প্রিয় ড. মোমেন,
আমি এই চিঠি লিখছি,গত ৩১শে মে,২০২০ এ ভারতীয় সাপ্তাহিক ‘দ্য উইকে’ প্রকাশিত আপনার একটি সাক্ষাতকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, যা আমাদের পারস্পারিক বন্ধুমহল এবং দেশে-বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের কাছে ভিত্তিহীন,আপত্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণকারী বলে মনে হয়েছে, যেটি রাষ্ট্রের প্রধান কূটনৈতিক বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আপনি প্রতিনিধিত্ব করেন। অতপর,এই খোলা চিঠি।
সঞ্চালক রবি ব্যানার্জীর শেষ প্রশ্নের জবাব ছাড়া,আপনার সাক্ষাতকারের বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। যেখানে আপনি,“মুজিবুর রহমানের সাথে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?” এই প্রশ্নের জবাবে বলেছেন,“আমি তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে(১৯৭০’এ) একটি গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে যাই(যার পর তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন)।আমি তার দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজের দেখাশোনা করতাম। স্বাধীনতার পর একজন জ্যেষ্ঠ আমলা হিসেবে আমি তার সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। আমি তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিসেবে আবিষ্কার করি।”
আমি আপনাকে ষাটের দশকের শেষদিক থেকে চিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন(এনএসএফ)’র একজন সহ-সদস্য ও অফিসধারণকারী একজন কর্মী হিসেবে আমি জানি, ১৯৬৮ সালে ইসলামাবাদ যাবার আগ পর্যন্ত, আপনি আইয়ুবপন্থি ছাত্র সংগঠন এনএসএফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এসএম হল শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমি এটাও জানি, সেই গোলটেবিল বৈঠকের সময়, শেখ মুজিবের আপনাকে ভ্রমণসঙ্গী করা দূরে থাক,আপনাকে চেনার পর্যন্ত কোনো কারণ নেই। সেই গোলটেবিল বৈঠক, যা কিনা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য দুই উইঙের রাজনৈতিক নেতাদের একত্র করতে আয়োজন করেছিলেন। যার জন্য শেখ মুজিব সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
যাই হোক, সেই গোলটেবিল বৈঠকটি ১৯৬৯ এর ১০-১৩ই মার্চ অনুষ্ঠতি হয়েছিল এবং আপনি সঞ্চালক রবি ব্যানার্জির কাছে ভুল সাল উল্লেখ করেছেন। ১৯৬৯’র পরিবর্তে আপনি ১৯৭০ সালকে, গোল টেবিল বৈঠকের সাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন! মূলত আপনি তার ‘দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনা’ দূরে থাক,আপনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কখনই ভ্রমণ করেননি। যেহেতু আপনি সঞ্চালকের কাছে মিথ্যা দাবি করেছেন,আপনি সম্ভবত তাই গোলটেবিল বৈঠকটির সঠিক সালটিও জানেন না। এবং আপনাকে জানিয়ে রাখি, মুজিব গোলটেবিল বৈঠকের পর গ্রেফতার হননি, তিনি ১৯৭১ সালের ২৫/২৬শে মার্চ পাকবাহিনীর ক্র্যাক ডাউনের আগমূহুর্তে জীবনে শেষবারের মত গ্রেফতার হয়েছিলেন।
