Site icon The Bangladesh Chronicle

বেলালরা এভাবেই হারিয়ে যায়


মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন। বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার জলদি এলাকায়। তার জীবনে এখন বইছে বিষাদের বাতাস। একটু পরিষ্কার করে বলতে হলে যেতে হবে একটু পেছনে। তুলে ধরতে হবে বেলালের জীবনের গল্প। এক ভাই ও বাবা-মা মিলে চারজনের পরিবার নিয়ে বেশ সুন্দর জীবন যাপন করছিল বেলাল। তার বাবার ওষুধের দোকান দিয়ে মোটামোটি বেশ ভালোভাবেই পরিবার চলে। সব মিলেয়ে বেশ সুখের সংসার বলা যায়। কিন্তু একসময় এই সুখের সংসারে নেমে আসে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। কঠিন দুরবস্থায় পড়ে বেলালের পরিবার। সময়টা ২০১৮ সাল। বেলালের বাবার পায়ের সামান্য ক্ষত থেকে পুরো পায়ের পাতায় পচন ধরে যায়। ডায়বেটিসের কারণে এমনটা হয়েছে বলে ডাক্তারের ভাষ্য। কিন্তু লাখ লাখ টাকা খরচ করেও তার বাবার পা রক্ষা করতে পারেনি। পায়ের পাতাটা শেষ পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। তবুও সেই ক্ষত শুকায় না। এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে দিতে হলো। আত্মীয়স্বজন আর কত দেবে! এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে ক’জন ক’জনের পাশে থাকে! পরিবারের নেমে আসা আঁধারটুকু মুছে আলো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন রোজ দেখে বেলাল। ডাক্তার বলেছিল বেলালের বাবাকে বিদেশ নিতে পারলে কিছুটা উন্নতি হবে। কিন্তু বেলালের কথা ছিল এমন- ‘দেশেই এখন খেয়ে পরে বাবার চিকিৎসা করাতে পারছি না। সেখানে বিদেশে কিভাবে!’

এভাবে কোনো রকম এ দিক সে দিক করে চলছিল বেলালের জীবন। এর মধ্যে ২০২১ সালে বেলাল এইচএসসি পাস করে। এসএসসি এবং এইচএসসি দু’জায়গায় ভালো ফলাফল হওয়াতে বেলাল স্বপ্ন দেখেছিল মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। হয়তো তার পরিবারের দুঃখ কিছুটা ঘুচবে। বাবাকে হয়তো উন্নত চিকিৎসার জন্য একসময় বিদেশেও নিতে পারবে। দু’চোখে হাজার স্বপ্ন দেখা বেলাল কোনোরকম টাকা জোগাড় করে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষাটা দেয়। কিন্তু রেজাল্ট দেখে কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল তার। অপেক্ষমাণ তালিকায় তার নাম ছিল চার নম্বরে। এরপর ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর তার দিনটি ছিল সাময়িক উৎসবের দিন। অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে সে সুযোগ পেয়েছে সিলেট মেরিন একাডেমিতে। সরকারিভাবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে ৯৯ হাজার টাকা প্রয়োজন। এটা বেলাল জানত না। বেলালের পরিবার আত্মীয়স্বজনও প্রথমে মনে করেছে বেসরকারি হবে হয়তো। নয়তো এত টাকা লাগবে কেন! কিন্তু পরক্ষণে যাচাই করে বিষয়টির সত্যতা পেল সবাই। কিন্তু ভর্তি হওয়ার লাস্ট ডেট ছিল ২৩ ডিসেম্বর ২০২১। আর ভর্তি হতে হলে ৫০ হাজার টাকা পে-অর্ডার করতে হবে। বেলাল এটা শুনেই চুপসে গেল। মনে মনে হয়তো ভেবেছে আর বুঝি স্বপ্ন পূরণ হলো না। এত টাকা কোথা থেকে পাবে সে? এরপরও বেলালের মা সন্তানের জন্য নিজের শেষ চেষ্টাটা করেছেন। আরো একবার আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা চেয়েছেন সন্তানের পড়াশোনার জন্য। না, দান হিসেবে নয়। ধার নিয়েছেন। এই টাকা নিতে নিতে ২৫ তারিখ হয়ে গেল। ২৬ তারিখ ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলো বেলাল। মতিঝিল, টয়েনবি সার্কুলার রোডে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় অবস্থিত। ওইখানে গিয়ে সর্বপ্রথম মিঠুন কুমার সাহার সাথে আলাপ করে। কিন্তু তিনি শুরুতেই বেলালের দরখাস্ত নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তারপর ক্যাপ্টেন এবং এক্সামিনার দেলোয়ার স্যারের কাছে দরখাস্ত করে এবং তিনি মোটামোটি আশ্বাস দেন। এরপরে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মনজুরুল কবীরের সাথে যোগাযোগ করে বেলাল। তিনি বিষয়টি নিয়ে না ভেবে এক শব্দে পারবে না বলে জানিয়ে দেন। এদিকে এক্সামিনার দেলোয়ার স্যারের আশ্বাস পাওয়াতেই বেলাল সন্তুষ্ট। কারণ তিনি বেলালের সমস্ত ঘটনা শুনেছেন। যদিও বেলাল তার দরখাস্তে এসব তুলে ধরেছে। এরপর বেলাল ফিরে আসে বাঁশখালীতে। অপেক্ষা করতে থাকে কখন ফোন আসে; কিন্তু দিনের পর দিন পার হয়ে যায় কোনো খোঁজ নেই। বেলাল সবসময় মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে, এই বুঝি ফোন আসতে পারে। কিন্তু সেই ফোন আর আসে না।

