্যয় সমন্বয় হবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে

নগদ অর্থের সংকটে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। বকেয়া হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিপুল অংকের বিল। সম্প্রতি ভর্তুকির অর্থের বিপরীতে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে দায় পরিশোধ কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত করা হয়েছে। এ বন্ডের সুদ ও পুঞ্জীভূত ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। চলতি শীত মৌসুমেই আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি এ বছরের মার্চের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে সরকার। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়েও এ সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত আসবে। খাতটিতে ভর্তুকির অংক দিন দিন বাড়ছে। এ ভর্তুকির চাপে বাড়ছে সরকারের অর্থ সংকটও। একদিকে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিদ্যুৎ খাতে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলো বিপাকে পড়েছে। এ অবস্থায় ভর্তুকির বিপরীতে বন্ড ইস্যু করে আপাতত সরকারের দায়ের বিষয়টি কিছু সময়ের জন্য বিলম্বিত করা সম্ভব হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বন্ডের সুদ বাবদ সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি পুঞ্জীভূত ভর্তুকির অর্থও পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না সরকার। এক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হতে পারে ৩০ শতাংশের মতো। তবে এটি একেবারে না বাড়িয়ে কয়েক ধাপে বাড়ানো হবে, যাতে গ্রাহকের ওপর চাপ কম পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে এর প্রভাব পড়বে সব খাতেই। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ওপর এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এ অবস্থায় নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সেটি মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে। বিষয়টি নিয়েও চিন্তায় আছে সরকার। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। সুবিধাজনক সময়ে যখন মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকবে তখন দাম বাড়ানো হবে। হয়তো এ শীতকালের মধ্যেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে একবারে দাম না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।’

গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। এ সময় বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। আর গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। একই সময় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ওই বছরের মার্চে কার্যকর হয়। এরপর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আরেক দফা বাড়ানো হয় পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম। সর্বশেষ গত বছরের ১২ জানুয়ারি সরকারের এক নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৫ টাকা ৭২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা থেকে ৬ টাকা ৩০ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১১ টাকা ৪৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৩ পয়সা করার ঘোষণা দেয়া হয়।

বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। সেই প্রস্তুতিও আছে মন্ত্রণালয়ের। এক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হবে বলেও জানান তিনি।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের চাপও রয়েছে সরকারের ওপর। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার সংস্থাটির কাছে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় ও ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে আইএমএফের পর্ষদ। সে সময় সংস্থাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়েছে এবং এজন্য একটি ফর্মুলাভিত্তিক দর সমন্বয় পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। এ বছরের মার্চের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। একইভাবে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়েও আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।

৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে সারের ভর্তুকির বিপরীতে ৩ হাজার ১৬ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করেছে সরকার। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা ও আইএফআইসি ব্যাংকের অনুকূলে ৪৫৯ কোটি টাকার বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়। এর মাধ্যমে ভর্তুকির বিপরীতে সরকারের বন্ড ইস্যু কার্যক্রমের সূচনা হয়েছে। সামনে সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বিপরীতে আরো বন্ড ইস্যু করা হবে। এ বন্ডের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ বছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার (পলিসি রেট) অনুসারে এ বন্ডের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। মেয়াদ শেষে ব্যাংকগুলো বন্ডের অর্থ ফেরত পাবে। এ বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাদের নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) বাধ্যবাধকতাও পূরণ করতে পারবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে সারে ১০ হাজার ৫০০ কোটি ও বিদ্যুতে ১৫ হাজার কোটি টাকা মিলিয়ে ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকির বিপরীতে বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করতে চায় সরকার। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সংখ্যা ৪০। এর মধ্যে সারের ভর্তুকি বাবদ ১০টি ব্যাংক ও বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ ৩০টি ব্যাংকের অনুকূলে বন্ড ইস্যু করা হবে। বন্ডের মেয়াদ বি‌ভিন্ন সময়ের জন্য নির্ধারণ করা হবে, যাতে কোনো একক অর্থবছরে সরকারের ওপর একসঙ্গে খুব বেশি পরিমাণে অর্থ প‌রিশোধের চাপ তৈ‌রি না হয়। বন্ড ইস্যুর ফলে সরকারের ঋণ ও দায় আরো বাড়বে। তবে এ মুহূর্তে অর্থ সংকট থাকায় সরকারের কাছে এর বাইরে আর কোনো বিকল্প নেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য সরকারের দিক থেকে কী প্রচেষ্টা আছে সেটা কিন্তু আমরা জানি না। পরিচালন দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। কোথাও লোকসান থাকলে সেটি কমিয়ে আনা সম্ভব। কয়লার তুলনায় অন্যান্য জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে দাম বেশি পড়ে। ফলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমেও ব্যয় কমানো সম্ভব। উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে দাম হয়তো বাড়াতে হবে। কিন্তু এ মূল্যবৃদ্ধিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে উৎপাদন খরচ ও ব্যয় কমাতে হবে। বিদ্যুতের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে মানুষ হয়তো এর ব্যবহার কমিয়ে ব্যয় সাশ্রয় করতে চাইবে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে এবং অব্যবহৃত সক্ষমতার পরিমাণ আরো বাড়বে। অন্যদিকে যারা ব্যবহার কমাবে না, তাদের মধ্যে বিদ্যুৎ চুরির প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে এর সম্ভাব্য কী ধরনের প্রতিঘাত আসতে পারে সেটি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। অতি উচ্চমূল্যের কারণে বাজারে একটি বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের ডলারের সংকট তো আর দূর হচ্ছে না। ডলারের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রয়োজন অনুসারে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছে না। এ সংকট দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।’

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুসারে, সংস্থাটির কাছে বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিল বাবদ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের আইপিপিগুলোর বিল বাবদ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল বকেয়া রয়েছে। এ অবস্থায় বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা, জ্বালানি খাতে ৬ হাজার ২৩২ কোটি টাকা, কৃষি খাতে ২৬ হাজার ৫৫ কোটি টাকা ও সারে ২৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

বনিক বার্তা

Exit mobile version