Site icon The Bangladesh Chronicle

বিচার বিভাগকে নিপীড়নের হাতিয়ার বানান হাসিনা

logo

নিজস্ব প্রতিবেদক

  • সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগের পর ইসলামিক দলগুলোকে টার্গেট করা হয়
  • প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, প্রটোকল না থাকলে শাহবাগে সংহতি জানাতাম

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচার বিভাগে ভয়াবহ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন সাংবাদিক, কলামিস্ট মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিচার বিভাগকে পুরোপুরি দখলে নিয়ে তা রাজনৈতিক বিরোধী ও ভিন্নমত দমন করার এক নির্মম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।’

গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৪৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে হাজির হয়ে এই জবানবন্দী দেন মাহমুদুর রহমান। বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে করা মামলার প্রেক্ষিতে এই সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। মাহমুদুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচার বিভাগ যেভাবে দলীয় রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, তা নজিরবিহীন। তিনি আরো বলেন, হাসিনা সরকারের আমলে বিরোধী দল, ইসলামপন্থী মতাদর্শ এবং জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দমন করতে বিচার বিভাগকে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্তের নামে প্রহসন চালিয়ে যেভাবে বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, তা মূলত ন্যায়বিচারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে।

মাহমুদুর রহমান তার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেন, ট্রাইব্যুনালের নামে নির্দিষ্ট মতাদর্শিক গোষ্ঠীকে টার্গেট করে যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তো দূরের কথা, ন্যূনতম মানবিক ন্যায়বিচারকেও প্রতিফলিত করে না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো হলো শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা। কিন্তু হাসিনার আমলে এই কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি তার জবানবন্দীতে নিজের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রীয় হয়রানি ও কারাবরণসহ নানাভাবে নিপীড়নের বর্ণনাও দেন।

এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় ট্রাইব্যুনালে হাজির হন মাহমুদুর রহমান। জবানবন্দী দিতে ডায়াসে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আমি একজন লেখক, ইতিহাস গবেষক এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক। মহান জুলাই ২০২৪ বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। আমি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে তার জন্য শুকরিয়া জানাই। আমি একজন সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাস গবেষক হিসেবে এই ফ্যাসিস্ট শাসনের উত্থান, বিকাশ এবং পতন প্রত্যক্ষ করেছি। বিগত ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছি। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি একটি মেটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে হয়েছিল। সেই প্ল্যানিংয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সাথে একটি বিদেশী শক্তি জড়িত ছিল। আমি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য কো-অথ্যালিশন ইয়ার্স’ থেকে উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনালকে জানাতে চাই যে, তিনি ২০০৮ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সাথে দিল্লিতে তার যে কথোপকথন হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। মইন ইউ আহমেদের সাথে তার চুক্তি হয়েছিল যে, যদি শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় তাহলে তৎকালীন সেনাপ্রধান তার চাকরির নিশ্চয়তা পাবেন, আর্থিকভাবে লাভবান হবেন এবং সেফ এক্সিট পাবেন। এই মিটিংটি ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের সবার মনে আছে যে, নির্বাচন হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে। তার অর্থ নির্বাচনের ১০ মাস আগেই নির্বাচনের ফলাফল দিল্লিতে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল এবং এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় হয়েছিল। নির্বাচনে এই ফল হওয়ার পিছনে জেনারেল মইন এবং ডিজিএফআইয়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ডিজিএফআইয়ে সেই সময় কর্মরত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ। এই ইলেকশন মেকানিজমে ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ যিনি পরবর্তীতে ডিজিএফআইয়ের প্রধান হয়েছিলেন এবং লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা আবশ্যক। কারণ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মোরাল যদি উচ্চ থাকে তাহলে তারা কোনো অবস্থাতেই একটি বিদেশী শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোনো পুতুল সরকারকে মেনে নিবে না। সুতরাং পরিকল্পনা মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য এবং শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ধানমন্ডির এমপি শেখ তাপস সরাসরি জড়িত ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে থেকেই বিডিআরের কিছু সদস্যের সাথে ষড়যন্ত্র করে শেখ ফজলে নূর তাপস এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি তৈরি করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।

