টানা ১৫ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগ সরলেও ‘দখলদারিত্বের’ হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না বিএনপি নেতাকর্মীরা। তাদের যেসব সম্পদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী জবরদখল করে রেখেছেন, সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারছেন না।
দলিলপত্রে ওই সব সম্পত্তির প্রকৃত মালিক হয়েও দলের কড়া নির্দেশনায় কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছেন না। হাইকমান্ড বলছে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজের সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে গেলেও দখল হিসেবে প্রচার হবে গণমাধ্যমে। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এ পরিস্থিতিতে ‘বেদখল’ সম্পদ ‘পুনরুদ্ধারেও’ বিপাকে পড়েছেন বলে জানান বিএনপির অনেক নেতাকর্মী।
ক্ষোভ প্রকাশ করে দলটির ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা সমকালকে জানান, বছরের পর বছর ক্ষমতার জোরে তাদের বাড়িঘর, জায়গা-জমি ও মার্কেট দখল করে বসে আছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই সব দখল বজায় রাখতে একের পর এক রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলাও দেওয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে। হয়রানি এড়াতে কেউ কেউ এলাকাছাড়া হয়েছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপি নেতারা বাড়িঘরে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। তবে অনেক স্থানেই বিগত দিনের দখল বজায় রয়েছে এখনও। যারা মার্কেট দখল করেছেন, তারা এখনও সেভাবেই আছেন। যারা জমি দখল করেছেন, তারাও আছেন বহাল তবিয়তে। ওই সব সম্পদ দখলমুক্ত করতে গেলেই শুরু হয় হইচই।
তারা অভিযোগ করেন, নিজেদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে উল্টো দখলের অপপ্রচার শুরু করা হয়। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় বিএনপির হাইকমান্ড থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে– কোনো সহায়-সম্পদ আপাতত দখলমুক্ত করা যাবে না। স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে দেওয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। নিজেদের সম্পদ উদ্ধার করতে গেলেও পেয়েছেন শোকজ নোটিশ। এতে হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
আবার অনেকে দলের সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে চুপসে রয়েছেন। সুবিচার পাওয়ার আশায় দৌড়াচ্ছেন আদালতের বারান্দায়। বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, অনেক ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলে জোর করে সম্পত্তি দখল করা হলেও জমির মূল্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমকালকে বলেন, সারাদেশেই এ রকম চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। গত ১৭ বছর অবর্ণনীয় জুলুমের শিকার হতে হয়েছে বিএনপির প্রত্যেক নেতাকর্মীকে। তাদের ঘরবাড়িছাড়া করা হয়েছে, সম্পদ দখল করা হয়েছে। অনেককে ভিটামাটি ছাড়া করা হয়েছে। মামলা-হামলা করে প্রত্যেক নেতাকর্মীকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। তবে বিএনপি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করে না। আর এ জন্যই আইনের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান করার পক্ষে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
শোরুম দখলের অভিযোগ
এ রকম ঘটনার মধ্যে পুরান ঢাকার বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী আবদুর রব ভূঁইয়া জানান, পুরান ঢাকার আলুবাজার এলাকায় তাঁর বৈদ্যুতিক তারের শোরুম এবং বিসিক এলাকায় কারখানা ছিল। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মাজেদ সরদারের পরিবার তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়। দখলকারী মাজেদ সরদারের নাতি জাহিদ হচ্ছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের মামাতো ভাই ও সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এই পরিচয় ব্যবহার করে তাঁর ছয় কোটি টাকার মূল্যমানের দুটি শোরুম এবং এর সব মালপত্র দখল করে নেয় মাজেদের পরিবার। তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন বলে ওই সময় থানা কোনো মামলা নেয়নি। আদালতে মামলা করে রায় পেলেও কোনো সুরাহা হয়নি। এখন তিনি তাঁর শোরুম ফিরে পেতে চাইলেও বিএনপি নেতারা সায় দিচ্ছেন না। নেতারা বলছেন, এতে দলের দুর্নাম হবে। দলের নির্দেশনায় তিনি তাঁর সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টা থেকে বিরত রয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগ পরিবারের ওই দখলদাররা এখনও বহাল তবিয়তে তাঁর সম্পদ ভোগদখল করে যাচ্ছেন। উল্টো ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। এ বিষয়ে অভিযুক্ত জাহিদকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জমি ও মার্কেট দখল
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির নেতা হাজি নিজাম জানান, পুরান ঢাকার জিন্দাবাহারে তাঁর পূর্বপুরুষের সাড়ে তিন কাঠা জমি ও মার্কেট দখল করেছিলেন কোতোয়ালি থানা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারা বেগম রেশমা। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যমানের এই সম্পদ দখল করেই ক্ষান্ত হননি রেশমা। তিনি তাদের তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৬০টির বেশি করে মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করেছিলেন। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রেশমা এলাকাছাড়া হলেও হয়রানি থেকে মুক্তি মিলছে না কারও। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিএনপি নেতা ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে হয়রানি করার চেষ্টা করছেন। বিএনপির হাইকমান্ড ও সেনাবাহিনীকে কাগজপত্র দেখানোর পর এখন একটু স্বস্তি ফিরছে। তবে স্থানীয় বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মীকে ব্যবহার করে হয়রানি করার চেষ্টা করছেন রেশমা।
এ বিষয়ে রেশমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, দখলসহ একাধিক মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা
ঢাকার বাইরেও বহু স্থানে এমন জটিলতায় পড়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলীম জানান, ২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জে বিএনপি নেতা দুলাল হোসেন খানের ১৬৫ শতাংশ দামি জমি দখল করেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ওই জমি দখল করতে গিয়ে তিনি দুলালকে দুই মাসের মতো সময় গুম করে রাখেন। পরে অস্ত্র মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠান।
জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তাঁকে গাজীপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে (ডিবি হারুন) দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই জমি তাহজীব আলমকে দেওয়ার জন্য চাপ দেন।
জমি লিখে না দেওয়ায় বিভিন্ন সময় ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেন ডিবির হারুন।
আলীম বলেন, সেই জমি এখনও দখলমুক্ত করা যায়নি। দলের বদনামের ভয়ে তারা আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক থেকে সব সংস্থায় তারা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
samakal