এরপর বছর পেরিয়ে নতুন বছর চলে আসে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে আর না পেরে একদিন বেলালের খালাতো ভাই ফোন দিয়ে জানতে চায় বেলালের বিষয়ে। এরপর যা খবর আসে তাতে বেলাল এবং বেলালের পরিবার হতভম্ব হয়ে যায়। বেলালের স্বপ্নটা মুহূর্তেই দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কিছু সময়ের জন্য চোখে পানি গড়িয়েছে বেলালের। এই বয়সে এসে বেলালের চোখে পানি খুব একটা দেখা যায়নি। তবে এবার আর পানি আটকাতে পারেনি বেলাল। খালাতো ভাই যখন ফোন দিয়েছে খবর জানার জন্য, তখন মিঠুন কুমার সাহা বলেন, বেলাল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভর্তি হতে পারেনি তাই তাকে সুযোগ দেয়া যাবে না। তার দরখাস্ত কেন নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেখুন আমরা তার জন্য মিটিংয়ে বসেছি। যেখানে আমাদের সচিব স্যার নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনিই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর কাউকে আর ভর্তির সুযোগ দেয়া হবে না।’ বেলালের খালাতো ভাই যখন বলছিল বেলালের সমস্যাটা আপনারা জানেন। তার বিষয়টা কি মানবিকভাবে দেখা যায় না? উত্তরে তিনি সেই একই কথা বলেন। সর্বশেষে তিনি বলেন, বেলালের বিষয়ে তিনি কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ, অথচ এই আমাদের দেশের চিত্র। যেখানে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী অর্থের অভাবে পড়তে পারে না নিজের পছন্দের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং। যখন অর্থের ব্যবস্থা হলো তখন আর মানবিকতার দেখা পায়নি বেলাল। এত পরিশ্রম, এত কষ্ট সবকিছুই বৃথা।

এই অমানবিকতা আরো কত বেলালের সাথে হয়েছে সেটি হয়তো বেলাল জানে না। কিন্তু বেলালের কষ্টটা বেলাল কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না। ভুলতে পারছে না তার পরিবার। বেলালের বাবার চিকিৎসা আর পরিবারকে নিয়ে সব স্বপ্ন ভেস্তে গেল এই এক ঘটনায়। এভাবেই অনেক বেলাল হেরে যায় নিয়মের বেড়াজালে। অথচ এসব বেলালরাই আগামী দিনের বাংলাদেশ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক
ই-মেইল : azharmahmud705@gmail.com

Exit mobile version