সেনাবাহিনীর প্রতি হাসিনার এক ধরনের ঘৃণা ছিল : প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি একধরনের ঘৃণা ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি আরেকটি বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করব। বইটি লিখেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন। বইটির নাম ‘দ্য জামদানি রেভুলিউশন’ এই বইয়ে তিনি ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেই সময় শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ভারতীয় হাইকমিশনার বিদায়ী সাক্ষাৎকার করতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে সেটা ভারত যেন অস্বীকার করে। ভারতের সরকার থেকে যেন বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতার জন্য একমাত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দায়ী। তারা গোষ্ঠীস্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ওপরে অত্যাচার চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা আরো বলেছিলেন, ভারত যেন বলে তারা শান্তিবাহিনীকে ভারতে কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা অন্য কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। ভারতীয় হাইকমিশনার বাংলাদেশের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার এই জাতীয় রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যে হতবাক হয়ে যান। তিনি শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসা করেন, ভারত এই জাতীয় কথা বললে আন্তর্জাতিক মহল কি এ কথা বিশ্বাস করবে? শেখ হাসিনা আবারো হাইকমিশনারকে একই কথা বলেন। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার এই যে সেনাবাহিনী বিদ্বেষ এটা বাকশালের পতনের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। সেই সময় সেনাবাহিনীর একাংশ যারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের বিদ্রোহে একদলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বাকশাল শাসন ছিল সর্বপ্রথম ‘অথরিটারিয়ান রেজিম’ প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনাবিদ্বেষ ছিল। আমি আরো একটি বইয়ের রেফারেন্স এখানে দিচ্ছি। বইটির নাম ‘দ্য লেগ্যাসি অফ ব্লাড’ লেখক এন্থনি মাসকারেনহাস। এই সাংবাদিক শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান এন্থনি মাসকারেনহাসকে বলেছিলেন যে, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী সৃষ্টি করতে চান না। সেনাবাহিনীর বিকল্পরূপে তিনি রক্ষীবাহিনী তৈরি করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই রক্ষীবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারকে চিঠি লিখে জেনারেল উবানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। জেনারেল উবান ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিলেন। এই পারিবারিক সেনাবিদ্বেষের কারণে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও মোরাল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যাক। বিডিআর হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী ১৫ বছরের ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে হীনবল করার পরিকল্পনায় অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোনিবেশ করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করে এটিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা হলে আমি এর প্রতিবাদে ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি। আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিল জাতিকে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিরুদ্ধে সতর্ক করা। আমি লিখেছিলাম, বিচার বিভাগ স্বাধীন না থাকলে মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র কিছুই থাকবে না। এই লেখার জন্য আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দেয়া হয় এবং আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি ওই সময়কার আদালতের দু’টি সিদ্ধান্তের বিষয়ে মাননীয় ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পুরো কাজটি করা হয়েছিল আদালতকে ব্যবহার করে। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তিনি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবেন। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি হলো ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল’। এই মামলা নিয়ে তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট যত দূর মনে পড়ে আটজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিলেন। অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে শুধুমাত্র আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা সংবিধানে রেখে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রহিত করা হয়। সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করার পর ফ্যাসিস্ট সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের দিকে মনোনিবেশ করে। এই লক্ষ্যে তারা সর্বপ্রথম ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে টার্গেট করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণজাগরণ মঞ্চের নামে শাহবাগে মব কালচারের সৃষ্টি করা হয়।

