জোসেফ ডানা
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে ইতিহাস লেখা হলে কতটা ইতিবাচক হিসেবে লেখা যাবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থেকেই যায়। বেইজিংয়ের সঙ্গে বিশ্ববাজারের বড় অংশটিকে যুক্ত করতে উদীয়মান দেশগুলোতে অবকাঠামো নেটওয়ার্ক তৈরির প্রকল্প বিআরআই।
এ জন্য এখন পর্যন্ত এক হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে চীন। কিন্তু শুরুতেই এ উদ্যোগে নানা ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তহবিল খালি হওয়া, চলমান প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়া এবং গ্রহীতা দেশগুলো ঋণের ভারে ডুবতে বসা—এ ধরনের বিপত্তি ঘটছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু দেশ তাদের ঘাড়ের ওপর চীনের প্রভাব নিয়ে খোলাখুলি বিরোধিতা করছে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিআরআই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কঠিন প্রশ্ন করার সময় এসেছে। প্রকল্পে স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীন তার পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে সাজাচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্ন।
এশিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত উদীয়মান বাজারগুলোতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি করাই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। ২০১০-এর দশকে বিআরআই যখন বাস্তব গতি পায়, এ সময়ে উদীয়মান বাজারগুলোর জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির বয়ান ছিল অযৌক্তিক এক আশা। বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম থেকে শুরু করে অর্থনীতির কাগজ সবখানেই উদীয়মান বাজারগুলোকে পরবর্তী অর্থনৈতিক বিস্ময় বলে প্রচার করা হয়েছিল। স্মার্টফোন ও বিমান যোগাযোগের সহজলভ্যতার কারণে যে বৃহৎ কানেকটিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে তাতে আশা করা হয়েছিল, কেনিয়া থেকে কাজাখস্তান—সবখানেই নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটতে চলেছে। দ্রুত নগরায়ণ—এমনকি দ্রুত জন্মহারের কারণে এই মধ্যবিত্তরাই বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
এসব জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে কাছের পরাশক্তি হিসেবে চীন খুব দ্রুত এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জোয়ারের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। অবকাঠামো প্রকল্প, সস্তা ঋণ ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ—এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চীন নতুন অর্থনৈতিক মেরুকরণে যুক্ত হতে থাকে। টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সারা বিশ্বে একটি ঝড় তুলেছে। চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে টিকটক নিঃসন্দেহে বড় একটি অস্ত্র।
বিআরআই প্রকল্পের এ ত্রুটি চীন সম্পর্কে প্রচলিত ঋণফাঁদ ধারণার পক্ষে আরও জোরালো ভিত্তি তৈরি হয়। এ ধারণার মূল বিষয় হলো, চীন জবরদস্তিমূলকভাবে ঋণ চাপিয়ে দেয়, ফলে শ্রীলঙ্কার মতো সংকটের জন্ম হয়। অনেকে এ–ও সমালোচনা করেন, চীন ঋণ চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই আগ্রাসী যে কোনো দেশে তৈরি হওয়া অবকাঠামো কোনো কাজে লাগছে কি না কিংবা সেই প্রকল্প ব্যাপক পরিবেশ দূষিত করছে কি না, এই বিবেচনা একেবারেই করছে না।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ভাষায়, বিআরআই ‘এই শতাব্দীর প্রকল্প’; অর্থাৎ চীনকে কেন্দ্রে রেখে বিশ্বব্যবস্থার ক্রম বদলে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। চীনের অর্থনীতির শাঁই শাঁই প্রবৃদ্ধির সেই যুগ যদি অক্ষুণ্ন থাকত, তাহলে কম সুদের ঋণ ছড়িয়ে চীনের পক্ষে বিশ্বের কেন্দ্র হয়ে ওঠা হয়তো সম্ভব ছিল। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক চিত্র এখন হতাশাজনক। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন যে ভাটা চলছে এবং কোভিড মহামারির কারণে চীনে যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তাতে দেশটির অর্থনীতি রীতিমতো ধুঁকছে।
বিআরআই প্রকল্পের মান নিয়ে বেশ কয়েকটি দেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরও অনেক জটিল হয়ে উঠেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সম্প্রতি ইকুয়েডর থেকে গাম্বিয়া পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশে বিআরআই প্রকল্পের ত্রুটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ইকুয়েডরের ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রধানতম। সেটিতে এত বেশি ত্রুটি পাওয়া গেছে যে পুরো প্রকল্পটি বাতিল করতে হতে পারে। জলবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ইকুয়েডরের বিদ্যুতের অন্যতম বড় উৎস হওয়ায়, প্রকল্পটি বাতিল হলে দেশটি বড় ঋণের মধ্যে ডুবে যেতে পারে।
বিআরআই প্রকল্পের এ ত্রুটি চীন সম্পর্কে প্রচলিত ঋণফাঁদ ধারণার পক্ষে আরও জোরালো ভিত্তি তৈরি হয়। এ ধারণার মূল বিষয় হলো, চীন জবরদস্তিমূলকভাবে ঋণ চাপিয়ে দেয়, ফলে শ্রীলঙ্কার মতো সংকটের জন্ম হয়। অনেকে এ–ও সমালোচনা করেন, চীন ঋণ চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে এতটাই আগ্রাসী যে কোনো দেশে তৈরি হওয়া অবকাঠামো কোনো কাজে লাগছে কি না কিংবা সেই প্রকল্প ব্যাপক পরিবেশ দূষিত করছে কি না, এই বিবেচনা একেবারেই করছে না।
এ প্রেক্ষাপটে গত বছর চীন সরকার চুপিচুপি বিআরআই প্রকল্পের কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন এনেছে। চীনের নীতিনির্ধারকেরা নতুন প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন এবং ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দর-কষাকষি করতে সম্মত হয়েছেন। বিশ্ব অর্থনীতি যদি একটি দীর্ঘস্থায়ী মন্দার মধ্যে প্রবেশ করে এবং চীনের প্রকল্পগুলো যদি ব্যর্থ হতেই থাকে, তাহলে বেইজিংয়ের এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রাখতে বাধ্য।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ অর্থনীতিবিদ সেবাস্তিয়ান হর্ন ও কারমেন রেইনহার্ট বলেছেন, যেসব দেশ অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে, তারা যে বিদেশি ঋণ নিয়েছে, তার ৬০ শতাংশই চীনের কাছ থেকে নেওয়া। ২০১০ সালের সেটি ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
- জোসেফ ডানা প্রযুক্তিবিষয়ক সাপ্তাহিক এক্সপোন্যানশিয়াল ভিউ–এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক