মা-বাবা কি আমাদের কাছে বোঝা? একক পারিবারিক কাঠামোতে আমরা মা-বাবাকে ঠিক কতটা আশ্রয়, ভালোবাসা, সেবা-যত্ন দিয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি? মা-বাবা যদি সম্পত্তির মালিক হন, তখন তাঁদের প্রতি যে রকম আচরণ করি, সম্পত্তিহীন হলেও কি তেমন আচরণই করি? প্রশ্নগুলো নিজেকে করে দেখলেই উত্তর পাওয়াটা সহজ হবে। কারণ, আমরা মা-বাবার সঙ্গে যত আবেগঘনিষ্ঠ ছবিই প্রকাশ করি না কেন, প্রকৃত অবস্থা সন্তানই জানেন। কারণ, জীবন-জীবিকা, পরিবারের চাপ, আর্থিক সামর্থ্য, নিজেদের স্বার্থপরতা এবং দায়িত্বজ্ঞান মা-বাবার প্রতি সন্তানের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
করোনাকালে দেখেছি, সন্তানেরা বৃদ্ধ মা-বাবাকে রাস্তা-ঘাটে, বিলে, জঙ্গলে, কবরস্থানে, স্টেশনে কিংবা অন্য কোথাও ফেলে গেছেন। ঘটনাগুলো ভুলেই গিয়েছিলাম। তবে সম্প্রতি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ভারুয়া বিলে ৮৮ বছরের বৃদ্ধা বেগম খাতুনকে চোখমুখ ঢেকে রেখে যান তাঁর ছেলে। যাওয়ার সময় ছেলে বলে গিয়েছিলেন, একটু পরে এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরে আর সেই সন্তান মাকে ফিরিয়ে নিতে আসেননি। সেখানে তিন দিন পড়ে ছিলেন তিনি। এর চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা আর কী হতে পারে একজন মায়ের জীবনে?
এক ছেলে ওই এলাকায় কাজ করতে গিয়ে দেখেন যে বৃদ্ধার নড়াচড়া নেই, মশা-মাছি ও বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ তাঁর আশপাশে ঘিরে ধরেছে। দেখতে পেয়ে যখন মানুষটাকে কোলে করে তুলে আনেন, তখনো বৃদ্ধা মুখ ঢেকে ছিলেন এবং বলছিলেন না যে কীভাবে তিনি এখানে এসেছেন। পরে অবশ্য পুলিশ আঙুলের ছাপ মিলিয়ে ওই বৃদ্ধার পরিবারকে শনাক্ত করে।
মায়ের প্রতি এ ধরনের নির্মম ব্যবহার একটি-দুটি নয়। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর আসছেই। জমিজমা লিখে দেওয়ার জন্য মাকে খুন করা, প্রয়োজনমতো টাকা দিতে না পারায় মাকে হত্যার হুমকি বা বাসা থেকে বের করে দেওয়ার খবর চোখে পড়ছেই। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর প্রায় ৯৯ শতাংশই প্রবীণ নারীদের পরিত্যাগ করার কাহিনি। দরিদ্র পরিবারের কাহিনি বেশি প্রকাশিত হয়। কিন্তু নারীরা অধিক হারে পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ কী? নারীদের গড় আয়ু বেশি? সন্তানেরা মাকে পালতে গিয়ে কি ধৈর্য হারাচ্ছেন? নারীর হাতে সম্পত্তি কম বা নেই বলে? নাকি মায়েরা বয়স হলে কাজ করতে পারেন না বলে? উত্তর জানার জন্য একটা গবেষণা করা দরকার।
নিজেদের মধ্যেও দেখছি, মাকে একা ফেলে রাখার প্রবণতা। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা মা স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি দিয়ে কষ্টে সংসার ধরে রাখার ও সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করলেও, সন্তানেরা বড় হওয়ার পর অনেকের রূপ পাল্টে যায়। যেসব মায়ের হাতে গচ্ছিত অর্থ থাকে না, তাঁরা নিজেদের পরিশ্রম দিয়ে ছেলে বা মেয়ের সংসারে টিকে থাকার চেষ্টা করেন। এই চিত্র খুব অপ্রিয় হলেও সত্য। গ্রামে ও শহরে, ধনী, দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের মধ্যে একইভাবে সত্য।
গ্রামে গিয়ে এলাকার বয়স্ক নারীদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, কতটা অনাদরে, অবহেলায় তাঁরা বেঁচে আছেন। স্বামী বেঁচে থাকতে বা সুস্থ থাকতে যা-ও কিছুটা আশ্রয় ছিল, স্বামী অসুস্থ হলে বা মারা গেলে সন্তানদের সেই আশ্রয়ও চলে যায় অধিকাংশ মায়ের জীবন থেকে।
ঠিক তা-ই! মায়েরা ভয় পান সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার, অবহেলা পাওয়ার অথবা ভালোবাসা হারানোর। অথচ আমরা অনেকেই ভাবি না, এই মায়ের গর্ভে আমার জন্ম, তাঁর সেবা ও ভালোবাসায় আমার বেড়ে ওঠা, তাঁর ছায়া আমার নিরাপত্তা, মায়ের সম্মান আমার সম্মান এবং তাঁর বেঁচে থাকা মানে অযুত প্রার্থনা।
