বাকশাল পতনের মাসে বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রকর শহিদুল আলম নতুন করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের রোষানলে পড়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দালালদের তাকে সেকি গালাগালির বন্যা। ফিবছর আগস্টে বাংলাদেশে মুজিববাদিদের মধ্যে কান্নাকাটি আর মুজিববন্দনার ধুম পড়ে যায়। এবার মুজিববন্দনার মচ্ছবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসনও যোগ দিয়ে ১৯৭২ সালে লন্ডনে প্রদত্ত শেখ মুজিবের প্রথম সংবাদ সম্মেলনের কথা স্মরণপূর্বক এক টুইট করেছিলেন। শহিদুল আলম কয়েক লাইন নিজস্ব মন্তব্য যোগ করে সেটিই রি-টুইট করেছেন। তিনি ইংরেজিতে যা লিখেছেন তার অনুবাদ অনেকটা এরকমঃ
“বাংলাদেশে ক্রসফায়ারে নিহত মানুষদের প্রত্যেক বাবা-মা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, স্ত্রী, প্রেমিকা, এবং বন্ধুও শোক করে। বছরের কোন দিনটি আমরা তাদের শোকের জন্য নির্ধারিত রাখবো”?
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শহিদুল আলম যথেষ্ট সাহস করে খুবই প্রাসঙ্গিক এবং মানবিক প্রশ্ন তুলেছেন। গত মাসে বহুল আলোচিত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত দেশে এক বছরে ৪০০- এরও অধিক নাগরিককে ক্রসফায়ারে মেরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিনা বিচারে খুনের নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। এছাড়া পুলিশ-র্যাব মিলে গুম করেছে আরও পঞ্চাশ জনকে। কিন্তু, শেখ হাসিনার রাজ্যে তাদের জন্য কোন শোক প্রকাশ করা চলবে না। আর করলেও আগস্ট মাসে তো সেটা একেবারেই নাজায়েজ কর্ম। ওই মাসটিতে শুধু এক জনের জন্যই রাতদিন বুক চাপড়াতে হবে। কী আজব এক দেশে আমাদের বসবাস করতে হয় যে আগস্টে পুলিশের অনুমতি ছাড়া কারো বিয়েশাদি, জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে অপারগ হয়ে পুলিশের কাছে অনুমতি চাইতে গেলেও সেটা পাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। আর অনুমতি ছাড়া কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের ধৃষ্টতা দেখালে সেক্ষেত্রে হিংস্র পুলিশের দল বেঁধে হানা, মারধর, জেল-জুলুম এমনকি আয়োজকদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনও হতে পারে।
ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের জামানায় রসিকতা করে বলা হতো যে বাগদাদের আদমশুমারিতে যা জনসংখ্যা দেখান হতো তার অর্ধেকই নাকি ছিল নানা কিসিমের সাদ্দামের মূর্তি। আজকের বাংলাদেশ কি তার থেকে কোন অংশে ভিন্ন? দেশে শেখ মুজিবের কত হাজার অথবা লক্ষ মূর্তি এবং প্রতিকৃতি কিংবা তার নামে সড়ক, সেতু, খেলার মাঠ, স্থাপনা, সংগঠন রয়েছে তার হিসেব স্বয়ং শেখ হাসিনাও দিতে পারবেন না। কদিন আগে শুনলাম মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নতুন করে মুজিব কর্নার বানানো হবে। স্টেডিয়ামটি অনেক আগেই নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা এবং অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হকের নামে। তাই স্টেডিয়ামের পুরানো নাম পাল্টানো যাচ্ছে না। অতএব, মুজিব কর্নার করা হবে যাতে সকল আন্তর্জাতিক খেলা চলাকালে টেলিভিশনে সারাটা ক্ষণ মুজিবের ছবি আর নাম দেখান যায়। আর এক জন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনায় একটা কর্নার বরাদ্দের মাধ্যমে যে তাদের ‘মহান পিতা’কে প্রকৃতপক্ষে অসম্মান করা হচ্ছে এটা বোঝার মত বুদ্ধিও চাটুকারদের লোপ পেয়েছে। বাংলাদেশে মুজিবপূজাকে রীতিমতো অশ্লীলতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোড়কে ব্রাহ্মণ্যবাদি হিন্দুত্ববাদের চর্চা দেশে গত অর্ধশতাব্দি ধরে চলছে। বাঙালি মুসলমান তার হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি ভুলতে বসেছে। বাঙালি মুসলমানের মুখের ভাষাও সুকৌশলে বদলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় এখন ‘পানি’র পরিবর্তে ‘জল’ শব্দের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এই প্রশ্ন কেউ করছেন না যে কজন বাঙালি মুসলমান পিপাসা পেলে জল পান করতে চান? মৃতদেহকে লাশ লিখতে অনেকেই লজ্জাবোধ করেন, দাফনের চেয়ে সৎকারে তারা বেশি উৎসাহী। বাঙালি সংস্কৃতি বলতে কেবল হিন্দু সংস্কৃতিকেই সর্বত্র কিভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি বুঝবার জন্য পয়লা বৈশাখের দিনব্যাপি মঙ্গল শোভাযাত্রা, রবীন্দ্রবন্দনা এবং অন্যান্য আনন্দ-ফুর্তির দিকে তাকালেই চলবে। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি ব্যক্তিপূজার নামে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে সরাসরি পৌত্তলিকতারও আমদানি শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুজিববর্ষ পালন করা সম্ভব হলে হয়ত রাষ্ট্রীয়ভাবেই পৌত্তলিকতা প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত। আল্লাহর গজবের মত করে করোনার আবির্ভাব ক্ষমতাসীনদের সেই অপচেষ্টা আপাতত ভেস্তে দিয়েছে। পবিত্র কোরআন শরিফেই তো আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী। আমরা একটু ভেবে দেখার চেষ্টা করি যে করোনা না এলে বাংলাদেশে এসময় কি বিষম কাণ্ড ঘটতে পারত।
