Site icon The Bangladesh Chronicle

বিনিয়োগ কমছে পুঁজিবাজার নিয়ে শঙ্কা

mzamin

টানা দরপতনের বৃত্তে দেশের পুঁজিবাজার। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুঁজিবাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও সেই পুরনো দরপতনের ধারায় আটকে গেছে পুঁজিবাজার। প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। নতুন বিনিয়োগ আসছে না। অব্যাহত দরপতনের কারণে তাদের লোকসানের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে শেয়ারবাজারে ক্রেতা সংকট তত প্রকট হচ্ছে। কয়েক কার্যদিবস উত্থান দেখা গেলেও পতনের চিত্রই বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে। ডিএসইতে লেনদেন ৩০০ কোটির ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে প্রকট হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। লোকসান কাটিয়ে ওঠার কোনো পথই যেন পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বর্তমান পতনের পেছনে বড় কোনো কারণ নেই। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অর্থনৈতিক নানা প্রতিবন্ধকতা এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় মন্দা পরিস্থিতি ঘনীভূত হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তি শ্রেণি এবং বিদেশি সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা হতাশ। কবে নাগাদ বাজার ভালো হবে এ অপেক্ষার প্রহর গুনছেন বিনিয়োগকারীরা।

এমন বাস্তবতায় মধ্যেই পুঁজি রক্ষার দাবি নিয়ে মতিঝিলের রাস্তায় সমাবেশ করছেন শেয়ারবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর এসোসিয়েশনের (বিসিএমআইএ) ব্যানারে সমাবেশ করছেন তারা। সোমবার আড়াইটার দিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পুরনো ভবনের সামনে এই সমাবেশ করেন তারা। এতে প্রায় হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী উপস্থিত ছিল।

সূত্র মতে, শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতন দেখা দিলে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে মতিঝিলে সমাবেশের ডাক দেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীরা এই সমাবেশের ডাক দেয়ার পর রোববার থেকে শেয়ারবাজারে লেনদন ও মূল্য সূচক বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। আর সোমবার শেয়ারবাজারে লেনদেন শেষ হওয়ার পর ডিএসই’র পুরনো ভবনের সামনের রাস্তায় সমাবেশ শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। সমাবেশ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ তাৎক্ষণিক ১১টি দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

সমাবেশে রাজনৈতিক নেতারা: সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি মো. নুরুল হক নুর, বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ, মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থ সম্পাদক মো. দিদারুল আলম ভূঁইয়া।

সংগঠনের প্রধান মুখপাত্র মো. নূরুল ইসলাম মানিক বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে ৯৯ শতাংশ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত। এসব বিনিয়োগকারীর পুঁজি রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান নেতৃত্ব কোনো ভূমিকা রাখছে না। বরং তারা যেন শেয়ারবাজার ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিল আওয়ামী লীগের আমলে যে লুটতরাজ হয়েছে, সব কিছু পুষিয়ে আমরা লাভের দিকে যাবো। বিরাট পরিবর্তন হবে, এটাই আশা ছিল। সেটাই হচ্ছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থায় এমন লোকদের দায়িত্ব দেয়া হলো যারা বিনিয়োগকারীদের ধ্বংস থেকে আরও ধ্বংস করছেন। ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট পর্যন্ত যা হয়েছে, গত পাঁচ মাসে তার থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পাঁচ মাসে ৬৬ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে গেছে। তাই পুঁজি রক্ষার্থে এবং আগামীর বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও একটি সুন্দর পুঁজিবাজার গঠনে মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে।

আন্দোলনের হুমকিতে ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজার: দেশের শেয়ারবাজারে লুটতরাজ চলছে এমন অভিযোগের প্রতিবাদে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিসিএমআইএ। বিনিয়োগকারীদের আন্দোলনের ঘোষণা দেয়ার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের শেয়ারবাজার।

বাজার বিশ্লেষণ: পুঁজি রক্ষার দাবিতে বিনিয়োগকারীরা আন্দোলনে নামার পর দেশের শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। আগের কার্যদিবসের ধারাবাহিকতায় সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। এতে বেড়েছে সবগুলো মূল্যসূচক ও লেনদেনের পরিমাণ। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকে লেনদেনের শেষ পর্যন্ত। অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে। ফলে এ বাজারটিতেও মূল্যসূচক বেড়েছে। তবে সিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। সোমবার দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে ২১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১১৩টির। আর ৬৭টির দাম অপরিবর্তিত ছিল। এতে ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ১৯ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ১৪৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসই শরিয়াহ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৩ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ১৩৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এদিকে দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৩১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩৫৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সে হিসাবে আগের কার্যদিবসের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ৭৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অন্য শেয়ারবাজার সিএসই’র সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই বেড়েছে ৩১ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেয়া ২০৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০০টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৬৯টির এবং ৩৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

বিনিয়োগকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন আশায় থাকি বাজার ভালো হবে। কিন্তু প্রতিদিনই বাজারে দরপতন হচ্ছে। এভাবে আর কতো দিন চলবে। একটি দেশের পুঁজিবাজার এভাবে চলতে পারে না। আর আমাদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। এরই মধ্যে বিনিয়োগ করা পুঁজির প্রায় ৮০ শতাংশ উধাও হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বাজারকে বাজারের গতিতে চলতে দেয়াই এখন কমিশনের প্রধান লক্ষ্য। একদিন সূচকের ব্যাপক উত্থান হলো, আরেকদিন কমলো; এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থেকে বাজারকে রক্ষা করতে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। বাজার সংস্কার প্রসঙ্গে রেজাউল বলেন, টাস্কফোর্স পুরোদমে কাজ করছে। টাস্কফোর্সের কাজের সুবিধার্থে ফোকাস গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। বাজারে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানকল্পে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিনিয়োগকারীদের ১১ দাবি: বিএসইসি’র চেয়ারম্যান ও আইসিবি’র চেয়ারম্যানকে দ্রুত অপসারণ করে নতুন যোগ্য চেয়ারম্যান নিয়োগ করে পুঁজিবাজার বাঁচাতে হবে। বর্তমান মার্কেট পরিস্থিতির কারণে গেইন-ট্যাক্স সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। বর্তমান মার্কেট পরিস্থিতির কারণে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে (তদন্ত ও অসময়ে জেড গ্রুপে প্রেরণ ইত্যাদি)। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর বিধান সংস্কার করা প্রয়োজন। কারণ কোম্পানির জেড ক্যাটাগরিতে গেলে সর্বোপরি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। কোম্পানিগুলোকে আয়ের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে। ব্যাংক, ফাইন্যান্স, ইন্স্যুরেন্স, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও আইসিবিসহ পুঁজিবাজারে তাদের যতটুকু বিনিয়োগ করার কথা, তা শতভাগ কার্যকর করতে হবে। টাস্কফোর্সের সংস্কারগুলো মিডিয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের দ্রুত জানাতে হবে। সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করে বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশ অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। বিএসইসি’র দায়িত্ব অন্তত ১০টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার বিনিয়োগ নিয়ে আসা। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি পরপর দুই বছর লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হলে তার বোর্ড পুনর্গঠন করতে হবে ও ফোর্স সেল বন্ধ করতে হবে।

Exit mobile version