Site icon The Bangladesh Chronicle

বুকে পাথর চেপে কাঁদছেন স্বজনরা

বুকে পাথর চেপে কাঁদছেন স্বজনরাআলী হোসেনের স্ত্রী ইয়ামনি

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যু দলের কবলে বাংলাদেশি ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজের ২৩ নাবিক ও ক্রু নিয়ে উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কায় স্বজনরা উদ্বিগ্ন। সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেতে কারও মা জায়নামাজে বসে তসবিহ জপছেন তো বাবা ছুটছেন জাহাজটির মালিক কোম্পানির কার্যালয়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বাবার জন্য ব্যাকুল, করছে কান্না। বুকে পাথর চেপে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন মা। দেশের স্বজনের চাওয়া, প্রিয় মানুষ সুস্থ অবস্থায় দ্রুত ফিরে আসুক। এ জন্য সরকার ও জাহাজের মালিক উদ্যোগ নিক।

ক্ষমা করো, হয়তো এটাই শেষ যোগাযোগ

এমভি আবদুল্লাহর দ্বিতীয় প্রকৌশলী তৌফিকুল ইসলাম খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গার করিমনগর এলাকার মো. ইকবাল ও দিল আফরোজা দম্পতির ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। গতকাল বুধবার তৌফিকের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বিমর্ষ মুখে বাবা দোকানে যাচ্ছেন। আলাপকালে বললেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে যোগাযোগ নেই। কপালে কী আছে ওর, আল্লাহই ভালো জানেন। আমার বড় ছেলে ও তৌফিকের শ্যালক মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম গিয়ে জাহাজ কোম্পানির কার্যালয়ে রয়েছে।’

তৌফিকের সাত বছরের মেয়ে তাসফিয়া তাহসিনা ও পাঁচ বছরের ছেলে আহমদ মুসাফি বাবার জন্য কাঁদছে। তাদের জড়িয়ে ধরে কান্না চেপে আছেন তৌফিকের স্ত্রী জোবাইদা নোমান। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তখন সে বাবা-মায়ের সঙ্গেও কথা বলে। সে বলে– ‘আমাদের সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দোয়া করো। হয়তো এটাই শেষ যোগাযোগ, সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ স্বামীসহ জাহাজের সবাইকে উদ্ধারে সরকারের কাছে দাবি জানান জোবাইদা। তৌফিকের মা দিল আফরোজা বলেন, ‘ছেলে ফোন করে জিম্মির কথা জানালে তাকে কয়েকটি দোয়া পড়তে বলেছি। কথা বলার ফাঁকেই দস্যুরা তার ফোন কেড়ে নেয়।’

আল্লাহ বুকের মানিকের প্রাণভিক্ষা দিও

জলদস্যুদের হাতে জিম্মিদের একজন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের ভদ্রঘাট ইউনিয়নের মুকবেলাই চর-নুরনগর গ্রামের নাবিক নাজমুল হক। স্বজনরা জানান, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে লুকিয়ে রাখা মোবাইলে শেষ কথা বলেন নাজমুল।

নাজমুলের কৃষক বাবা আবু সামা শেখ বলেন, ‘একমাত্র ছেলে নাজমুলের আয়ে চলে সংসার। ওর কিছু হলে আমাদের কে দেখবে? মা নার্গিস খাতুন বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে নাজমুল কল দিয়ে দোয়া করতে বলে। এর পর আর খোঁজ পাচ্ছি না। মহান রাব্বুল আলামিন আমার বুকের মানিকের প্রাণভিক্ষা দিও।’

কান্না থামছে না নবপরিণীতার

এমভি আবদুল্লাহর নাবিক বরিশালের বানারীপাড়ার বিশারাকান্দি ইউনিয়নের উমারের পাড় গ্রামের এমাম হোসেনের ছেলে আলী হোসেনের বাড়িতে চলছে আহাজারি। কান্না থামছে না মাত্র কয়েক মাস আগে স্বামীর ঘরে আসা ইয়ামনির। মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে ফোন করে তাকেই প্রথম জিম্মির খবর দেন আলী হোসেন। ইয়ামনি বলেন, ‘কোরবানির ঈদে বাড়ি ফেরার কথা আলীর। দুইজন ঈদ ছুটিতে কী করব, তা নিয়ে পরিকল্পনা করেছি। তাঁর মুখে জিম্মির কথা শোনার পর থেকে চোখে অন্ধকার দেখছি। একটিই চাওয়া, আল্লাহ যেন তাঁকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দেন।’

আলী হোসেনের মা নাসিমা বেগম জায়নামাজে বসে ছেলের জন্য দোয়া-দরুদ পড়ছেন।

মূর্ছা যাচ্ছেন আইয়ুবের মা

এমভি আবদুল্লাহর প্রকৌশলী ক্যাডেট আইয়ুব খানের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের রাখালিয়ায়। মাসখানেক আগে বাবা আজহার মিয়া মারা গেছেন। স্বামীর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে হোমায়রা বেগমের। ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জানার পর বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। জ্ঞান এলেই বুক চাপড়িয়ে আর্তনাদ করছেন।