সেক্ষেত্রে এই বছর মার্চের প্রথম দিন থেকে ২০২১ সালের মার্চের ৩১ পর্যন্ত দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৯ ঘণ্টা অর্থাৎ সুবেহ সাদেক থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ অবিরত শুনে কান আর মাথা দুটোরই বারোটা বাজত। বাংলাদেশের শ’খানেক টেলিভিশন চ্যানেলে এক বছর ধরে দিবারাত্রি একটি বিশেষ পরিবারের ছানাপোনাসহ সকলের চেহারা মোবারক অবলোকন করে জাতিকে কৃতার্থ হতে হতো। দেশের বিভিন্ন সাধারণ জনগণের বাড়িতে বাড়িতে চাঁদার জন্য ছাত্রলীগ, যুবলীগের পাণ্ডারা ঝাপিয়ে পড়ত। দেশের বারোটা বাজিয়ে রাতারাতি ধনবান হওয়া আওয়ামী ব্যবসায়ীকুল গণভবনে শত শত কোটি টাকার চেক নিয়ে মুজিব কন্যাদ্বয়ের হাতে সমর্পণ করার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়াত। এমনও হতে পারত যে আমরা নতুন একটি বর্ষপঞ্জীই হয়ত পেয়ে যেতাম। বর্তমানে বাংলা, ইংরেজি এবং হিজরি বছরের সাথে আমরা পরিচিত। ২০২০ সালে শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিব বছর শুরু হওয়া বিচিত্র ছিল না। তবে ইংরেজিতে একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে। সেই যে, মানুষ আশা করে একরকম কিন্তু বাদ সাধেন ঈশ্বর। ক্ষমতাসীনদের বেলাতেও বাংলাদেশে এবার তাই হয়েছে।
সরকারের চেষ্টায় অবশ্য কোন কসুর ছিল না। মার্চের প্রথমে সারা পৃথিবী যখন করোনার ভয়ে কম্পমান, শেখ হাসিনা নাকি বলে চলেছেন তিনি থাকলে করোনা বাংলাদেশে আসবে না। আমন্ত্রিত বিদেশিরা একে একে অপারগতা প্রকাশ করলেও মোদীজির আগমনের আশায় যাগযজ্ঞের প্রস্তুতিতে কোন ভাটা পড়েনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মত। অতএব, করোনার ভয়ে সবাই পালিয়ে গেলেও স্বামী তো আর স্ত্রীর পাশে না দাঁড়িয়ে পারবে না। কিন্তু, সমস্যা বাধল অন্যখানে। একই সময় দিল্লিতে বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমান নিধন যজ্ঞ চলছে। ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুরা আবার কিছুদিন পরপর মুসলমানদের গুলি করে, পাথর ছুঁড়ে, ছুরি-চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে কিংবা গণপিটুনিতে মারার ব্যবস্থা না করলে ভোট দেয় না। মোদীজির কাছে ভোটের রাজনীতি মুজিববর্ষ পালনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় মুসলমানদের শায়েস্তা না করে তিনিই বা কি করে রাজধানী ছাড়েন? তাই মোদীজিও শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায় হয়েই ঢাকা সফর বাতিল করলেন। কী আর করা। মুজিব বর্ষের মহা আয়োজনও ঘোরতর অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্থগিত করতে হল। জন্মশতবার্ষিকী যখন হল না, তখন করোনাকেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ঢুকতে অনুমতি দিলেন। মার্চের মাঝামাঝি স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনারোগী খুঁজে পাওয়ার ঘোষণা করলেন। সেই থেকে করোনা এবং শেখ হাসিনা এক প্রকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেই বাংলাদেশে আছেন।
বিগত বারো বছরে ব্যক্তিপুজার অশ্লীলতার কাছে জনগণের অসহায় আত্মসমর্পণের পাশাপাশি বাংলাদেশে নীতি-নৈতিকতারও চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে। ক্রসফায়ারে নিহত মেজর সিনহা এবং ত্বদীয় বন্ধু-বান্ধবীদের জীবনাচার ও পুলিশের গুলিতে তার নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থার পচন এখন সর্বসমক্ষে দৃশ্যমান। আয়েশি পার্থিব জীবনের মোহের কাছে আদর্শ আজ পরাজিত। তথাকথিত সুশীল সমাজ অনেক আগেই বিবেক বন্ধক দিয়েছে। ধর্মবেত্তারাও এখন প্রাপ্তির আশায় ক্ষমতার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। হেফাজতের স্ফুলিঙ্গও অতি দ্রুত নিভে গেছে। নতুন করে আলো জ্বালানোর আগে সুড়ঙ্গের শেষে তাই আর আলো খুঁজে লাভ নেই। আমাদের মত প্রবীণরা ফ্যাসিবাদের কাছে পরাজিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সাহসী তরুণদেরই পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়ে এখন দৃঢ় ঈমান নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বিপ্লবের মশাল হাতে। জাতিকে আলো দেখাতে ইনশাআল্লাহ তারাই সক্ষম হবে।
মাহমুদুর রহমান
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
Buy sinequan