দয়া করে আমাকে এই মর্মে একটি কারণ দেখান, কেন ড.কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার মওদুদের মত বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ উপদেষ্টা(যারা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে পরামর্শ দিয়ে থাকতেন) থাকা সত্বেও,সেই কনফারেন্সের সময় বংগবন্ধু আপনাকে তার দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন? বরং সেসময় আপনি ইসলামাবাদে এমএ শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আর আপনি কখনই আওয়ামীপন্থি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন না,উলটো আপনি আওয়ামী বিরোধী এবং আইয়ুবপন্থি এনএসএফের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এনএসএফের সাথে আপনার জড়িত হবার জন্য আপনাকে আমি কোনো ধরনের দোষারপ করছি না।কারণ,আমি নিজেও ১৯৬৯ সালে এনএসএফের জিন্নাহ হল(সূর্য সেন)হল শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলাম।আসলে মানুষ তাদের কৈশরের শেষদিকে কিংবা যৌবনের প্রথমদিকে অনেক কিছু করে বসে বা অনেক গোষ্ঠির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, আবার দেখা যায়,জীবনের পরবর্তী অংশে তারা সেসব কিছুর সাথে সম্পর্কছেদও করে। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আপনাকে কিংবা অন্য কোনো ছাত্রনেতাকে ইসলামাবাদের গোলটেবিল বৈঠকে ডাকার কোনো কারণ ছিল না।
সাক্ষাতকারে আপনি আরেকটি ভুল তথ্য দিয়েছেন,যা কারো মিথ্যাবাদী প্রবৃত্তির পরিচায়ক বলে প্রতিয়মান বলে মনে হতে পারে। আপনি বলেছেন,“স্বাধীনতার পর একজন সিনিয়র আমলা হিসেবে আমি তার(শেখ মুজিবের) সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। আমি তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিসেবে আবিষ্কার করি।”বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ব্যাপারে আপনার এই মন্তব্য আমার কাছে তার প্রতি অবমাননাকর না হোক, অযাচিত বলে মনে হয়েছে।
যাহোক,আপনি যেভাবে একটি ভিত্তিহীন তথ্য দিয়েছেন,যা কি না মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ছাড়া কিছুই না,তা আমার ধারণার বাইরে ছিল! অন্যভাবে বললে, আপনি দাবি করেছেন, স্বাধীনতার পর আপনি বঙ্গবন্ধুর সাথে ‘জ্যেষ্ঠ আমলা হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন’,যা অবাস্তব গালগল্প ছাড়া কিছুই না। প্রথমত,আপনি বঙ্গবন্ধু’র না, বাংলাদেশের প্রশাসনের একটি অথবা কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অধিনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাও কোনো ‘জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা’ হিসেবে(যেমনটি আপনি দাবী করেছেন) নয়, বরঞ্চ অন্যতম কনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে, সেসময়কার বাংলাদেশ সরকারের(১৯৭৩-৭৫) মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর ব্যাক্তিগত সহকারী’র অধিনে একজন সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আপনি হয়ত জানেন, ৬০’র শেষদিকে আর ৭০’র প্রথমদিকে,আমরা যারা আপনার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে উঠেছিলাম,আমরা জানি, আপনি কখনই সিএসপি(সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) অথবা পিএফএস(পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস) এর কর্মকর্তা ছিলেন না বরঞ্চ কিছুটা কম আকর্ষণীয় পাকিস্তান সরকারের সিএসএস(সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস) এর কর্মকর্তা ছিলেন। তাই, আপনার করা ১৯৭০’র দশকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হওয়ার মত ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবির কোনো মানে রাখে না।
