Site icon The Bangladesh Chronicle

বড়-ছোট জলাধার নির্মাণই পানি সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায়

সরেজমিন তিস্তা ব্যারেজ

ড. শামসুল আলম

নভেম্বর ০৫, ২০২০

বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পানি ও খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ কৃষি, মত্স্য, শিল্প, বনায়ন, পানি ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন ইত্যাদি সব খাত বিবেচনায় রেখে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ শীর্ষক একটি দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ মহাপরিকল্পনায় বিধৃত ছয়টি হটস্পটের অন্যতম একটি হটস্পট হলো বরেন্দ্র খরাপ্রবণ এলাকা। এ এলাকা খরাপ্রবণ এবং এখানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় কৃষিকাজ, গৃহস্থালি ও শিল্প-কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেশি হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সে কারণে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ভূ-উপরস্থ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় দেশের অভ্যন্তরে নদী-খাল-বিল ড্রেজিং করে জলাধার নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিস্তা নদীর নাব্যতা, পানির প্রাপ্যতা, সেচ ব্যবস্থা, বনায়ন, মত্স্য চাষ ও পানি ব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র অবলোকন করা এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণে অভিজ্ঞতা অর্জনে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের একটি প্রতিনিধি দলের তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শনের উদ্দেশ্য ছিল তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প কার্যক্রম ও পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিদর্শনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাস্তব ধারণা লাভ করা।

তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্পের অবস্থান: তিস্তা ব্যারেজের অবস্থান রংপুর শহর থেকে ৬১ কিলোমিটার দূরে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার ডালিয়া নামক স্থানে। তিস্তা সেচ প্রকল্পটি লালমনিরহাট, রংপুর ও নীলফামারী তিনটি জেলার মোট ১২টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। এগুলোর মধ্যে নীলফামারী জেলার পাঁচটি উপজেলা—সদর, জলঢাকা, সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ ও ডিমলা; রংপুর জেলার চারটি উপজেলা—সদর, গঙাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ এবং দিনাজপুর জেলার তিনটি উপজেলা—চিরির বন্দর, পার্বতীপুর, খানসামা উপজেলা অন্তর্ভুক্ত আছে।

উত্তরাঞ্চল খরাপীড়িত এলাকা হওয়ায় তত্কালীন ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তবে এর মূল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান আমলে। ১৯৫৭ সালে নির্মাণকাজ শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে লালমনিরহাট ও নীলফামারী মহকুমার সীমান্তে দোয়ানিয়ায় (ডালিয়া) তিস্তা নদীর ওপর ব্যারেজটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ব্যারেজটির মোট দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার এবং এতে ৪৪টি গেট রয়েছে। জুন ১৯৯৮-এ প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। ব্যারেজের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ১১০ মিটার দীর্ঘ ক্যানেল হেড রেগুলেটর, যা সেচ খালে পানি উত্তোলন করে। এতে আটটি গেট রয়েছে। সে হিসাবে তিস্তা ব্যারেজে মোট গেটের সংখ্যা ৫২টি। খালের মধ্যে পলি সঞ্চয়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধের মধ্যে পলি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (সিল্ট ট্র্যাপ) সংযুক্ত রয়েছে। বন্যাকালীন বাঁধের পানি অপসারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি মুক্ত করার জন্য ৬১০ মিটার দীর্ঘ বিকল্প পথ এবং বাইপাস বাঁধের মধ্য দিয়ে পানিকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য ২ হাজার ৪৭০ মিটার দীর্ঘ প্রতিবন্ধক বাঁধ নির্মিত হয়েছে। বাঁধ-সংলগ্ন এলাকায় বন্যা প্রতিরোধে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা বেড়িবাঁধও নির্মিত হয়েছে। তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প। বাংলাদেশের অন্যান্য ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহার করে বড় প্রকল্পগুলো হলো, জি. কে প্রজেক্ট, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প ও চাঁদপুর সেচ প্রকল্প। দেশের কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে এসব সেচ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩০৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৩ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। নদীটি দোয়ানিয়া থেকে ১৯ কিলোমিটার উজানে দহগ্রামে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করেছে। দহগ্রাম থেকে দোয়ানিয়া (ডালিয়া) পর্যন্ত তিস্তা নদীর এই ১৯ কিলোমিটার অংশ ভারত থেকে আসা পানির রিজার্ভার বা জলাধার হিসেবে কাজ করে। এই আটকানো পানি ক্যানেল হেড রেগুলেটরের মাধ্যমে সেচের জন্য নেয়া হয়। নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া ও দিনাজপুর—এ চারটি জেলার ১২টি উপজেলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে প্রকল্পের খাল।