হিটলারের পথ অনুসরণ করেছিলেন হাসিনা : সেখানে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, সকল ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের জনগণের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য একটা পাবলিক এনিমি কনসেপ্ট (গণশত্রু) তৈরি করে। হিটলারের জার্মানিতে প্রথমে কমিউনিস্ট এবং পরবর্তীতে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের এভাবেই গণশত্রু হিসেবে অভিহিত করে তাদের এথনিক ক্লিনজিংয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশেও একইভাবে ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক শ্রেণীকে নির্মূল করার পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য সরকার দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই সময় শাহবাগের কিছু বিক্ষোভকারীর নির্দেশে সরকার পরিচালিত হতে থাকে। তাদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফাঁসির দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। স্বয়ং শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন যে, এরা সবাই দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তিনি মানসিকভাবে সারাক্ষণ শাহবাগেই থাকেন। এমনকি ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেন যে, প্রটোকলে না আটকালে তিনি নিজেও শাহবাগে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করতেন। এর মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে, শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে পার্শ্ববর্তী হেজেমনিক ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল। শাহবাগের এই আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রের আইন পরিবর্তন করে রেট্রোসপেক্টিভ ইফেক্ট দিয়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাকে আপিল বিভাগে ফাঁসির রায়ে পরিবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি চরম অবিচারের উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফাঁসির দাবি করার বাইরেও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের যেসব মিডিয়া এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানায়। তাদের ন্যায়বিচার না করে ফাঁসির দাবি এবং ভিন্ন মতের প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবির মধ্য দিয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় ফ্যাসিবাদী চরিত্র উন্মোচিত হয়। সেই সময় আমার দেশ পত্রিকা জনগণকে এই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করে। আমরা একটি সংবাদ প্রকাশ করি যার শিরোনাম ছিলো ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। এই সংবাদ প্রকাশ হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। কিন্তু সরকার অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয় এবং এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে গ্রেফতার করা হয়। শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়লে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ আলেম এবং মাদরাসার ছাত্ররা ঢাকায় এসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে। আমার দেখা মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণ জমায়েত সে দিন ঢাকায় হয়েছিল। ওই দিন তারা কতগুলো দাবিদাওয়াসংবলিত একটি আলটিমেটাম দেয়। দাবিদাওয়াগুলো পূরণ না হওয়ায় মে মাসের ৫ তারিখে তারা আবার ঢাকায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। সেই দিন মধ্য রাতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে তাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়। সেই গণহত্যায় প্রধান ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ডিএমপির কমিশনার বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের অপারেশন চিফ সে সময়কার কর্নেল জিয়াউল আহসান এবং বিজিবির তৎকালীন প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। গণহত্যার পরদিন এই তিনজন সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করবার ঘোষণা দেন। সেই গণহত্যার পুরস্কারস্বরূপ বেনজীর আহমেদকে আইজিপি, জিয়াউল আহসানকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং আজিজ আহমেদকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান বানানো হয়। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, আজ পর্যন্ত শাপলা গণহত্যার বিচার বাংলাদেশে হয়নি। শাপলা গণহত্যার কিছু দিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেই সময়কার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক (নাসিম)। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করছিলেন তার একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট আমার দেশ এবং লন্ডনের দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকায় ছাপা হয়। বিচারপতি নিজামুল হক তার বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত একজন বাংলাদেশী জিয়া উদ্দিন আহম্মেদের সাথে নিয়মিত শলাপরামর্শ করতেন। তাদের স্কাইপ কথোপকথনের প্রমাণ এবং ই-মেইল আমার দেশ পত্রিকা এবং দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকার হাতে পৌঁছায়। সেই স্কাইপ কথোপকথনে দেখা যায় যে, পুরো বিচারপ্রক্রিয়া একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক, বেলজিয়ামে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ এবং ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী জিয়াদ আল মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করছেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা দ্যা ইকোনমিস্টে প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। আশ্চর্যের বিষয় শান্তির মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। কিছু দিনের মধ্যেই তাকে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ দেয়া হয়। তার পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে আপিল বিভাগে নেয়া হয় এবং বিচারপতির চাকরি থেকে অবসরের পরও তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়; অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, সব রকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে। স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা পাঁচ দিনে পাঁচটি পর্ব প্রকাশ করতে পেরেছিল। এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় এ-সংক্রান্ত সংবাদ আর ছাপানো সম্ভব হয়নি। আমার দেশ পত্রিকা এই ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করার ফলে আমার বিরুদ্ধে আইসিটি (তথ্য ও প্রযুক্তি আইন) আইনের ৫৭ ও ৫৮ ধারায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়।