পত্রপত্রিকায় সব ঘটনা ছাপা হয় না। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আমার নিজস্ব সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে মাকে রাস্তাঘাটে ফেলে যাওয়ার ২২৩টি ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবে এমন ঘটনা হয়তো আরও অনেক বেশি ঘটেছে বা ঘটছে। নিম্নবিত্ত মানুষের ঘটনাগুলো হয়তো প্রকাশিত হয়।
এতক্ষণ যা বলেছি, তা অন্য মানুষের ঘটনা। আমাদের পরিবারেই কি আমরা লক্ষ করেছি যে মায়েরা কী খাচ্ছেন? সবাইকে বেড়ে দিয়ে খাওয়ানোর পর মা কী দিয়ে খাচ্ছেন? আচ্ছা, মায়েরা কি কখনো মুরগির রান বা মাংসের ভালো টুকরাটা পেয়েছেন? মাছের মুড়ো বা পেটি? গরম-গরম খাস্তা পরোটা, সঙ্গে একটা আস্ত ডিম ভাজি? জানি না, কারণ, আমরা আদতে কোনো দিন লক্ষ করে দেখিনি যে মা কী খাচ্ছেন? মায়ের খাবারের থালা দেখার মতো সময় বা সুযোগ কোনোটাই পরিবারের অন্য সদস্যদের হয় না।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় নির্ধারিত আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে মায়েদের খাওয়ার যে অভ্যাস দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠে, সেই অভ্যাস তাঁরা কিন্তু পূর্ণ সচ্ছল অবস্থায়ও পরিবর্তন করতে পারেন না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও মায়েরা মাছ বা মাংস দুটো একসঙ্গে খেতে চান না। ভাত খাওয়ার সময় যেনতেনভাবে একটা-দুটো ভর্তা বা ভাজি দিয়ে খেয়ে নেওয়াটা তাঁদের অভ্যাস হয়ে যায়। শুধু নিজে খাবেন বলে কোনো দিন কিছু রান্না করেন না বা নিজের জন্য তুলে রাখেন না। এ জন্য যখন আমাদের সংসারে মাকে অনেক কিছু দেওয়া হয়, তখনো সেটা তাঁরা নিতে পারেন না, তাঁদের সেই পুরোনো অভ্যস্ততার কারণে।
মায়ের শরীরেও পুষ্টি, বিশ্রাম, আরাম ও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে, এগুলো খুব সাম্প্রতিক ও শহুরে ধারণা। আমরা খাওয়ার পর পরিবারে মা, দাদি, চাচি, মামি, খালা কে কী খাচ্ছেন, কী ভাবছেন, কী চাইছেন, আমরা তা তাকিয়েও দেখিনি। সব সময় ভেবেছি, স্বামী-সন্তানদের ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খাওয়ানোর জন্যই মায়েদের জন্ম।
আমাদের সংসারগুলোয় মায়েরা সবচেয়ে বেশি কর্মঠ, দায়িত্ব পালনকারী শক্তি। সন্তানের স্কুলের কাপড়চোপড়, টিফিন থেকে শুরু করে ঠিক সময়ে টেবিলে নাশতা, ভাত সবকিছুর জোগানদার ও পড়াশোনার দায়িত্বে থাকেন মা। বাসায় ৬ জনের জায়গায় ১০ জন মানুষ খেলেও সেই ব্যবস্থা করেন মা। মায়ের সার্ভিস এবং ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো কিছুই হয় না।
সংসারে মায়ের কাজের যে ভার, তা আর কারও কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং বেশি। বাবারা আয় করেন, কিন্তু সেই নির্ধারিত আয়ে সবার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব মায়ের। মায়েদের এসব অদৃশ্য কাজ শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুর যত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্ন নয়, এর সঙ্গে আছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ।
যেহেতু পরিবার ও সমাজে মায়েদের এবং মেয়েদের অবস্থান অধস্তন, তাই বাংলাদেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার। তাঁদের একটা অংশ রীতিমতো অপুষ্ট, ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম। বেশ কয়েক বছর আগে আইসিডিডিআরবি দেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে এ তথ্য দিয়েছে।
যদিও এখন নারীরা বাইরে এসে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। তাই বলে কি সংসারের কাজ কমেছে তাঁদের? বরং দুটি দায়িত্বই তাঁদের বহন করতে হচ্ছে। এখনো খুব সামান্যসংখ্যক নারী নিজের মতো করে, নিজের পছন্দসই খাবার খেতে পারেন। এই আধুনিক সময়ে এসেও আমাদের সন্তানেরা লক্ষ করার সময় পান না, তাঁদের মা কেমন আছেন, কী খাচ্ছেন? প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারছেন কি না?
