Site icon The Bangladesh Chronicle

বি শে ষ সাক্ষাৎকার; ‘মুক্তিযুদ্ধের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না’

বি শে ষ সাক্ষাৎকার; ‘মুক্তিযুদ্ধের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না’

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক গবেষক বি জেড খসরু নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দ্য ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদকতার মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস : বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার-হাউ ইন্ডিয়া, ইউএস, চায়না অ্যান্ড দ্য ইউএসএসআর শেইপড দ্য আউটকাম দ্য মিলিটারি ক্যু অ্যান্ড দ্য সিআইএ লিংক শীর্ষক বই দুটি পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃতঢাকায় সম্প্রতি বি জেড খসরুর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ হালিম শফিক রহমান

আপনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন। দেশে সেই অর্থে আপনার পরিচিতি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লেখার পর দেশে-বিদেশে আপনি ব্যাপক পরিচিতি পেলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার চিন্তা হঠাৎ করেই, নাকি পরিকল্পনায় ছিল?

শুরুতে আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিংবা কোনো বই লেখার কথা চিন্তা করিনি। আমি মূলত জানতে চেয়েছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমান যে নিহত হলেন, এর নেপথ্যে কে বা কারা জড়িত ছিল। তিনি যখন নিহত হন, তখন আমি দেশে ছিলাম। বিদেশে যাওয়ার আগে শুনে গিয়েছিলাম, এই ক্যুর পেছনে সিআইএ জড়িত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে যখন পড়তে গেলাম, তখন মনে হলো, এখন বিষয়টি খুঁজে দেখার সুযোগ এসেছে, আসলেই সিআইএ জড়িত কি না। তখন আমি খুঁজতে শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পরিচিত বাঙালি শিক্ষার্থী চট্টগ্রামের মাহফুজুর রহমান বললেন, ‘এমআইটির শিক্ষক মাইনের ওয়াইনার, তিনি দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, তুমি তার কাছে যাও, তিনি জানতে পারেন।’

ওই শিক্ষকের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন কি না, সিআইএ সত্যি শেখের ক্যুর সঙ্গে জড়িত ছিল কি না। তিনি বললেন, এখন পর্যন্ত সিআইএর জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। তবে ২৫ বছর পরে ডকুমেন্টস উন্মুক্ত হলে দেখা যেতে পারে, আসলেই সিআইএর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ কতটা সত্য। পড়াশোনা শেষ করে বোস্টন থেকে আমি নিউইয়র্কে চলে আসি। মাঝেমধ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরোনো ম্যাগাজিন, পত্রপত্রিকা খুঁজতাম, কোনো ক্লু পাওয়া যায় কি না। ইন্টারনেট আসার পর ২০০০ সালের আগে অথবা পরে একটা ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট পেয়ে গেলাম। ওটার ভেতরে নিক্সন ও চৌ এন লাইয়ের কথোপকথন ছিল, বাংলাদেশকে চীন স্বীকৃতি দেবে কি না, তা নিয়ে। এভাবে ইন্টারনেট থেকে প্রচুর তথ্য পেতে থাকি এবং এ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাও করতাম।

কবি শহীদ কাদরী একদিন বললেন, ‘তুমি যা জানতে পারছ, তা খুবই ইন্টারেস্টিং। বাংলাদেশের জনগণও এসব জানতে চাইবে। তুমি এসব নিযে বই লেখো।’ তখন আমি লেখা শুরু করি। এভাবেই লিখে ফেলি প্রথম বই মিথ অ্যান্ড ফ্যাক্টস, বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার : হাউ ইন্ডিয়া, ইউএস, চায়না, ইউএসএসআর সেভ দ্য আউটকাম। এত তথ্য আমার সংগ্রহে এল যে একটা বইয়ে সব দেওয়া সম্ভব নয়, তখন ভাগ ভাগ করে অন্য বইয়ের কথা চিন্তা করি এবং লিখে ফেলি দ্য বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু অ্যান্ড দ্য সিআইএ লিংক।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশে প্রচুর বই বেরিয়েছে, যার বেশির ভাগ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রশংসায় ভরপুর। আপনি এসব বই পড়েছেন? পড়ে থাকলে কী মনে হয়, এতে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়?
অনেকের বই পড়েছি। আমার মনে হয়েছে, এরা অনেকে লিখেছে অন্ধের হাতি দেখার মতো করে। যে হাতির পা ধরে সে মনে করে হাতি হচ্ছে খুঁটির মতো। যে লোক কান ধরে, তার কাছে হাতি হচ্ছে কুলার মতো। আর যে দাঁত ধরে, সে মনে করে হাতি হলো লাঠির মতো। আসলে তো হাতি এসবের কোনোটাই নয়। সুতরাং  মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খ-িত ইতিহাস লেখা হয়েছে।

একাত্তরে মুষ্টিমেয় বাদে বাঙালিরা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আপনি কি এটাকে গণযুদ্ধ বলবেন?