তিস্তা প্রকল্পের দৃশ্যমান সুফল

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি: তিস্তা সেচ প্রকল্প গ্রহণের আগে এ এলাকায় বছরে বৃষ্টির পানিনির্ভর এক বা দুই ফসল (যেমন দেশী ধান, কাউন, পাট, সরিষা ইত্যাদি) জন্মাত, যার ফলন ও শস্য নিবিড়তা উভয়ই কম ছিল। প্রকল্প গ্রহণের ফলে প্রকল্প এলাকায় শস্য নিবিড়তা ও ফসল উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২-১৩ সালে ৬৯ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করে বার্ষিক অতিরিক্ত ১৪ লাখ ২০ হাজার ২৪৬ টন (ধান, গম, সবজি) ফসল উৎপাদন হয়। তিস্তা প্রকল্প গ্রহণের পর থেকে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ।

উন্নত প্রাকৃতিক পরিবেশ: তিস্তা সেচ প্রকল্প গ্রহণের আগে পানিস্বল্পতার কারণে প্রকল্প এলাকা মরুপ্রবণ ছিল। প্রকল্প গ্রহণের ফলে একদিকে যেমন পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানির লেভেল উপরে উঠেছে। এছাড়া সেচ ক্যানেল ডাইকের উভয় পাশে এবং তত্সংলগ্ন অবকাঠামোয় প্রায় ছয় লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করে বনায়নের মাধ্যমে উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।

হাঁস ও মত্স্য পালন: তিস্তা প্রকল্প গ্রহণের ফলে এই এলাকায় খালগুলোয় মাছ ও হাঁস পালনের অবাধ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় মত্স্য চাষের এলাকা ও মত্স্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার সেচ খাল ও ৩৮০ কিলোমিটার নিষ্কাশন খালে উন্মুক্ত মাছ হচ্ছে। এছাড়া সারা বছর পুকুরে পানি থাকায় ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৬৯ দশমিক শূন্য ৭ হেক্টর এলাকায় মত্স্য চাষ করা হয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি: তিস্তা প্রকল্প গ্রহণের পর ৬৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেচ খালের উভয় পাড়ের ১ হাজার ২৯৮ কিলোমিটার ক্যানেল ডাইক ও প্রায় ১০০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা প্রত্যন্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে।

তিস্তা প্রকল্পের সমস্যাগুলো

সেচ অবকাঠামোগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও অপর্যাপ্ত বাজেট: পর্যাপ্ত রক্ষণ ও পরিচালন বাজেট না থাকায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেচ খাল, ডাইক, স্লুইস গেট ইত্যাদি অবকাঠামোর প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। পরিদর্শনের সময় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, সেচ খালগুলোর মধ্যে সেকেন্ডারি সেচ খাল ব্যবহারের উপযোগী ১৪৬ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার এবং ব্যবহারের অনুপযোগী ১১৫ কিলোমিটার। অন্যদিকে টারশিয়ারি খালগুলোর মধ্যে ব্যবহারের উপযোগী ১১৮ কিলোমিটার এবং ব্যবহারের অনুপযোগী ২৫৬ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। ফলে বর্তমানে সেচের আওতাভুক্ত এলাকা ৮৪ হাজার ৫৯ হেক্টরের স্থলে কমে ৪৪ দশমিক ৫০০ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর কম দেয়ার কারণে তিস্তা প্রকল্প পূর্ণ ব্যবহূত হতে পারছে না।

অনিয়মিত ড্রেজিং: পর্যাপ্তসংখ্যক ড্রেজার ও বাজেট না থাকায় তিস্তা ব্যারেজের আওতাভুক্ত নদীর অংশ (জলাধার) ও পলি আটকানোর আধার (সিল্ট ট্র্যাপ) নিয়মিত ড্রেজিং সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নদী ও সিল্ট ট্র্যাপ উভয়ের পানি ধারণক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

