Site icon The Bangladesh Chronicle

‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা নিকৃষ্ট সংগঠন ফ্যাসিস্টিক কালচারের চর্চা করছে’

ওয়েবিনারে বক্তাদের অভিমত
 আমার দেশ
৩০ এপ্রিল ২০২৩

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিনিধি

ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের উদ্যোগে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা বলেছেন, একটা ফ্যাসিস্টিক কালচার পুরো সমাজ জুড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়ে জারি হয়েছে এবং একটা নিকৃষ্ট সংগঠন বারবার করে সেই কালচারের চর্চা করে যাচ্ছে। হলের সিট কে দেবে সেটাও প্রভোস্টের নিয়ন্ত্রণে এখন আর নেই। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আরো বেশি সোচ্চার হওয়া দরকার। যেনো তারা ন্যায্য অধিকারের ক্ষেত্রে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দাঁড়াতে পারে।

রবিবার (৩০ এপ্রিল) বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশী শিক্ষানুরাগীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অংশ নেন।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় অংশ নেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন এবং ২০০৩ সালের শিক্ষা কমিশনের মেডিকেল শিক্ষক উপকমিশনের সদস্য প্রফেসর ডা মো. সাইফুল ইসলাম, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মোশতাক হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব এডুকেশনের প্রফেসর ড. ওবায়দুল হামিদ, ড. বদিউল আলম মজুমদার, প্রফেসর নিয়াজ আসাদুল্লাহ প্রমূখ।

“বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন” শীর্ষক ওয়েবিনারে দীর্ঘ বক্তব্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন ছাত্রলীগের নষ্ট রাজনীতির কুখ্যাত দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ভায়োলেন্সের কাঠামোগত রূপান্তর হয়েছে। ৯০ এর দশকে সহিংসতায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিলো না। বিভিন্ন সংগঠন ছিলো। তাদের ভয় ছিলো। সংঘাত হতো বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে। ২০০৬ সালে বিএনপির পরাজয়ের পর হলগুলো থেকে বিএনপির ছাত্র সংগঠন বেরিয়ে গেলো। অন্য সংগঠন এলো। এই বাস্তবতা আগে ছিলো না।

তিনি বলেন, এরপরের চিত্র আরো অদ্ভুত। বিভিন্ন হলগুলোতে ইন্টারোগেশনের ব্যবস্থা থাকছে। বিশেষত, তার (শিক্ষার্থীদের) পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি নিয়ে। যেটা আবরারের (বুয়েট ছাত্র, যাকে ছাত্রলীগ রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করে) ঘটনার ক্ষেত্রে উলঙ্গভাবে, নেকেডলি আমাদের চোখের সামনে উঠে এলো। যেখানে (সেই ঘটনায়) দেখলাম, একজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশের সীমানা, আমাদের সীমানার মধ্যে কী ঘটবে, পানির অধিকার কতটুকু আমরা পাব, নদীর হিস্যার কথাগুলো বলেছে। সেই কথাগুলোর কারণেই তাকে শিবির ট্যাগ দেয়া হলো … এবং এই শিবির ট্যাগ দেয়ার চর্চাটা মূলত আগে থেকেই চলছিল।

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা কোটা মুভমেন্টের সময়ও দেখেছি। ছাত্র অধিকার সংগঠনের সাথে জড়িতদেরকেও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে হয়রানি করা হয়েছে এবং ভায়োলেন্টলি পেটানো হয়েছে। এবং মামলা দেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, বারবার করে। অনেক সময় তারা প্রোপার চিকিৎসাটুকুও পায়নি।

রাজশাহীতে এমন একটি ঘটনার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ছাত্র-অধিকারের একজনকে হাতুড়ি দিয়ে পা ভেঙ্গে দেয়ার পর হামলাকারীরা সাংবাদিকদের কাছে এসে বলে ভাই আমাদের নামটাও দিয়ে দেন। যাতে বড় লিডার দেখতে পারে।

