Site icon The Bangladesh Chronicle

বিদ্যুতে ভর্তুকি বকেয়া পড়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা!

 জ্বালানি তেল ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধিতে গত দুই বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। তা সামাল দিতে কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে বাল্ক বিদ্যুতের মূল্যহার। এরপরও গত দুই অর্থবছর রেকর্ড লোকসান দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সে ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাহিদাও বেড়েছে। তবে দুই অর্থবছর ধরে চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়।

চলতি অর্থবছর শুরুর দিকে ছাড় করা হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরের ভর্তুকি। বর্তমানে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ভর্তুকি ছাড় শুরু করা হয়েছে। এতে অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তুকি বকেয়া পড়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের আংশিক ভর্তুকি বকেয়া রয়েছে। আর গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ মাসের পুরো ভর্তুকি বকেয়া পড়েছে।

বকেয়া ভর্তুকি জমতে থাকার প্রভাব পড়েছে পিডিবির আর্থিক অবস্থার ওপর। বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে সংস্থাটি। ফলে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এতে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য পিডিবি ভর্তুকি চেয়েছে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রায় পাঁচ মাস পেরুলেও তার অর্ধেকও ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ভর্তুকি ছাড় করা হয়েছে ১২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের চাহিদার বিপরীতে এ অর্থ ছাড় করা হয়েছে। যদিও ওই মাসে ভর্তুকি চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরের ভর্তুকিই বকেয়া রয়ে গেছে এক হাজার ১৯৫ টাকা।

জুলাইয়ের চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি ছাড় করেছে চার হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। আগস্টের চার হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি ছাড় করেছে চার হাজার ৪৫ কোটি টাকা। আর সেপ্টেম্বরের চার হাজার ৪৮০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি ছাড় করেছে চার হাজার ৪০ কোটি টাকা।

এর বাইরে গত অর্থবছরের ৯ মাসের (অক্টোবর-জুন) পুরো ভর্তুকি বকেয়া রয়েছে, যার পরিমাণ ২৯ হাজার ১৩৯ টাকা। এর মধ্যে অক্টোবরের চাহিদা তিন হাজার ৮৬২ কোটি টাকা, নভেম্বরের তিন হাজার ৩৭৯ কোটি, ডিসেম্বরের তিন হাজার সাত কোটি, জানুয়ারির দুই হাজার ৬৬৪ কোটি, ফেব্রুয়ারির দুই হাজার ৮৪৮ কোটি, মার্চের তিন হাজার ৩৭ কোটি, এপ্রিলের তিন হাজার ৯০৬ কোটি, মে মাসের তিন হাজার ৪৬৪ কোটি এবং জুনের দুই হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরের ভর্তুকি বকেয়া রয়েছে ৩০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ভর্তুকির এ-সংক্রান্ত চাহিদাপত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সাড়া মিলছে না।

এদিকে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ভর্তুকি চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাইয়ের চাহিদা তিন হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, আগস্টের তিন হাজার ১৪০ কোটি, সেপ্টেম্বরের তিন হাজার ১০১ কোটি ও অক্টোবরের দুই হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছরের ভর্তুকি এখনও ছাড় না করায় চলতি অর্থবছরের চাহিদাপত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। সব মিলিয়ে মোট বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে বিদ্যুতের ভর্তুকি ছাড়ে বিলম্ব শুরু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর প্রভাব পড়ে পরের অর্থবছর। এভাবেই ক্রমেই বকেয়া বেড়ে চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়েছিল আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এতে আগের অর্থবছরের ঘাটতি ভর্তুকি ২০২১-২২ অর্থবছর পরিশোধ করা হয়।

ওই অর্থবছর পিডিবির ভর্তুকি চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেয় ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। এতে ওই অর্থবছরের ভর্তুকি আবারও জমে যায়, যা পরের অর্থবছর ছাড় করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছর ভর্তুকি চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। অথচ এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা। এতে গত অর্থবছরের জমে যাওয়া ভর্তুকি চলতি অর্থবছর পরিশোধ করতে হচ্ছে।

এদিকে চলতি অর্থবছর ৩৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দরকার হবে। তবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। এতে চলতি অর্থবছর শেষে বকেয়া ভর্তুকি আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। যদিও এ বিষয়ে কেউ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভর্তুকি ছাড় দ্রুত করা ও বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য নিয়মিতই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে তাতে উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হয়নি। এতে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল জমে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে বিদ্যুৎ খাতে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।

যদিও বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে ভর্তুকি তুলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিভিন্ন সময়ে এ দুই খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়ার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের মধ্যে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভর্তুকি কমিয়ে আনতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথাও জানানো হয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে।

শেয়ার বিজ

Exit mobile version