পানির প্রাপ্যতা: প্রাথমিকভাবে তিস্তা সেচ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল রোপা আমনে সম্পূরক (Supplementary Irrigation) সেচের জন্য। কিন্তু ২০০৬-০৭ সাল থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বোরো ধানে সেচ দেয়া শুরু হয়। মূলত বর্ষাকালে প্রকল্প এলাকায় প্রচুর পানি থাকলেও বোরোর চাষের ক্ষেত্রে পানির দুষ্প্রাপ্যতায় সেচ সাফল্যের চিত্র হতাশাজনক। ২০১৩-১৪ শস্যবছরে মোট ২৭ হাজার ৪৮৬ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়েছে, যা মোট সেচযোগ্য জমির মাত্র ৩৫ শতাংশ। যেহেতু তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকায় নদীর পানি ছাড়া অন্য কোনো সেচের ব্যবস্থা নেই, তাই প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে যথেষ্ট পরিমাণ জমি চাষাবাদ করা যায় না।

তিস্তা সেচ প্রকল্পে শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকার মূল কারণ হলো, তিস্তা ব্যারেজের প্রায় ১১২ কিলোমিটার উজানে ভারতের গজলডোবায় প্রায় ২২১ দশমিক ৫৩ মিটার দীর্ঘ ও ৪৪টি গেটবিশিষ্ট ব্যারেজ নির্মাণ। গজলডোবা ব্যারেজের রয়েছে তিনটি পর্যায়। প্রথম পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খনন করে নৌপথ তৈরি করে পানিপ্রবাহ পরিবর্তন করা। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণকাজ শুরুর আগে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার ডালিয়ায় পানিপ্রবাহ ছিল প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেক। কিন্তু বর্তমানে এ প্রবাহ কখনো কখনো ৬০০-৭০০ কিউসেকে নেমে আসে। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তার মূল প্রবাহ ভারত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে তিস্তায় ডালিয়ায় উজান থেকে আসা পানিপ্রবাহ প্রায় শূন্য। এখন যে ৬০০-৭০০ কিউসেক পানি আসছে, তা ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের ভাটির উপনদী থেকে।

স্থানীয় সুবিধাভোগী ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, এবার শুষ্ক মৌসুমে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ কিউসেক পানি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দিনের বেলায় ১ হাজার ৫০০ কিউসেক সেচ খালে নেয়া হয় এবং ৫০০-৭০০ কিউসেক নদীর ভাটিতে ছেড়ে দেয়া হয়। আর রাতের বেলায় ৫০০-৭০০ কিউসেক সেচ খালে নেয়া হয় এবং ১ হাজার ৫০০ কিউসেক ভাটিতে ছাড়া হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচ দেয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক। শুধু সেচ প্রকল্প সম্পূর্ণরূপে চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন অন্তত চার হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু ডিসেম্বরের পর থেকে তিস্তায় পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারণে ব্যারেজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ফসল ও ঘরবাড়ি ঝুঁকির মুখে পড়ে। ভারত তখন সব গেট খুলে দেয়। এতে বাংলাদেশে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট ২৪ ঘণ্টা খুলে দিয়েও পানি সরানো সম্ভব হয় না। এই অতিরিক্ত পানি অপসারণের জন্য প্রকল্পের উত্তরে ৬১০ মিটার একটি খাল নির্মাণ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে বন্যায় এ খাল ধ্বংস হয়ে অনেক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নদীর নাব্যতা ও পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা: গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত কর্তৃক পানি নিয়ন্ত্রণ করা হলেও বর্ষাকালে তিস্তা ব্যারেজে অতিরিক্ত পানিপ্রবাহ থাকে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা খুবই অপ্রতুল হওয়ায় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ থাকে না। ফলে নদীতে বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজের ভাটিতে যা যমুনা পর্যন্ত মিলিত হতে ১০০ কিলোমিটার শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই পানিপ্রবাহ না থাকায় চর জেগে ওঠে। তিস্তা ও এর শাখা নদীতে স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী এবং পার্শ্ববর্তী মাঠগুলোয় পানির অভাবে ঠিকমতো ফসল ফলে না এবং আশেপাশের গাছপালা মরে যায়। এতে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়ে তিস্তা ব্যারেজের ভাটিতে মরুকরণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির প্রভাবে ঘন ঘন বন্যায় নদীর পাড় ভেঙে ফসল ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পানি ব্যবস্থাপনা দল কর্তৃক চিহ্নিত সমস্যা: গত ১৫ অক্টোবর লালমনিরহাট জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার মধ্যরাজি চেংমারীতে কয়েকটি পানি ব্যবস্থাপনা দলের সদস্যদের সঙ্গে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় আমাদের। সভায় পানি ব্যবস্থাপনা দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনসহ নির্বাহী কমিটির গঠন, পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম, তাদের আওতাভুক্ত সেচ খাল ও সেচ প্রদানের বর্তমান অবস্থা, সার্ভিস চার্জ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করেই দলগুলোর নির্বাহী কমিটি নির্বাচিত হয়। আলোচনাকালে সব সদস্যই একমত হন যে তিস্তা প্রকল্প গ্রহণের ফলে স্বল্প খরচে ভূমিতে সেচ প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছে। এতে ফসলের ফলন ও নিবিড়তা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখ্য, তিস্তা প্রকল্প এলাকায় সার্ভিস চার্জ সারা বছরে প্রতি একরে মাত্র ৪৮০ টাকা, যেখানে অন্যত্র শ্যালো ও গভীর নলকূপে প্রতি একরে সেচ খরচ ফি ধরা হয় ৬ হাজার টাকা। তবে পানি ব্যবস্থাপনা দলের অনেকেই এই সামান্য সার্ভিস চার্জও সঠিকভাবে পরিশোধ করেন না।

