আগামী ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালট পেপারে ‘সত্যিকার কোনো বিরোধী প্রার্থীর’ উপস্থিতি থাকছে না। বরং ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান অসংগঠিত প্রার্থীদের মধ্য থেকে ভোটারদের একজনকে বেছে নিতে হবে। প্রতিযোগিতাহীন এমন নির্বাচনে ভোটারদের কাক্সিক্ষত উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের ভোট পূর্ব পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ব্রাসেলসে পাঠানো একটি বার্তায় এমন পূর্বাভাসই দিয়েছে ঢাকার এক ইউরোপীয় মিশন। বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভোটগ্রহণের দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের মানুষ ক্রমেই নির্বাচনকে ‘বিশেষ নির্বাচন কার্যক্রম’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে গত ১৭ই ডিসেম্বর একটি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলকে দেয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ওই সাক্ষাৎকারে আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপি’র নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। দেশে অস্থিতিশীলতা এড়াতে বিরোধীদের কারাগারে পাঠানো ছাড়া সরকারের কাছে কোনো গত্যন্তর ছিল না বলেও আব্দুর রাজ্জাক উল্লেখ করেছিলেন।
ব্রাসেলসে পাঠানো বার্তায় আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার সহকর্মী রাজ্জাকের বক্তব্য প্রত্যাখান করেছেন। তিনি এটাকে আব্দুর রাজ্জাকের ‘ব্যক্তিগত মত’ বলে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনের পরিবেশ, মনোয়ন এবং অন্যান্য বিষয়ে বিস্তৃত পর্যবেক্ষণ বিষয়ক ওই বার্তায় মনোনয়নকে ঘিরে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী এবং শরিকদের অসন্তোষের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। তাতে বলা হয়, ৭০ জন সংসদ সদস্যের মনোনয়ন না পাওয়া, ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মাত্র ৬টি আসন দেয়া, আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ‘ডামি বিরোধী প্রার্থীদের’ সমর্থনে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত সংক্ষুব্ধ প্রার্থীদের একটি বড় অংশ ওই ডামি বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থীর পরিবর্তে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থনের হার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। চাপে পড়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ২৬ আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন জানিয়ে বার্তায় আরও বলা হয়, ওই আসনগুলোতে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ডামি প্রার্থীদের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা।
ইউরোপীয় মিশনের বার্তায় ১৮ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী আহুত হরতালের প্রসঙ্গটিও স্থান পেয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন এবং বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের বিষয়গুলোও বার্তায় স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগমীরসহ দলের অন্তত ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গাদাগাদি করে জেলে আটক রাখা, কারাবন্দি অবস্থায় নির্যাতনে বিএনপি’র ৬ জন কর্মীর মৃত্যুর অভিযোগ ইত্যাদি প্রসঙ্গ। নির্বাচনকে ঘিরে যেসব সহিংসতা হচ্ছে তার খানিকটা তুলে ধরে ব্রাসেলসে পাঠানো কূটনৈতিক মিশনের ওই বার্তায় বলা হয়, এখন যেসব সহিংস ঘটনা ঘটে চলেছে তা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই চালাচ্ছে না। দুই রাজনৈতিক শিবিরের সদস্যরাই নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানোর জন্য বল প্রয়োগ করে চলেছে। ১৯শে ডিসেম্বর ঢাকামুখী একটি ট্রেনে আগুন দেয়ায় ৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বিয়োগান্তক ওই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একে অন্যকে দোষারোপ করলেও প্রকৃত অপরাধী এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বার্তার উপসংহারে বলা হয়েছে, নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে এটা স্পষ্ট যে ‘বিশ্বাসযোগ্যতার মোড়কে’ আয়োজিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আরও প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে। তবুও সরকার বিশেষ ওই নির্বাচন বাস্তবায়নে মরিয়া।
মানব জমিন