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন নারীর স্বাস্থ্য রক্ষায় বয়ঃসন্ধিকালসহ সব বয়সে শরীরের প্রয়োজন অনুসারে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই নারীর পুষ্টিহীনতার হার কমে আসবে। কিন্তু সেই পুষ্টি কি নারী পাচ্ছেন? আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে একজন নারী মা হওয়ার সময়ও ঠিকমতো পুষ্টি পান না।
দরিদ্র পরিবারে নারীরা খাবার খুব কম পান। ক্রয়সীমার মধ্যে নেই বলে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অসম্ভব। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে নারী বা মায়ের খাবার গ্রহণ সব সময় উপেক্ষিত থাকে। গ্রামীণ মায়ের খাদ্য গ্রহণ পরিস্থিতি আরও অবহেলিত। গ্রামে মায়েরাই হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালেন, ডিম ফোটান, আঙিনায় মৌসুমি শাকসবজি উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করেন। কিন্তু তাঁর উৎপাদিত পুষ্টি কি তাঁর শরীরের চাহিদা মেটাচ্ছে? তাই মায়েদের জন্য রক্তশূন্যতায় ভোগা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বাতের ব্যথা, খিঁচুনি, পানিস্বল্পতা, জরায়ু সংক্রমণ খুব সাধারণ অসুখ। অতিরিক্ত পরিশ্রম আর পরিমিত পুষ্টির অভাবে অল্প বয়সেই তাঁদের শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। আইসিডিডিআরবি জানিয়েছিল, ৮০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। কারণ, তাঁরা যথেষ্ট খেতে পারেন না।
যদিও দেশে আইন আছে, মা-বাবার ভরণপোষণ না দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু কয়জন মানছেন এই কথা? সরকার বয়স্ক ভাতার প্রসার ঘটিয়ে সেটাকে আরও নারীবান্ধব করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অনেকেই আছেন, যাঁরা সরকার থেকে দেয় এই ভাতা নেওয়ার জন্য মাকে কাছে রাখেন। অথচ টাকা হাতে এলেই আবার উপেক্ষা করেন।
এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও সন্তান, সংসার ও সমাজ নারীকে কম খেতে, কম আনন্দ করতে, কম দাবি জানাতে ও এঁটো-কাঁটা খেতে অভ্যস্ত করে তোলে। এরপর একদিন যখন মা কর্মক্ষমতা হারান, সম্পত্তি হারান, গয়নাগুলো সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেন, তখন এই সংসারেও তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় মাজেদা খাতুন, কোহিনুর বেগম বা ইন্দুবালার মতো। হুমায়ুন আজাদ কবিতায় বলেছেন,
‘আমাদের মা দিন দিন ছোট হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।’
ঠিক তা-ই! মায়েরা ভয় পান সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার, অবহেলা পাওয়ার অথবা ভালোবাসা হারানোর। অথচ আমরা অনেকেই ভাবি না, এই মায়ের গর্ভে আমার জন্ম, তাঁর সেবা ও ভালোবাসায় আমার বেড়ে ওঠা, তাঁর ছায়া আমার নিরাপত্তা, মায়ের সম্মান আমার সম্মান এবং তাঁর বেঁচে থাকা মানে অযুত প্রার্থনা।
শাহানা হুদা, যোগাযোগকর্মী