আমি থিওরি নিয়ে কাজ করি না। সুতরাং ওভাবে বলতে পারব না। সাংবাদিক হিসেবে বলতে পারি, যুদ্ধটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে এর জন্য কোনো রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছিল বলে আমার কাছে মনে হয় না। যুদ্ধটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার কাছে এত বছর পরেও মনে হয়, যদি পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ আক্রমণ না করত, এত লোককে হত্যা না করত, তাহলে ইতিহাস অন্য রকম হতো। হয়তো যুদ্ধটাই হতো না। পাকিস্তান ধ্বংস হয়েছে মূলত ২৫ মার্চ রাতেই।
সাড়ে চার দশকজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক মিথ তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু মিথ ভেঙ্গেও পড়ছে। এখনো অনেক সত্য প্রকাশ হয়নি বলে মনে করেন?

আমি কয়েক হাজার ডকুমেন্টস দেখেছি। যেগুলো বিতর্কিত মনে হয়েছে, সেগুলো বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখনো অনেক বিষয় নিশ্চয়ই বাকি। যেমন আমি অনেক দিন থেকে ভেবেছি, শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ভেঙে গেল, কিন্তু কেন? কী কারণে ভেঙে গেল, কী হয়েছিল?

আপনি কি কারণটা খুঁজে পেয়েছেন?

হ্যাঁ, অনুসন্ধান করতে করতে পেয়ে গেছি। ড. কামাল হোসেন জীবিত আছেন। তিনি তো জানেন। ঘটনাটা হচ্ছে, ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ ও ইয়াহিয়ার মধ্যে চুক্তি হয়েছিল, ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ইয়াহিয়া ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকবেন। পাকিস্তান আর্মি প্রথমে এর বিরোধিতা করে। কারণ, মুজিবের দাবি ছিল মার্শাল ল তুলে নিতে হবে। আর্মির যুক্তি হলো, মার্শাল ল তুলে নিলে ইয়াহিয়ার রাষ্ট্রপতি পদে থাকার আর লিগ্যাল বেসিস থাকবে না। বৈঠকে এমনও প্রস্তাব করা হয়, ইয়াহিয়া একটা ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৬২ সালের আইয়ুবের সংবিধান আবার পুনর্জীবিত করবেন। ওই সংবিধান অনুযায়ী ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং শেখ মুজিব হবেন প্রধানমন্ত্রী। এ অনুযায়ী সংসদ বসবে, সেই সংসদ ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করবে।

আপনি এই যে তথ্য দিলেন, কার রেফারেন্সে বললেন? কোথায় এসব পেয়েছেন?

ড. কামাল হোসেনও তো এসব বলেছেন। শেখ মুজিব জীবিত থাকাকালে সম্ভবত ১৯৭৩-৭৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে কামাল হোসেন লিখেছেন। কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে দেওয়া ড. কামাল হোসেন ইন্টারভিউতেও এ কথা বলেছেন। মার্কিনিদের ডকুমেন্টসেও একই কথা বলা রয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিব ব্রিটেনে যান এবং হিথের সঙ্গে দেখা করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আই ওয়াজ সারপ্রাইজড। দে অ্যাটাক্টড আস। আই হ্যাড অ্যান অ্যাগ্রিমেন্ট উইথ ইয়াহিয়া খান।’

২৫ মার্চ ড. কামাল হোসেন একটি টেলিফোন কলের অপেক্ষায় ছিলেন, সে ব্যাপারে আপনার অনুসন্ধানে কোনো তথ্য মিলেছে?

২৪ মার্চ দুপক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়েছিল। কথা ছিল জেনারেল পীরজাদা পরদিন টেলিফোনে ড. কামাল হোসেনকে জানালে শেখ মুজিব যাবেন এবং মুজিব-ইয়াহিয়া দুজনে সমঝোতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন।
একাত্তরের যুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বর্তমানে প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে তুমুল বিতর্ক চলছে, বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এখন যে বিতর্ক হচ্ছে আমি মনে করি এটা অপ্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের উচিত সামনে এগিয়ে যাওয়া। যারা বিতর্ক করছেন, তারা অকারণে সময় নষ্ট করছেন।

রাজনীতিকেরা না হয় অকারণেই বিতর্ক করছেন, কিন্তু গবেষকদের তো দায়িত্ব, কর্তব্য সত্যটা উদ্্ঘাটন করা

সত্যটা হচ্ছে, তিন মিলিয়ন মারা গেছে বলে যে দাবি করা হয়, এর যেমন কোনো ডকুমেন্টস নেই, তেমনি আসলে কত লোক মারা গেছে, তারও কোনো সত্য ডকুমেন্টস নেই। পাকিস্তান বলে এক রকম, ভারত বলে আরেক রকম। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। সুতরাং মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা বলা মুশকিল।

আপনি কি মনে করেন, আইন করে এই বিষয়গুলোর ফয়সালা করা সম্ভব?

সত্যকে সবার স্বীকার করে নেওয়া উচিত। শেখ মুজিব ছিলেন স্বাধীনতার নেতা। তিনি বাঙালিদের সংগঠিত করেছিলেন। তার অবদান খাটো করা যাবে না। তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তার যা প্রাপ্য, তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হলে সেটাই হবে তার জন্য যথেষ্ট।

আইন করে কখনোই এই বিতর্কের সমাধান করা যাবে না। অনেকে বলেন, ইতিহাসকে বিকৃত করা যায়। আমি বলব, ঘটনা বিকৃত করা যায় না। ইতিহাস থাকবে ইতিহাসের জায়গায়।

Exit mobile version