Site icon The Bangladesh Chronicle

ভরপেট না-ও খাই, রাজকর দেয়া চাই

ভরপেট না-ও খাই, রাজকর দেয়া চাই। – ছবি : সংগৃহীত

বাংলা চলচ্চিত্রের নন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রটির কিছু সংলাপ যুগ-যুগান্তর মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। অত্যাচারী শাসকের চরিত্র এত নির্মোহভাবে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কি না সন্দেহ আছে। আজকের লেখায় চলচ্চিত্রটির আলোচনার অভিপ্রায় থেকে নয়, বরং সিনেমাটির মাধ্যমে সমাজের সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারী শাসকের নির্মমতার সাথে বর্তমান বাংলাদেশের চালচ্চিত্রের যে খুব একটা তফাৎ নেই তার মূল্যায়ন করাই মূল উদ্দেশ্য।

হীরকের রাজা দেশে খরা-অনাবৃষ্টির কারণে ফসল না হওয়া সত্ত্বেও মানুষের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশার কোনো কথা শুনতে ও মানতে নারাজ। প্রজাদের রাজকর দিতে হবে। সত্যজিৎ রায় এই মুভিটির মাধ্যমে স্বৈরাচারী এক ফ্যাসিবাদী শাসনের চিত্র যেন ওই সময় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। চলচ্চিত্রটি মূলত শোষিতের সাথে শাসকের সঙ্ঘাতের এক অনবদ্য চিত্র। আর সেই কারণে ‘ভরপেট না-ও খাই/রাজকর দেয়া চাই’ শাসকের বিরুদ্ধে এ অসহায় উক্তিটি সত্যজিৎ রায় গরিব চাষি ফজল মিয়ার মুখ দিয়ে দর্শকদের শুনিয়েছিলেন।
শাসকের সামনে এমন সত্য শুনানোর জন্য ফজল মিয়ার মগজ ধোলাইয়ের জন্য নেয়া হয়েছিল যন্তর মন্তরে। শাসকের কথা হবে শেষ কথা, সেখানে কারো কথা থাকতে পারবে না। আজকের বাস্তবতাও কিন্তু একই রকম। কোনো ক্ষুধার্তের পক্ষে বলার ক্ষমতা নেই সে ক্ষুধার্ত। কেউ সাহস করে বললেও, তার জন্য অপেক্ষা করবে ভয়ঙ্কর পরিণতি। এ দেশের গরিবের চিত্র মোটেই সুখকর নয়। শাসকরা তাদের হালহকিকত দিয়ে গোটা দেশের চিত্র মেলাতে গিয়ে গরিব-দুঃখীদের জন্য আরো বেশি বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। দেশের খুব কম মানুষ আছেন যাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে। কিছু পণ্যের ক্রেতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এ কারণে অনেকে অফিস কিংবা দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিতে না পারায় ব্যবসায়-বাণিজ্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সরকারের রোষানল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় তাদের নেই। নতুন বাজেট প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয়েছে, রিটার্ন জমা দিলে দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। কারো করযোগ্য আয় না থাকলেও, এ টাকা দিতে হবে। আবার আয়কর অধ্যাদেশে সাড়ে তিন লাখ টাকা করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

মানুষের অসহায়ত্বের কথা শোনার কেউ নেই। আমলা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আওয়ামী বুদ্ধিজীবী নামের কিছু ব্যক্তি যারা সরকারের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত, তারা সরকারের সব কিছুতে মঙ্গল দেখেন। গরিবের কান্না তাদের কাছে হাস্যরসের বিষয়। তাদের ভাষায় সব কিছুতে অভিযোগ করা ‘গরিবের একটা মুদ্রাদোষ’। হীরক রাজার দেশে অভিযোগকারীকে যন্তর-মন্তরে নিয়ে মগজ ধোলাই করা হতো যেন সে শিখানো মন্ত্র আওড়াতে থাকে। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও বিশেষ সুবিধা দিয়ে মগজ এমনভাবে ধোলাই করা হয়েছে, যেন তারা সরকারের সাফাই গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তুলে ফেলতে পারেন। কী! করুণ দশা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের। কিছুদিন আগে নির্বাচন ছাড়া বর্তমান সংসদ ও সরকারের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত জামাল উদ্দীন ‘যুক্তি’ দিয়েছেন, করোনা দুর্যোগের কারণে দুই বছর জাতীয় সংসদ ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি। ওই সময় সরকার, জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কেউ ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি এবং দেশ সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। তাই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো প্রয়োজন। হীরক রাজার দেশে যেমন রাজার প্রশংসা করলে মন্ত্রীরা পুরস্কার পেতেন, আমাদের জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এ চামচামি কোন্ পুরস্কারের আশায় তা কে জানে? এ ধরনের অর্বাচীন জ্ঞানীদের পক্ষে গরিবের দুঃখ-দুর্দশা বুঝবার কথা নয়। তারা বরং গরিব মারার ফন্দিকে বাহবা দিতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করবেন না।

