Site icon The Bangladesh Chronicle

ব্যাংক একীভূতকরণ: সামন্তবাদী বিয়েতে অপ্রস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ব্যাংক একীভূতকরণ: সামন্তবাদী বিয়েতে অপ্রস্তুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বিরূপাক্ষ পাল

সিডনির প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ‘মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন’ বিষয়টি একজন রসিক শিক্ষকের কাছে পড়েছিলাম। তাঁর দেওয়া মজার উদাহরণগুলো ভুলিনি।

আলোচনা শুরুর আগেই তিনি বললেন যে ‘মার্জার’ (একীভূতকরণ) হচ্ছে ‘লাভ ম্যারেজ’। ‘অ্যাকুইজিশন’ (অধিগ্রহণ) হচ্ছে বরপক্ষের ইচ্ছায় বিয়ে, যা অসহায় কন্যাকে মেনে নিতে হয়। ‘টেক ওভার’ (দখল) হচ্ছে হাইজ্যাক করে তুলে নিয়ে জোরপূর্বক বিয়ে। তখন যৌবন ছিল, তাই এ রকম জুতসই উদাহরণ শুনে সবাই খুব মজা পেয়েছিলাম।

দীর্ঘ সিকি শতাব্দী পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আরোপিত ‘মার্জার’ দেখে সিডনির শিক্ষকের দেওয়া মার্জারের উদাহরণের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ, দুটো প্রতিষ্ঠানকে মেলানোর এই কাজে অন্তত একটি পক্ষের আগ্রহ থাকতেই হবে। বর্তমান ব্যাংকপাড়ায় যা ঘটছে, তাতে কোনো পক্ষেরই আগ্রহ নেই। উভয় পক্ষই এ–জাতীয় বিয়ে ঠেকাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু ‘দেবদাস’-এর পার্বতীর মতো মুখে কিছু বলতে পারছে না। এগুলোকে ‘মার্জার’ বলে না। এগুলো হচ্ছে ‘ফোর্সড কনসোলিডেশন’ বা জোরপূর্বক সমন্বিতকরণ।

অনেকে তাগাদা দিচ্ছেন, মার্জার বা একীভূতকরণ বিদেশে হয় অহরহ। কিন্তু সেখানে নিয়ন্ত্রক পারলে তা ঠেকিয়ে রাখে। কারণ, একীভূতকরণ থেকে মনোপলি বা একচেটিয়াত্বের জন্ম হতে পারে। এতে ভোক্তাস্বার্থ বিনষ্ট হয়। নিয়ন্ত্রক না পারলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় ভোক্তাশ্রেণি। শেষতক আদালত যাচাই করে দেখেন, এই একীভূতকরণ বাজারে প্রতিযোগিতা কমাচ্ছে কি না। কমালে তা বাতিল হয়।

প্রতিযোগিতা না কমালে তার অনুমোদন দেওয়া হয়। দুটো ব্যাংক একীভূতকরণের পেছনে তিনটি বড় উদ্দেশ্য থাকে—এক. সিনার্জি; দুই. বাজার অংশীদারত্বের পরিধি বৃদ্ধি এবং তিন. নতুন ভাবমূর্তির উন্মোচন বা রিব্র্যান্ডিং।

সিনার্জি মানে দুই যোগ দুইকে চারের চেয়ে বেশি বানানো। দুই চাকার বাইকের যে হর্সপাওয়ার, চার চাকার মোটরগাড়ির হর্সপাওয়ার তার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়। এই সিনার্জি কাজে লাগিয়ে বাজারের পরিধি বাড়ানো হয়। এক ব্যাংকের প্রযুক্তি উন্নত, আরেক ব্যাংকের শাখা ও জনবল বিস্তৃত। এদের মিলন সোনায় সোহাগা। এরা মিলিতভাবে আয়তনের সুবিধা বা ইকোনমিজ অব স্কেল ভোগ করে।