আদতে আপনার সাক্ষাতকার কিছু ভ্রান্ত আর মিথ্যা তথ্যর সমষ্টি ছাড়া কিছুই না। আমি শংকিত,এগুলো আপনার সমষ্টি ছাড়া কিছুই না। আমি শংকিত,এগুলো আপনার অস্থির না-হোক, আত্মভরী ও ভাববিলাসী চিন্তাধারার বহিপ্রকাশ মাত্র। জনাব মোমেন, এভাবে লেখার জন্য আমি দুঃখিত কিন্তু একজন নির্ভুল, সত্য এবং সঠিক ইতিহাসের অনুসন্ধানী হিসেবে,আমি এজন্যই লিখছি,যাতে আপনি আপনার অসাবধানতার জন্য দেশবাসী ও আপনার প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান। সত্যর স্বার্থে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ, দিনশেষে সবকিছু ছাপিয়ে,সত্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করার জন্য কারো সত্যর বরখেলাপ করার প্রয়োজন নেই। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এবং কারো একই সাথে নিজের নায়ক আর নিজেকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা উচিত নয়। এমনকি সত্য হলেও, প্রত্যেকের নিজের স্তুতি আওড়ানো থেকে বিরত হওয়া উচিত। সংজ্ঞাতিতভাবে প্রমাণ ছাড়া কারো এধরনের কিছু করা সমীচীন নয়। আপনার জানা উচিত,আপনার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের অধিকাংশই,এই আইটি বিপ্লব পরবর্তী যুগে,মিডিয়া বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে জড়িত। একজন পুরানো বন্ধু হিসেবে আপনাকে একটি অপৃষ্ট উপদেশ দিতে চাই-এমন কিছু করবেন না যাতে, বাংলাদেশের প্রধান কুটনীতিক হিসেবে আপনার অবস্থান দুর্বল হয় বা আপনার প্রতিনিধিত্ব করা সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
আমি আপনার অসাবধানতার উদাহরণ হিসেবে, সাম্প্রতিক সময়ে আপনার করা বেশ কিছু অপ্রীতিকর ও অ-কূটনৈতিক সুলভ উক্তি উদ্ধৃতি দিচ্ছি(যদি না তা বিষয়াদিকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতি থেকে অতিরঞ্জনের পর্যায়ে নিয়ে যায়)।আমি উদ্ধৃতিগুলোর উদাহরণ দিতে আপনাকে শব্দান্তরিত করছি।
১। “প্রবাসীরা দেশে আসলে নবাবজাদা হয়ে যান।” আপনি বাংলাদেশি প্রবাসীদের সম্পর্কে এই উক্তি করেছিলেন,যখন তাদের অনেকে ঢাকায় কোয়ারেন্টাইনে রাখার সময়, কতৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ তুলেছিল। তারা ইতালিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যাবার পর দেশে ফিরে এসেছিল এবং তাদের প্রতি চরম অপেশাদারিত্ব ও অসম্মানজনক আচরণ করা হয়েছিল।
২।“প্রবাসীরা যদি ব্যাপকভাবে দেশে ফিরতে থাকে, তবে দেশে চুরি-চামারি বেড়ে যাবে।” আপনার মত অবস্থানের কারো থেকে,এটি আরেকটি অযৌক্তিক ও অসংবেদনশীল উদ্ধৃতির উদাহরণ।
৩। “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মত।” সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে আপনার করা সবচেয়ে কান্ডজ্ঞানহীন ও অর্থহীন বিবৃতি। আমাদের অনেকের চেয়ে আপনার ভাল জানার কথা ভারত কিভাবে বাংলাদেশের সাথে অসাদচরণ করছে। এর মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, কয়েকটি কলাম লেগে যাবে, তা দৃষ্টিগোচর করতে!
৪। আপনার করা সবথেকে কান্ডজ্ঞানহীন উক্তি ছিলঃ“কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এটা সাধারণ ফ্লু’র মত।”আপনি এবং একই সাথে আমরাও জানতাম,যে কোভিড-১৯কে সাধারণ ফ্লু হিসেবে মূল্যায়ন করাটা আপনার কত বড় ভূল ছিল,যা কিনা গত প্রায় ৬ মাস ধরে পৃথিবীর ক্ষতিসাধন করে আসছে।
পরিশেষে,আপনার একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সত্য-মিথ্যা, শালীন-অশালীন, বাস্তবতা আর কল্পনার মধ্যকার পার্থক্যটা সরু কিন্তু স্পষ্টত দৃশ্যমান। এটি কারো আসল চুল আর সবথেকে দামী পরচুলা’র পার্থক্যর মতই স্পষ্ট,যা দিয়ে কেউ তার বাস্তবতা লুকিয়ে রাখতে চায়!
ধন্যবাদান্তে,
তাজ হাশমী
(PhD, FRAS Retired Professor of Security Studies, APCSS, Honolulu, and Research Associate at the York Centre for Asian Research (YCAR), York University, Toronto, Canada)