Site icon The Bangladesh Chronicle

বিক্ষোভের যুক্তি আছে কি নাই এখন সেই কুতর্ক শুরু হয়েছে। ফরহাদ মজহার

 

বিক্ষোভের যুক্তি আছে কি নাই এখন সেই কুতর্ক শুরু হয়েছে।

ফরহাদ মজহার   20 )ctober 2019

বিক্ষোভের যুক্তি আছে কি নাই এখন সেই কুতর্ক শুরু হয়েছে। যুক্তি থাকুক বা না থাকুক যে কোন নাগরিক যে কোন কারণে বিক্ষুব্ধ বোধ করলে সেই বিক্ষোভ প্রকাশের অধিকার তার আছে। পুলিশ ও প্রশাসনের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে বিক্ষোভ যেন শান্তিপূর্ণ ভাবে শুরু ও শেষ হতে পারে তার সকল শর্ত নিশ্চিত করা। আপনি যদি এই ন্যূনতম নীতি না মানেন তাহলে আপনি খুনি, সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের সহযোগী।

ভোলায় পুলিশ কোন পরিস্থিতিতে গুলি চালাতে বাধ্য হোল সে সম্পর্কে নাগরিক কিম্বা বিচারবিভাগীয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্তের ঘোষণা দেওয়াই হোত এই মূহূর্তের সবচেয়ে দায়িত্বশীল কাজ। কিন্ত শেখ হাসিনা ভোলার ঘটনা নিয়ে গতকাল যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেবার কোন রেশই পেলাম না। তিনি ‘ধৈর্য’ ধরতে ও ‘গুজব’-এ কান না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন।

এই রাষ্ট্র টিকে থাকে পুলিশী দমন পীড়ন ও হত্যার সংস্কৃতি চর্চা করে। আর এই চর্চা তো বাংলাদেশে আজকের নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই চর্চা চলছে। আইন ও মানবাধিকারের ভাষায় একে বলা হয় ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বলবৎ রাখা। অর্থাৎ পুলিশ ও প্রশাসনের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের পক্ষে বিরোধী দল, চিন্তা, মত বা ক্ষোভকে ক্রমাগত দমন করা, গুম খুন আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে দেওয়া, বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া, হয়রানি করা, ইত্যাদি। পুলিশ আর প্রশাসন ভুলে গিয়েছে তারা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মচারী না, তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের ক্ষোভ বিক্ষোভ দমন তার কাজ নয়, বরং শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখল ভাবে তাকে সম্পন্ন করতে দেওয়াই পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ।

ভোলার পুলিশি হত্যাযজ্ঞকে অতএব কোন যুক্তিতেই মেনে নেবার সুযোগ নাই। ক্ষমতাসীন সরকারের দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক, পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের কোন চেষ্টা না করে ফেনি নদির পানি দিয়ে এসে ‘মানবিক’ হবার দাবি, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ বিরোধী চুক্তি করা এবং সম্প্রতি ছাত্র লীগের হাতে পরিকল্পিত ভাবে আবরার ফাহাদ হত্যা — ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে যে ক্ষোভ সারা দেশে বিরাজ করছে, ভোলার ঘটনাকে সেই সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে আলাদা করে ভাবা যাবে না। এটা স্রেফ ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট আহত হবার ব্যাপার নয়, সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের জনগণ মারাত্মক নিরাপত্তা সংকটে ভূগছে। আবরার হত্যার পর ভোলা আরেকটি ইঙ্গিত। আমরা বড়সড় বিপর্যয়ের দিকে দ্রুত ধেয়ে চলেছি। এমন অবস্থায় কেউ পরিস্থিতির সুযোগে ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে, ‘অস্থিতিশীল’ পরিস্থিতি তৈরি করছে, ‘চক্রান্ত’ করছে ইত্যাদি বলে চিৎকার করলে সংকট মেটে না, বরং আরও বাড়ে।

এখানে হিন্দু/মুসলমান কিম্বা সংখ্যালঘু/সংখ্যাগরিষ্ঠের তর্ক গৌণ এবং অর্থহীন। বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শক্তি বাংলাদেশে সরব ও সক্রিয়। অতএব কে কার আইডি হ্যাক করেছে তার জন্য আলাদা তদন্ত চলতে পারে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের পারসেপশান বা সংবদনশীলতায় এতে কোন হেরফের হবে না। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক উপমহাদেশীয় প্রব্লেম, জটিল এবং ভয়ংকর। তার জের বাংলাদেশে থাকবেই। তার সমাধান নিছকই আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সামলাবার ব্যাপার না, বরং সামগ্রিক ভাবে উপমহাদেশের ইতিহাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা রাজনীতি ও সংস্কৃতির সমস্যা মোকাবিলার ব্যাপার। এই পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ববাদ কিম্বা মুসলিম জাতিবাদসহ সকল প্রকার জাতিবাদী, সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা ও রাজনীতি সঠিক ভাবে মোকাবিলার ওপর রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশের টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে। তাই ভোলার ঘটনা ও হত্যাযজ্ঞকে নিছকই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাবার চেষ্টা হিশাবে পর্যবসিত করা ভুল। দিল্লি ও ঢাকার সম্বন্ধ এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈরি সম্বন্ধকে আড়াল করে এখানকার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের জটিলতা বোঝা যাবে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী এবং চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দু্কে প্রতিনিধিত্ব করবার শক্তিশালী সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান (যথা, ইস্কন) সক্রিয় থাকলেও বাংলাদেশের নাগরিক সনাতন ধর্মাবলম্বিদের চিন্তা, সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশে তাদের অবদান তুলে ধরার এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করবার কোন সংগঠন নাই। বলাবাহুল্য, এরা সবসময়ই নিম্নবর্গ, নীচু জাতের, নির্ধন ও অসহায় মানুষ। আমি নিশ্চিত ভোলায় যাঁদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে তারা প্রান্তিক মানুষ।

কারো ওপর নির্ভর করে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না। আসন্ন সংকট মোকাবিলার জন্য জনগণের কর্তব্য জনগণকেই নির্ণয় করতে হবে।

Exit mobile version