হোমায়রা বলেন, ‘মঙ্গলবার ইফতার করার সময় আমার ছেলে তার ভাই রাব্বীকে ফোন করে জিম্মির কথা জানায়। সে বলে, টাকা না দিলে মেরে ফেলবে।’ এ সময় মোবাইল ফোনে ছেলের ছবি দেখিয়ে ষাটোর্ধ্ব হোমায়রা কেঁদে বলেন, ‘আইয়ুব, বাবা তুমি কই। আমার মানিক কোথায়? তারে আমার সামনে আনেন। আমি আমার মানিকরে বুকে নেব।’

মুক্তিপণ না দিলে একে একে মেরে ফেলবে

‘আমাদের জাহাজে অ্যাটাক হয়েছে। জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাইকে একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। তারা বলেছে, মুক্তিপণ দেওয়া না হলে একে একে মেরে ফেলবে।’ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম সাইদুজ্জামান মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে স্ত্রী মেহরিমা সাফরিন জামানকে ফোন করে এসব কথা বলেন। এর পর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে বুধবার সকাল ৮টার দিকে ইমুতে একটি ভয়েস রেকর্ড আসে। তাতে একজন বলেন, স্যার ভালো আছেন। সেহরি করে ঘুমাচ্ছেন। কোনো মেসেজ থাকলে এ নম্বরে এসএমএস পাঠাবেন।

স্বামীকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকায় মেহরিমা সাফরিন বলেন, ‘স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু এক বছরের মেয়ে এবং অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে সাহায্যের জন্য কোথাও যেতে পারছি না। সরকার ও জাহাজ কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে আকুতি– আমার স্বামীকে আনার ব্যবস্থা করুন।’

সাইদুজ্জামানের বাবা সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল কাইয়ুম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জাহাজ কোম্পানির গাফিলতির কারণেই জলদস্যুরা আক্রমণ করেছে। কোটি কোটি টাকার মালপত্র বহন করলেও জাহাজে কোনো কোস্টগার্ড নিয়োগ দেয়নি।’ মা কোহিনুর বেগম বলেন, ‘এখন আল্লাহই একমাত্র ভরসা। আল্লাহ যেন সুস্থভাবে আমার ছেলেসহ জাহাজের সবাইকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়।’

বাবা, আর নাও দেখা হতে পারে

জিম্মির খবরে কান্নার রোল পড়েছে ইব্রাহিম খলিল বিপ্লবের ফেনীর  দাগনভুঞার মাতুভুঞা ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামে। আবুল হোসেন ও রৌশন আরা বেগম দম্পতির ছেলে বিপ্লব আট বছর আগে জাহাজটিতে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ নেন।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবুল হোসেন বলেন, মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় ফোন দিয়ে বিপ্লব কান্না করে। সে বলে, ‘বাবা জলদস্যুরা আমাদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। দোয়া করো, হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে।’ এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

কারও গলা দিয়ে খাবার নামছে না

এমভি আবদুল্লাহর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা সদরের ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরোয়া গ্রামে চলছে আহাজারি। মিরাজ আলী ও লুৎফুন্নাহার দম্পতি ছেলের চিন্তায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। রোকনের বোন শাহীমিনা আক্তার জানান, খবর পাওয়ার পর থেকে বাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ। কারও গলা দিয়ে খাবার নামছে না।

রোকনের মা লুৎফুন্নাহার বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘রোকনরে আমার  কোলে ফিরাইয়া দেইন। আরও যারা আছে তাদেরও ফিরাইয়া আনেন। আমার মতোই তার মায়েরাও কানতাছে।’

তারেকুলের বাবার আকুতি

এমভি আবদুল্লাহর থার্ড অফিসার তারেকুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীর ছকড়িকান্দিতে চলছে আহাজারি। সন্তানকে ফিরে পেতে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করছেন স্বজন।

গতকার বুধবার দুপুরে গ্রামের বাড়িতে দেখা যায়, তারেকুলের বাবা দেলোয়ার হোসেন নিবিষ্টচিত্তে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছেন। এক ফাঁকে তিনি সন্তানকে ফিরে পেতে সবার সহায়তা চান। সরকারের কাছে জাহাজের সবাইকে জীবিত উদ্ধারের আকুতি করেন।

২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বরে তারেকুল বিয়ে করেন নাটোরের মেয়ে মোসাম্মৎ তানজিয়াকে। এ দম্পতির এক বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে।

আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন

জলদস্যুদের হাতে জিম্মিদের মধ্যে অন্যতম নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের নাবিক আনোয়ারুল হক রাজু। তিনি উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাস্টার আজিজুল হকের ছেলে। খবর পাওয়ার পর থেকে রাজুর বাড়িতে চলছে আহাজারি।

আজিজুল হক জানান, রাজু সাত বছর জাহাজে কাজ করছে। ছুটি কাটানোর পর চার মাস আগে সে জাহাজে কাজে গেছে। ছেলেকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান তিনি।

samakal

Exit mobile version