সেচ খালের পানির লেভেলের তুলনায় উঁচুতে জমির অবস্থান: তিস্তা ব্যারেজ লালমনিরহাট জেলায় হলেও এ জেলার জমির অবস্থান সেচ খালের পানির লেভেলের চেয়ে উঁচুতে হওয়ায় এবং পানির লিফটিংয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় লালমনিরহাট জেলার জমিগুলো সেচের আওতাভুক্ত হয়নি। এছাড়া সেচের আওতাভুক্ত অনেক এলাকায় জমির অবস্থান অপেক্ষাকৃত উঁচুতে হওয়ায় ওইগুলোয় সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সিল্ট ট্র্যাপসহ তিস্তা নদীতে ড্রেজিং এবং সেচ খাল, স্লুইস গেট, ইনলেট, আউটলেটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর মেরামত/উন্নয়নের জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব বাপাউবো এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এটি গৃহীত হলে প্রকল্পের বিদ্যমান সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ কমান্ড এরিয়াও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

তিস্তা নদী ও এর অববাহিকার উন্নয়নে প্রস্তাবিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে ‘তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্ট্রোরেশন’। প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিনিয়োগ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। চীন এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা ব্যারেজের ভাটিতে তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ, যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এ রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদীপাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। এছাড়া ১৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে। গড়ে উঠবে আধুনিক সেচ সেবা ও আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কৃষি খামার। ভেতরে নৌপথ চালু করা হবে। তবে এ প্রকল্প নেয়ার আগে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে একটি সম্ভাব্যতা জরিপ করাতে হবে।

তিস্তা ব্যারেজকে আরো ফলপ্রসূ করার জন্য সুপারিশ

নিয়মিত ড্রেজিং: পর্যাপ্তসংখ্যক ড্রেজার ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করে তিস্তা ব্যারেজের আওতাভুক্ত নদীর অংশ (জলাধার) ও সিল্ট ট্র্যাপে নিয়মিত ক্যাপিটাল ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করে এগুলোয় পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

সেচ চার্জ বৃদ্ধি: সেচ চার্জ ৪৮০ টাকা থেকে যৌক্তিক হারে বৃদ্ধি করা উচিত।

জলাধার নির্মাণ: উত্তরাঞ্চলে এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনেক নদী-নালা, খাল-বিল রয়েছে, যেগুলোকে জলাধার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এগুলো সংস্কার-খননপূর্বক গভীরতা বৃদ্ধি করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচকাজের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যেই বাঙ্গালী নদী-হুররা সাগর পর্যন্ত জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব করা হচ্ছে এ নিবন্ধে। শুধু ড্রেজিং প্রকল্প নিলে তেমন উপকার হবে না, কেননা ২১৭ কিলোমিটার পথ বেয়ে পানি বরং যমুনায় গিয়ে পড়বে এবং ভূগর্ভস্থ পানিসহ বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে।

ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি: শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ত্বরান্বিত করতে হবে।

দুটি জলাধার সৃষ্টির কার্যকারিতা চমত্কার

ঢেপা নদী সেচ প্রকল্প, দিনাজপুর:  দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ঢেপা নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১২০ মিটার এবং উত্পত্তিস্থল আত্রাই নদী। ১৯৯৭-২০০১ মেয়াদে ঢেপা নদী সেচ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পটির সেচযোগ্য এলাকা ১ হাজার ২১৫ হেক্টর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে সেচ পানির সংরক্ষণ, পরিবেশ ভারসাম্য, মত্স্য চাষ, ভূমি উন্নয়ন ছাড়াও বীরগঞ্জ উপজেলা সদরের সঙ্গে নদীর পূর্ব তীরের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। এলাকার আর্থসামাজিক ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। উল্লেখ্য, ঢেপা নদীতে ২০০১ সালে জলাধার নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়।

টাংগন ব্যারেজ সেচ প্রকল্প, ঠাকুরগাঁও: টাংগন নদীর ওপর একটি ব্যারেজ ও সেচ খাল নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ ১৯৯৪ সালে শুরু হয় এবং এটি শেষ হয় ১৯৯৬ সালে। প্রকল্পটির কমান্ড এরিয়া ৬ হাজার ৭০ হেক্টর। এর মধ্যে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রকল্প এলাকায় আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে টাংগন ব্যারেজের ‘উজানে জলধার সৃষ্টির মাধ্যমে পানিপ্রবাহ দ্বারা ৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান’। মূল ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৩৬ দশমিক ৩৬ মিটার। উল্লেখ্য, টাংগন নদীতে ১৯৯৩ সালে জলাধার তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়।

শেষ কথা

বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বর্তমান সেচ প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম আরো বেগমান করা প্রয়োজন। আর এতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কার্যকর অংশগ্রহণ। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অন্যতম একটি পরামর্শ হচ্ছে পানি সংরক্ষণাগার তৈরি এবং বর্ষার অতিরিক্ত পানি ধরে রাখা। এক্ষেত্রে জলাধার তৈরির জন্য সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের অতিরিক্ত পানি ধরে রেখে সরকার তিস্তা ব্যারেজের ভাটিতে দ্বিতীয় তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের সম্ভাবনা চিন্তা করতে পারে। সেচ প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম আরো গতিশীল করার জন্য স্লুইস গেটগুলোর সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা, বাঁধগুলোর নবায়ন কার্যক্রম চালু করা, স্থানীয় পানি ব্যবস্থাপনা দলগুলোর কার্যক্রম আরো সক্রিয় করা, সরকারি অনুদানের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমানো, নদী-খাল যাতে অবাধে দখল না হয়, সেদিকে স্থানীয় প্রশাসনসহ সব অংশীজনের একসঙ্গে কাজ করা খুবই জরুরি।

বাঙ্গালী নদী, যা গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলায় যমুনা নদী থেকে উত্পত্তি হয়ে বগুড়ার করতোয়া নদী হয়ে, বড়াল নদী হয়ে, ফুলজোড় নদীতে মিলিত হয়ে হুররা সাগরে যুক্ত হয়ে সিরাজগঞ্জে যমুনায় পুনরায় মিলেছে। এ নদীর ২১৭ কিলোমিটার ড্রেজিং করার প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা হয়তো বাড়বে। তবে যমুনার পানি বাঙ্গালী হুররা সাগর হয়ে, যমুনা হয়ে ভূগর্ভস্থ পানিসহ বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে। বাঙ্গালী নদী থেকে হুররা সাগর পর্যন্ত উৎসও যমুনা মিলনমুখে ব্যারেজ তৈরি করে শুকনো মৌসুমের জন্য বৃহৎ জলাধার নির্মাণ করলে (এর সঙ্গে কয়েকটি নদী ও খালে স্লুইস গেট নির্মাণ করতে হবে) উত্তর বাংলার গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও অন্যান্য জেলার শুকনো মৌসুমে সেচ ও গৃহস্থালি অন্যান্য কাজে পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এবং নৌ-চলাচলসহ ব্যাপক মত্স্য উৎপাদন বাড়ানো যাবে।

ড. শামসুল আলম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সদস্য (সিনিয়র সচিব)

সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন

Exit mobile version