এগুলোর কোনোটির কার্যকারণের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ব্যাংক একীভূতকরণের তৎপরতাকে মেলানো যায় না। মুখে বলা হচ্ছে এরা স্বেচ্ছায় মিলতে চাইছে। আসলে খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিঞ্চিৎ ভেজালযুক্ত ব্যাংককে আদেশ দিয়েছে, সে যেন পচা আপেলকে তাজা কমলালেবু জ্ঞানে গ্রহণ করে নেয়।

ভেজাল ব্যাংক বুঝতে পারে যে নিয়ন্ত্রকের কথা পালন করলে অন্য বিষয়ে সুবিধা পাওয়া যাবে। সস্তা দামে পচা ব্যাংককে কেনা যাবে। অন্যদিকে ভেজাল ব্যাংককে নানা সংজ্ঞা পাল্টিয়ে রাতারাতি এক ‘সরস ব্যাংক’-এ পরিণত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য কোনো ব্যাপার নয়।

গত অর্থমন্ত্রীর আমলে ব্যাংক খাতের চরিত্রগত কিছু ক্ষতি হয়ে গেছে, যা এই খাতের বর্তমান দুরবস্থার জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী। এক. পরিচালনা পরিষদের পারিবারিকীকরণ; দুই. খেলাপির ঘন ঘন সংজ্ঞা পরিবর্তন। এই দুইয়ের সম্মিলিত ফল ঋণের নামে তহবিল লুণ্ঠন বৃদ্ধি এবং একই সমীকরণে বিদেশে অর্থ পাচার বৃদ্ধি।

বর্তমান গভর্নরের আমলে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে নানা টোটকা চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হলেও আরেকটি নীতিগত অধঃপতনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তা হলো কোনো শিল্প গ্রুপের একটি খেলাপি রোগে আক্রান্ত হলেও ওই একই গ্রুপের অন্য ব্যবসার ঋণ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। এই তলা ফুটো আইন চালু রেখে ৩৩টি মার্জার করলেও খেলাপি সমস্যার সমাধান হবে না। পেছনের দরজা খোলা রেখে সামনের দরজায় মোটা তালা আর গোটা পাঁচেক প্রহরী বসালেও কোনো কাজ হবে না। আসলে এটি লুণ্ঠনকর্ম অব্যাহত রাখার এক সবুজসংকেত।

এক সেয়ান ভিক্ষুক থালা হাতে রাস্তায় বসে। সে কিন্তু সব সময় প্রাপ্ত পয়সাকড়ি গাঁটে গুঁজে রেখে সতর্কভাবে থালাটি খালি করে রাখে। এতে মানুষের সহানুভূতি বাড়িয়ে বেশি ভিক্ষা পাওয়া যায়। দুই বন্ধু হোটেলে খেতে গেল। এক বন্ধু খাবে পেটচুক্তি খাবার, যার দাম একটু বেশি। পাশের বন্ধু এক থালা অল্প খাবার কিনে নিল অনেক কম দামে। পেটচুক্তির বন্ধু যা চাইছে, হোটেলওয়ালা তা-ই দিতে বাধ্য হচ্ছে। চুপেচাপে সে আবার পাশের বন্ধুর থালায় খাবার পাচার করে দিচ্ছে। এভাবে দুজনেই ভরপেট খেয়ে হোটেলওয়ালার কিছুটা লোকসান করে দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করল।

খেলাপি ঋণের নতুন আইন গুণগতভাবে এই একই জাতের। এটি শিয়াল কর্তৃক কুমিরের এক ছানাকে সাতবার দেখানোর ঘটনা। ব্যবসায়ীরা সব সময়ই দাবি করতেন যে তাঁদের এক ব্যবসা ঋণখেলাপি হলে আরেক ব্যবসা ঋণ পাবে না কেন?

