Site icon The Bangladesh Chronicle

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা : আদানি গ্রুপকে কাজ দিলেই ‘বিপদ’

 নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম

গৌতম আদানি
শেয়ারবাজার কারসাজি ও জালিয়াতির খবর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন দেশ এখন আদানি গ্রুপকে নতুন করে কাজ দেওয়ার বেলায় সতর্কতা অবলম্বন করবে বলে জানিয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতসহ যেকোনো খাতে আদানিকে নতুন করে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, প্রতারণার অভিযোগ ওঠা এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক দরপতনের পাশাপাশি ভারতের ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বন্দরের জেটি ও টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আদানি গ্রুপ। এসব কাজ আদানি গ্রুপকে দেওয়া হলে বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকট আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সংকটে পড়তে পারে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাত।

অভিযোগ উঠেছে, আদানি গ্রুপ স্টক ও হিসাবের বিষয়ে জালিয়াতি করে সম্পদের পরিমাণ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ ও যাবতীয় যুক্তি নাকচ করে দিয়েছে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।

আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের শেয়ারবাজার কারসাজি, অর্থপাচার, আর কর ফাঁকির অভিযোগের পর এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে ধস নেমেছে। এরই মধ্যে তাঁর সম্পদ কমেছে ১৩.১ বিলিয়ন ডলার বা ১৪.৮৫ শতাংশ। এতে বিশ্বের বিলিয়নেয়ারদের তালিকায় গৌতম আদানির অবস্থান নেমে এসেছে ১৫তম স্থানে।

বিদ্যুৎ খাতে শঙ্কা : বাংলাদেশে বিদ্যুত্সংকট মোকাবেলায় বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সরকার যে চুক্তি করেছে, এতে একতরফা লাভবান হবে আদানি গ্রুপ। এ ছাড়া অতিরিক্ত মূল্য প্রদানের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানি গ্রুপকে একতরফাভাবে লাভবান করতেই এই চুক্তি করা হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতির সংকটের সময়ে আদানির বিদ্যুৎ ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ বাড়াবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা এম শামসুল আলম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিতে একতরফাভাবে আদানিকে লাভবান করা হয়েছে। এই চুক্তি অস্বচ্ছ ও জনস্বার্থবিরোধী। এটি জাতীয়ভাবে অগ্রহণযোগ্য।’

এ ছাড়া বাংলাদেশের ভোজ্য তেল খাতে আদানি গ্রুপের বড় বিনিয়োগ আছে। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা), সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও আদানি গ্রুপ মিলে ‘আদানি উইলমার নামে’ এই যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ জোন নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে আদানি গ্রুপ। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও চোখ পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এ ছাড়া চালের বাজার ও রাইস ব্র্যান অয়েলের বাজারেও একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তারা।

বাংলাদেশে বন্দরের জেটি ও টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আদানি গ্রুপ। এসব কাজ আদানি গ্রুপকে দেওয়া হলে বাংলাদেশে চলমান ডলার সংকট আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সংকটে পড়তে পারে আমাদের পুরো ব্যাংকিং খাত।

অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদানি গ্রুপসহ এখন থেকে যেকোনো বিদেশি কম্পানিকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সরকারকে।’

চট্টগ্রাম বন্দরেও ঢুকতে চায় আদানি গ্রুপ : চট্টগ্রাম বন্দরেও বিনিয়োগ করতে চায় বিতর্কিত আদানি গ্রুপ। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল ভারতের আদানি গ্রুপের। এর মধ্যে একটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা। দ্বিতীয়টি, সাগর উপকূলজুড়ে প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল প্রকল্প। কিন্তু দুটি প্রস্তাবের কোনোটিরই অনুমোদন পায়নি আদানি গ্রুপ। এতে এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ বা কাজ করছে না ভারতভিত্তিক এই গ্রুপ।

২০২২ সালে ভারতের সবচেয়ে বড় বেসরকারি মুদ্রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয় আদানি গ্রুপ। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকল্পে এখন পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ নেই আদানি গ্রুপের। বে টার্মিনালে বিনিয়োগ প্রস্তাব আছে কিন্তু সেটি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে।’

যেহেতু আদানি গ্রুপ নিয়ে একটি কেলেঙ্কারি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে, তাই আদানির প্রস্তাবগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গেই বিবেচনা করে এগোনোর দাবি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীদের।

বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকিএমইএ) পরিচালক শামসুল আজম বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখলাম বিদ্যুৎকেন্দ্র, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বেশ কিছু প্রকল্পে আদানি গ্রুপ যুক্ত। আসলে এমন পরিস্থিতিতে প্রথমত সরকারকে সতর্ক হতে হবে। তারা যদি না-ই পারে সে ক্ষেত্রে সরকারকে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করতে হবে।’

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল হাসান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আদানি গ্রুপের সার্বিক অবস্থা যদি খারাপ হয়, তাহলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হব। সে ক্ষেত্রে সরকারকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে।’

আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা : বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পটির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। মামলা করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলার ৩০ জন কৃষক এবং মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিডিআর)। গত মঙ্গলবার মামলাটি করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ফারাক্কায় বড় সংঘর্ষ-সংঘাত হয় ২০২২ সালের জুলাই মাসে। ফারাক্কার বেনিয়াগ্রাম ও ইমামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা প্রধানত বিক্ষোভ দেখান। তাঁরা আদানির প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেন।

Exit mobile version