জনগণের ব্যবসায়-বাণিজ্য থাকুক আর না-ই বা থাকুক। তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠুক আর না উঠুক তাতেও সরকারের কিছু আসে যায় না। প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, সরকারের ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে বছরে দুই হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। সিপিডি বলেছে, ‘এটা যৌক্তিক নয়, নৈতিকও নয়’। ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। রাজস্ব হিসাবে ৫ লাখ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন একটি ঘাটতি বাজেট ‘স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য তা পুরোপুরি ‘আনস্মার্ট’। এ ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নও কঠিন। মানুষেকে সবচেয়ে চাপে রেখেছে যে মূল্যস্ফীতি, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো পরিকল্পনা বাজেটে নেই। করের বোঝা চাপানো হয়েছে সাধারণ মানুষের ওপর, যারা ধনী বা উচ্চবিত্ত, তাদের বলতে গেলে রেহাই দেয়া হয়েছে। বিশাল ঘাটতির এ বাজেটের অর্থের জন্য নির্ভর করতে হবে বিদেশী ঋণ ও দেশের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের ওপর, যা নানা নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

সরকারের ভর্তুকি মেটাতে বারবার গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও গরিবের ওপর জুলুম করছে। কিন্তু ধনীদের জন্য সবকিছুতে ছাড় আছে। নিত্যপণ্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে ধনীদের প্রতিযোগিতা হয় ২৪ ক্যারেটের খাওয়ার উপযোগী সোনায় মোড়ানো ২০ হাজার টাকা কেজি দরের জিলাপি, লাখ টাকায় সোনায় মোড়ানো আইসক্রিম কিনতে। ধনীদের এ বিলাসিতা যখন আসমানে তখন ২০২৩ সালের মার্চ মাসে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, ‘মূল্যস্ফীতির চাপে বেশির ভাগ মানুষ খাবার খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছে। ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার ছয় মাস আগের তুলনায় তাদের গোশত খাওয়া কমিয়েছে। মাছ খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার, তেল খাওয়ার পরিমাণ ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ, ডিম খাওয়ার পরিমাণ ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং চাল খাওয়ার পরিমাণ কমিয়েছে ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার’। অর্থনৈতিক সঙ্কটে গরিব ও মধ্যবিত্তের যখন ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে ঠিক তখন দেশে বিলাসবহুল গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে সমান তালে। পথেঘাটে এখন অহরহ চোখে পড়ে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, রেঞ্জরোভার ও অডির মতো ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের দামি বিলাসবহুল গাড়ি।

আজকের এ বাস্তবতায় যখন গরিবের ওপর করের বোঝা চাপানোর পরিকল্পনা করা হয়, উল্টো দিকে সরকার ধনীদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর আহরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর প্রমাণ হলো, সরকারের কর রাজস্ব আয়ের ৬৫-৬৭ শতাংশ পরোক্ষ কর থেকে আসে, বাকি অংশ আসে প্রত্যক্ষ বা আয়কর থেকে। প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ করা হয় ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে, যার মধ্যে রয়েছে মুনাফার ওপর কর, নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত আয়ের ওপর কর, সম্পত্তির ওপর কর ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কর হলো বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট, যা কোনো পণ্য ও সেবা কেনার সময় সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগ পরোক্ষ কর থেকে আসার কারণ হলো সরকার ধনীদের কাছ থেকে তাদের আয় ও মুনাফার ওপর কর আদায়ে জোর না দিয়ে জোর দিচ্ছে দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ কর আদায়ে। বেসরকারি সংস্থা সিপিডির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘কর ফাঁকি ও অস্বচ্ছ ব্যবস্থায় সরকার বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কেটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। টাকার এ অঙ্ক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের ৮ গুণ; আর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের দুই গুণ। এভাবে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর বেশি হওয়ার অর্থ হলো দরিদ্রদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ব্যয় করা হচ্ছে ধনীদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির কাজে, ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে জাতীয় আয়ে জনগণের ভাগ কমছে অর্থাৎ বৈষম্য বাড়ছে।’

সরকারের এ পলিসি ধনীকে আরো ধনী করছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে। ধনীর দুলালেরা বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে লং ড্রাইভে গেলেও গরিবের সন্তানরা টাকার অভাবে ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। ধনীদের নাশতা, লাঞ্চ, ডিনার পাঁচ তারকা হোটেলে হলেও গরিবের সন্তানরা জাতীয় মাছ ইলিশের পরিবর্তে পাঙ্গাশের নাম জানছে। সামাজিক এ বৈষম্যের চিত্র প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে সরকারের ভ্রান্তনীতি, দুর্নীতি আর যেভাবেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনায়। জবাবদিহিহীন সরকারের লালসা থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে জনগণের উচিত যেকোনো স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা। মনে রাখা দরকার, কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে এ সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব নয়, প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব এবং সবার অংশগ্রহণ। সম্মিলিত সংগ্রামের ফলস্বরূপ একটি সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে পারলে হয়তো কাউকে আর ‘ভরপেট না খেয়ে, সরকারকে খাজনা দিতে হবে না’। অবশ্য এ সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করাই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র।

harun_980@yahoo.com

Exit mobile version