মালিকানা বা ব্যবস্থাপনা তো এক। একটি অপরাধের জন্য সেই শিল্প দল দোষী হলে আরেক স্বাভাবিক কাজের দাপটে তাকে দোষমুক্ত করা যায় কীভাবে? এক মস্তান একটি খুন ও একটি চুরিকর্ম সাধন করেছে। চুরির জন্য তার জামিন হলেও খুনের জন্য তাকে কারাগারেই থাকতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই দীর্ঘ ২৫ বছর একটি ব্যবসায় ঋণখেলাপি হলে সেই শিল্পপতির আরেকটি ব্যবসায় ঋণ দিত না। এটি অভ্যাসগত খেলাপি তৈরিতে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করত। হঠাৎ কী এমন হলো যে এই আইনের পরিবর্তন করতেই হবে? এটি খায়েশি খেলাপিকে কোনো দিন শুদ্ধ করার সুযোগ দেবে না।

কোনো শিল্পপতির ১০টি ব্যবসার একটি যদি ঋণখেলাপি হয়, তাহলে এটি ওই শিল্পপতির প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁর বাকি ব্যবসাগুলো দিয়ে রুগ্‌ণ ব্যবসাকে টেনে তোলা। টেনে তোলা সম্ভব না হলে দেউলিয়া আইন মেনে ওই ব্যবসার বিলুপ্তি ঘটিয়ে দায়দেনা শোধ করা।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আইনগত শৈথিল্য এক হাতে করপোরেট দক্ষতা বা জবাবদিহি নষ্ট করবে। অন্য হাতে একই শিল্পপতির হেফাজতে থাকা অন্য ব্যবসাগুলোর ভান করে খুঁড়িয়ে চলার প্রহসন বাড়বে। এতে আরও ব্যাংক তহবিল লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো–জাতীয় নীতিমালা বাড়িয়ে চলছে, যা ব্যাংকিং খাতকে দুর্যোগের মধ্যে ফেলেছে ও আরও ফেলবে।

মার্জার বিস্ফোরণে ঝাঁপিয়ে না পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত আগে নিজেকে প্রস্তুত করা এবং গত আট বছরের ভুল নীতিমালাগুলোকে ঠিক করা। এ ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি অপ-আইনের সংশোধন প্রয়োজন; এক. ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামোর পারিবারিকীকরণ আইন বাতিল করা। দুই. খেলাপি ঋণের নব সংজ্ঞায়ন, অর্থাৎ কালো ঋণকে সাদা করার আইন বাতিল করা এবং তিন. বর্তমান গভর্নরের সময়ে প্রযোজিত এক ব্যবসা খেলাপি হলে একই শিল্প গ্রুপের আরেক ব্যবসাকে ঋণ দেওয়ার আত্মঘাতী আইন বাতিল করা।

এই তিন অপ-আইন ঘটেছে গত আট বছরে। ঠিক একই সময়ে ব্যাংকিং খাত মন্দ থেকে মন্দতর হয়েছে। ভুল আইন প্রথমে নষ্ট করে চরিত্র। দ্বিতীয়ত, ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠান। তৃতীয়ত, ডোবায় অর্থনীতিকে। তা নিয়ে ড্যারেন এসেমৌলো, লা পোর্টা, ডগলাস নর্থসহ কয়েক শ প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিবিদের গবেষণা রয়েছে।

অধিকাংশ ব্যাংক যে আজ ডুবতে বসেছে, এর দায়দায়িত্ব কি শুধুই ব্যাংকগুলোর? তাজা আপেল পচে যাওয়ার পেছনে প্রথমত দায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, প্রতিটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সব বিষয়ের রিপোর্ট দিতে বাধ্য। এর বাইরে আগ বাড়িয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর নিরীক্ষা বা নজরদারি বাড়াতে পারে।

এই জায়গাগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো অপ্রস্তুত। ভুল আইন বানানোর ক্ষেত্রেও এই কর্তা দায়মুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে আরও ‘হোমওয়ার্ক’ না করে ‘ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ে’ স্টাইলে জোরপূর্বক সামন্তবাদী পরিণয় ঘটিয়ে দিলেও সংসার টিকবে না।

● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক

prothom alo

Exit mobile version