২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে সমর্থ হন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সরকারি নিপীড়ন আরম্ভ হয়। কাদের মোল্লাকে তত দিনে তিনি ফাঁসি দিতে সক্ষম হন। এ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে, একতরফা নির্বাচন হলে তিনি সামাল দিতে পারবেন এবং এর পরে বাংলাদেশে তিন তিনটি নির্বাচনী তামাশা মঞ্চস্থ হয়। প্রথমটি ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে, দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং তৃতীয়টি ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কোনোরকম ভোট প্রদানের আগেই ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়; অর্থাৎ নির্ধারিত ভোটের দিনের আগেই প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই প্রকৃতপক্ষে ভোটদান সমাপ্ত করা হয়েছিলো। ২০১৮ সালের রাতের ভোট প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত এই দেশ থেকে তার বিদায়ের আগে সাংবাদিকদের বলে গিয়েছিলেন যে, পৃথিবীতে কোথাও ভোটের আগের রাতে ভোট প্রদান সমাপ্ত হয়ে যায় এটি বাংলাদেশেই প্রথম দেখলাম। ২০২৪ সালে আবারো অনেকটা ২০১৪ সালের মতো একতরফা ভোটবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেই নির্বাচনটি ‘আমি ও ডামির ভোট’ হিসেবে কুখ্যাত হয়েছিল। কিভাবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে ধাবিত হয়েছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। ২০১০ সালে আমি প্রথমবার গ্রেফতার হওয়ার পর আমাকে র‌্যাব-১ এর আয়নাঘর, যা টিএফআই সেল নামে পরিচিত, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত থেকে রিমান্ডে নিয়ে আমাকে প্রথমে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পর আইনবহির্ভূতভাবে আদালতের কোনো নির্দেশ ছাড়াই ডিবি থেকে আমাকে আয়নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। আয়নাঘরে নিয়ে আমার চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। তার পর অন্ধকার সেলে নিয়ে আমাকে গারদের শিকের সাথে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। টিএফআই সেলে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও বিভিন্ন উপায়ে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমি পাশের সেলগুলোতে কয়েদিদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের এক একজনকে সেল থেকে নিয়ে নির্যাতন করে আবার সেলে ফেলে রাখা হতো। সেখানে অধিকাংশরাই আলেম শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য টর্চার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হয়তো মানসিক টর্চার করার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণের জন্য আমার চোখ খুলে দেয়া হয়েছিল। আমি সেখানে টর্চারের নানা রকম যন্ত্রপাতি দেখতে পেয়েছিলাম। যেমন ছোট ছোট হাতুড়ি, করাত ও নখ তোলার জন্য প্লায়ার্স দেয়ালে টাঙানো ছিল। এখানে আমাকে এক দিন রাখা হয়েছিল। আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট থানায়। সেখানে রাত্রী ১টার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাঁচ-ছয়জন আততায়ী আমার সেলে প্রবেশ করে আমাকে বিবস্ত্র করে। আমার পরনে শুধু আন্ডারওয়্যার ছিল। আমাকে একটা জাম্পস্যুট পরিয়ে আমার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। আততায়ীরা আমার উপরে টর্চার শুরু করলে খুব দ্রুত আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখতে পাই আমাকে সেল থেকে ডিউটি অফিসারের রুমে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার পুরো শরীর পানিতে ভিজা ছিল। ধারণা করতে পারি আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য আমার শরীরে পানি ঢালা হয়েছে। টিএফআই সেল ও ক্যান্টনমেন্ট থানার ঘটনা আমার লেখা ‘জেল থেকে জেলে’ নামের বইতে বিস্তারিত লিখেছি। বইটি ২০১২ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৩ সালে আমি দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার হলে আমাকে ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফায় আমি ৩৯ দিন রিমান্ডে ছিলাম। দ্বিতীয় দফার রিমান্ডের সময় আমার সাথে তৎকালীন ছাত্রশিবিরের সভাপতি দেলাওয়ার হোসাইনের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এর আগে আমি দেলাওয়ার হোসাইনকে চিনতাম না। দুই দিন আমার সাথে দেলাওয়ার হোসাইন ডিবির একই গারদে ছিল। সেই সময় আমি তার ওপর ভয়াবহ টর্চার দেখতে পেয়েছি। তাকে সন্ধ্যার পরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সেল থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। মধ্য রাতে দু-তিনজন পুলিশ তাকে বহন করে আবার গারদে ফিরিয়ে নিয়ে আসত। টেনে নিয়ে আসার পর সে শুধু যন্ত্রণায় কাতরাতো, কথা বলতে পারত না, উঠে দাঁড়ানোর কোনো শক্তি থাকত না। দুই দিন পর ডিবি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে, আমার সাথে দেলাওয়ারকে রাখলে ভবিষ্যতে আমি তার ওপর নির্যাতনের সব কাহিনী প্রকাশ করব। সে জন্য তাকে আমার গারদ থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ও দেলাওয়ার শেখ হাসিনার ১৫ বছরব্যাপী জুলুমের প্রত্যক্ষ উদাহরণ। ভিন্ন মত এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর জুলুমকে বৈধতা দেয়ার জন্য ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের অপপ্রচার করে। জঙ্গি দমনের নামে তারা কিছু দিন পরপর বিভিন্ন নাটক তৈরি করেছে। এসব নাটকে প্রধানত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় জনগণের ওপর জুলুম চালানো হয়েছে। এদেরকে জঙ্গি সাজিয়ে ফেইক এনকাউন্টারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে ভিকটিম বানানো হয়েছে, যাতে তাদের জন্য বিচার চাওয়ার কেউ না থাকে। এরকম একটি উদাহরণ ঢাকার কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির জঙ্গি নাটক।

দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে শেখ হাসিনা জঙ্গি দমন এবং মেকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ তার সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন ও সেনাবাহিনী বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দীক মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি খায়রুল হক, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দীকি, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি জুগিয়েছে। আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব দুলাল, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক চিফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ ও সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছে। নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনার এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যরা বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, রওশন এরশাদ, জি এম কাদের ফ্যাসিবাদের সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। ১৪ দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দিলীপ বড়ুয়া, নজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারী, ফজলে হোসেন বাদশা, শিরিন আক্তার এবং তাদের সঙ্গীরাও ফ্যাসিবাদ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৪ দলের বাইরে মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, শমসের মুবিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মিজবাউর রহমান চৌধুরী, কাদের সিদ্দীকি, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করেছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনে ২০০৮ সালে জেনারেল মইন ইউ আহমেদ, জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা জেনারেল আমিন, ব্রিগেডিয়ার বারী ও ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ ভূমিকা রেখেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এ ভুয়া নির্বাচনকালীন সময়ে তিন সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, জেনারেল আজিজ আহমেদ ও জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তাদের নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না। ডিজিএফআইয়ের অধিকাংশ ডিজি এ সময়ের মধ্যে সরকারের জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

এদের মধ্যে মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো: আকবর হোসেন, জেনারেল সাইফুল আমিন, তাবরেজ শামস ও হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট। র‌্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এবং জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পৈছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবসময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ ও ২০২৪-এর ভুয়া নির্বাচনের পরও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় আমেরিকা এবং ইউরোপে শেখ হাসিনার পক্ষে লবিং করেছে। জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে। এই প্রসঙ্গে আমি বুয়েটের শহীদ আবরার ফাহাদের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই। কেবল ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয়ার জন্য সারারাত ধরে তার ওপর নির্মম অত্যাচার করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছিল। আমি বিগত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের চিত্র আমার লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এ পর্যন্ত আমার প্রায় ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে দু’টি ইংরেজি ভাষায়।