তিনি বলেন, (ছাত্রলীগ) ভায়োলেন্স করছে এটাই তার একটা ক্রেডিটের বিষয়। এরপর আমরা ওই ঘটনার প্রটেস্ট করলাম। চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। তখন ভিসি আমাদেরকে বামঘরানার শিবির হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। ভায়োলেন্সের এই যে একটা স্ট্রাকচার… একদিনে ভায়োলেন্স হচ্ছে একই সাথে ব্যাড নেইম দেয়া হচ্ছে। বিশেষ রকমের ট্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। এবং সেটাকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে যে এই কারণে তাকে ধরা যায়, এই কারণে তাকে মারা যায় পুলিশে দেয়া যায়। অনেক ঘটনা আছে যেখানে ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক , প্রভোস্ট ছাত্রদেরকে ধরে ধরে পুলিশে দিয়েছে। পেটানোর পর আবার মাফ চেয়েছে। এই ঘটনাগুলো বারবার করেই হচ্ছে। আমরা এই পুরো স্ট্রাকচার দেখলে বুঝি,, একটা ফ্যাসিস্টিক কালচার সবগুলো ক্যাম্পাসে জেঁকে বসেছে। এবং যেটা আসলে রিফ্লেকশন অব হোল সোসাইটি। পুরো সমাজেরই একটা প্রতিফলন আমরা দেখতে পারছি। এবং ক্যাম্পাসে এই কালচারটা কেন টিকিয়ে রাখা হয় সেই প্রশ্নটাও বোধহয় আমাদের সিরিয়াসলি দেখা দরকার। বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন যতদিন স্ট্রিট ভায়োলেন্সের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে … মানে রাস্তায় বলপ্রয়োগ, রাস্তায় দখল নেয়া .. রাস্তা দখলের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে .. মানে তথাকথিত এই গণতান্ত্রিক স্ট্রাকচারের মধ্যে ততদিন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভায়োলেন্স থামানো যাবে না। নিপীড়নগুলো থামানো যাবে না। এছাড়া, ২০০৬-০৭ সালের পর থেকে আরেকটি পরিবর্তন দেখেছি.. যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নির্বাচনের যে প্রক্রিয়া ছিলো… গণতান্ত্রিক পরিবেশটা ছিলো অন্তত…সারা বাংলাদেশে না থাকলেও ক্যাম্পাসগুলোতো ততদিন অটুট ছিলো। সেটাও কিন্তু, পরে আর থাকেনি। বরং, শুধু স্থানীয় মেয়রও যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে তা খুবই লজ্জাজনক এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট উপযোগী।

তিনি বলেন, এই একই সময়ে আমরা আরেকটি জিনিস দেখবো যে, প্রচুর পরিমাণে ফান্ড এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য .. নানারকম (ফান্ড)। এবং সেগুলো হলো ফিজিক্যাল নানারকম ডেভেলপমেন্টের প্রজেক্ট। এই তিনটি বিষয়ে… বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে গণতান্ত্রিক চর্চায় ফেইলর হচ্ছি আমরা, এই প্রজেক্টগুলোর উদ্দেশ্য নানাভাবে মিসইউজ হচ্ছে, এবং একটা ফ্যাসিস্টিক কালচার যেটা পুরো সমাজ জুড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়ে জারি হয়েছে এবং একটা নিকৃষ্ট সংগঠন বারবার করে সেই কালচারের চর্চা করে যাচ্ছে। হলের সিট কে দেবে সেটাও প্রভোস্টের নিয়ন্ত্রণে আর থাকেনি। গত অন্তত দশ বছরে। আমরা স্টুডেন্টদের অসংখ্যবার হলে উঠিয়ে এসেছি। কিন্তু পরে আবার তাদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত ঘটছে। এবং প্রশাসন চুপচাপ থেকেছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আরো বেশি সোচ্চার হওয়া দরকার। যেনো তারা ন্যায্য অধিকারের ক্ষেত্রে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দাঁড়াতে পারে।

ওয়েবিনারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন স্পষ্টভাবে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে বিষয়টি উপস্থাপন করেন।

সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহিংসতা একটি বাস্তবতা এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। এবং এসব যেন এখন একেবারেই জীবনযাত্রার অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যে একাডেমিক পরিবেশের কথা ভাবা হয়, সেটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহুদিন নেই। পাকিস্তান আমলে এনএসএফ ছিলো কুখ্যাত এক গৌণ ধারা। কিন্তু, এটা এখন মূল ধারা।

ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, প্রান্তিক যে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এটাকে সমর্থন করার কোনো কারণ নাই।

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ছাত্ররাজনীতি ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকায় ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, একটা পশ্চাদমুখী পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আটকে আছি। এটা একটা চোরাবালির মতো। আমরা যতোই চাচ্ছি বের হতে, পারছি না।

Exit mobile version