আন্দোলনে নিখোঁজ আস সাবুরের পোড়া লাশ মিলল পরদিন : ঢাকার আশুলিয়ায় ছাত্র আন্দোলনের সময় নিখোঁজ হওয়া এক স্কুলছাত্রের আগুনে পোড়া লাশ উদ্ধার করে তার পরিবার। নিহত শিক্ষার্থীর নাম আস সাবুর শাহীন (১৫)। তিনি ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। নিহতের বড় ভাই মো: রিজওয়ানুল ইসলাম আদালতকে জানান, ৫ আগস্ট ২০২৪ সকালে আস সাবুর প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার কথা বলে আশুলিয়ার শিমুলতলা এলাকার বাসা থেকে বের হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় সে ফোনে জানায়, বাইপাইল মোড়ে আন্দোলনে রয়েছে।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে প্রথম দিনের প্রথম সাক্ষী হিসেবে এ জবানবন্দী দিয়েছেন নিহত সাবুরের বড় ভাই। এদিন আরো একজন সাক্ষী দিয়েছেন। তিনি হলেন শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের বাবা খলিলুর রহমান। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

গতকাল ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।

সাবুরের বড় ভাই জানান, আন্দোলনে যাওয়ার দিন দুপুরের পর তার ফোন রিসিভ করেনি এবং বিকেল থেকে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরিবারের সদস্যরা সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান মেলেনি। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, বাইপাইল থানার পাশে একটি পুলিশ ভ্যানে কয়েকটি পোড়া লাশ রাখা হয়েছে। দুপুর সাড়ে তিনটায় জাহাঙ্গীরনগর এলাকার এক আন্দোলন-সমন্বয়ক ইমরান নামে এক ব্যক্তি আস সাবুরের মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে তার ভাই রিজওয়ানুল ইসলামকে জানান, আস সাবুরের লাশ পাওয়া গেছে এবং সেটি আশুলিয়া থানার মোড়ের একটি মসজিদের পাশে রয়েছে। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে তার খালাতো ভাই হুমায়ুন কবির ওই স্থান থেকে পোড়া লাশটি গ্রহণ করেন।

ছেলে হারানোর যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত খলিলুর রহমান : এ দিকে এ দিন এ মামলায় দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিতে এসে খলিলুর রহমান বলেন, আমি একজন পোশাকখাত সংশ্লিষ্ট কর্মজীবী। তিনি শান্তা হোল্ডিং ডেভেলপার কোম্পানিতে কর্মরত। স্থায়ীভাবে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার শ্যামপুর মধ্যপাড়া গ্রামে হলেও বর্তমানে তিনি ঢাকার আশুলিয়া, জামগড়ায় পরিবারসহ বসবাস করতেন। তার একমাত্র ছেলে শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজল সিটি ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম চাকরিও করতেন।

৫ আগস্ট ২০২৪ বেলা সাড়ে ১১টায় খলিলুর রহমানের স্ত্রী ফোনে জানান, তাদের ছেলে সজল একটি মিছিলে অংশ নিতে বাইরে গেছে। বিকেলে খলিলুর রহমান তার ছেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পান। অনেক খোঁজাখুঁজি ও উদ্বেগের পরেও সজলের কোনো খোঁজ মেলেনি। পরদিন সকালে খলিলুর রহমান বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিতে থাকেন। এক পর্যায়ে দুপুরে আশুলিয়ায় পৌঁছে ছেলের বন্ধু শান্তকে সাথে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যান। হঠাৎ একটি ফোন কল আসে, যেখানে বলা হয় বাইপাইলের একটি মসজিদের সামনে যেতে। সেখানে গিয়ে তিনি ও তার পরিবার দেখতে পান, আগুনে পোড়া একাধিক লাশ থানার পাশে রাখা হয়েছে। একটি লাশের সাথে পাওয়া যায় দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্র দেখে এবং ছেলের বুকের পাশের চিহ্ন দেখে তারা নিশ্চিত হন- এটাই তাদের সন্তান, সাজ্জাদ হোসেন সজল। এর আগে, ১৪ সেপ্টেম্বর এ মামলার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি ৫ আগস্ট আশুলিয়ার সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যার পর পুলিশের ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ওই সময় জীবিত ছিলেন একজন। এমন বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।

Exit mobile version