Site icon The Bangladesh Chronicle

বিএনপি নেতাকর্মী হঠাৎ হয়ে যাচ্ছেন ‘নিখোঁজ’

৭ নভেম্বরের রাত। রাজধানীর উত্তরার আজমপুর রেলগেট। মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচজন সাদা পোশাকধারী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢাকা মহানগর উত্তরের ছাত্রদল নেতা মেহেদী হাসানকে (আসল নাম নয়) টেনে তোলা হলো গাড়িতে। মাইক্রোবাসে উঠিয়েই বেঁধে ফেলা হয় দুই চোখ; পরানো হয় হ্যান্ডকাফ। আধাঘণ্টার মতো গাড়ি চলার পর তাঁকে ঢোকানো হয় একটি আঁধার ঘরে। গাড়িতে কিছু করা না হলেও ওই কক্ষে ঢোকানোর সময় চলে চড়-থাপ্পড়, লাথি। পরে হ্যান্ডকাফ খুলে রশি দিয়ে বাঁধা হয় দু’হাত। নিকষ কালো আঁধারে এভাবে ছিলেন টানা আট দিন। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যার পর আবার চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে কয়েক ঘণ্টা চলল। ওই অচেনা লোকজন যখন মেহেদীকে ফেলে যায় রাস্তার ধারে, তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায়। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় সেখান থেকে মেহেদী ফেরেন ঢাকায়। ক’দিনের মনের আঘাত (ট্রমা) এখনও ক্ষত হয়ে এই ছাত্রদল নেতাকে পীড়া দিচ্ছে। বন্দি থাকার স্মৃতি মনে পড়লেই মাঝেমধ্যে আঁতকে উঠছেন। ঢাকায় ফিরে আর নিজের বাসায় যাননি মেহেদী। একটু সুস্থ হয়ে আবার বিএনপির মিছিলে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর।

মেহেদী জানান, অচেনা ব্যক্তিরা ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ বিষয়ে জানতে চেয়েছে। কারা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে বা রাখতে পারে– তাদের নামের তালিকা চেয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। একবেলা খাবার দিলে আরেক বেলা দেওয়া হতো না। আর কারও জীবনে যেন এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা না হয়– এটাই তাঁর প্রত্যাশা।

এর আগে গেল ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরের বাসা থেকে তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রফিক ও সাইফুল ইসলামকে তুলে নেয় সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই দিন পরীবাগ থেকে আবু বকর সিদ্দিক বাবুকেও আটক করা হয়। এর দু’দিন পর সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক মেহেদী হাসান চৌধুরী এবং কলেজের হল শাখার সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ হোসেনকে মহাখালীর বাসা থেকে তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের সবাইকে ১৪ নভেম্বর আদালতে তোলা হয়।

এসব পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তাদের সবার বক্তব্য অভিন্ন। কারও সন্তান, কারও ভাইকে আটক করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। উল্টো তারা স্বজনের খোঁজে এক থানা থেকে আরেক থানা, ডিবি-র‍্যাব কার্যালয়ে ছুটেছেন। তবে কেউ তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকার করেনি। হঠাৎ একদিন আদালত থেকে আইনজীবী ফোন করে জানান, তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এখন তারা কারাগারে আছেন।

সাইফুল ইসলামের বড় ভাই নাজমুল হোসেন জানান, ছোট ভাইয়ের খোঁজে সব জায়গায় গিয়েছিলেন তারা। কোথাও পাননি। এক অজানা আতঙ্কে গ্রামের বাড়িতে থাকা মা-বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে ১৪ নভেম্বর আদালত থেকে এক আইনজীবী তাঁর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানান, সাইফুলকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে তারা আদালতে যাওয়ার আগেই সাইফুলসহ অন্যদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর পর কারাগারে তারা দেখা করেছেন।

আবু বকর সিদ্দিক বাবুর ছোট ভাই হৃদয় ফকির জানান, তারা গ্রামের বাড়ি থাকেন। ঢাকায় আসতে পারেননি। এর পরও ফোনে ফোনে ভাইয়ের খোঁজ করেছেন। ঢাকায় এক বোন থাকে; সে-ই সব জায়গায় ছোটাছুটি করেছে। ওই সময় নিজের পরিবারের ওপর একটা ঝড় গেছে।

তিতুমীর কলেজ ছাত্রদল সভাপতি আরিফ হোসেন এমদাদ জানান, ছাত্রদল নেতাকর্মী হলেই ২ থেকে ১০ দিন ‘নিখোঁজ’ রাখা হচ্ছে। দুই দিন অজানা স্থানে রাখার বিষয়টি যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই ক’দিনে তাদের দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়। তাদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে অন্য নেতাকর্মীকে আটক করতে অভিযান চালানো হয়। পরে যখন ওই সব নেতাকর্মীকে আদালতে হাজির করা হয়, তখন প্রত্যেকে অসুস্থ থাকেন; খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না।

গত ২৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দক্ষিণে শাহজাহানপুর থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম জিকির একটি মামলায় হাজিরা দিতে নিম্ন আদালতে যান। সেখান থেকে তিনি নিখোঁজ হন। তাঁর সঙ্গে থাকা এক ছোট ভাই জানান, আদালত চত্বর থেকে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। এর দু’দিন পর ২৫ নভেম্বর তাঁকে শাহজাহানপুর থানায় সোপর্দ করে ডিবি পুলিশ। তরিকুল ইসলাম জিকিরের বড় ভাই আমিনুল ইসলাম জানান, মানুষ এখন আদালতেও নিরাপদ নয়। সেখান থেকেও কেন গ্রেপ্তার করতে হবে?

গ্রেপ্তার ও রিমান্ড বিষয়ে উচ্চ আদালতের ১৫ দফা নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাউকে গ্রেপ্তারের আগে পুলিশকে তাঁর পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। থানায় আনার পর দ্রুত গ্রেপ্তারের কারণ লিখতে হবে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। বাসা বা কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার না করলে গ্রেপ্তারের এক ঘণ্টার মধ্যে স্বজনকে জানাতে পুলিশ বাধ্য। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। আদালতের অনুমতি নিয়ে আসামিকে কাচের দেয়ালের কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের পর আসামিকে চিকিৎসকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। চিকিৎসকের প্রতিবেদনে নির্যাতনের প্রমাণ পেলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেবেন আদালত।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানছে না। তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের পর ভয়াবহ নির্যাতনের মাধ্যমে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। নিম্ন আদালতেও তারা কোনো ন্যায়বিচার পান না। বিরোধী দলের নেতাকর্মী হলেই রিমান্ড ও কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার নেতাকর্মীকে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে দোষ স্বীকারে বাধ্য করা হচ্ছে।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপিত ইবরাহিম হোসেন জানান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম মাহমুদকে আটকের তিন দিন পর জানতে পারে তাঁর পরিবার। অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা জানতে পারছেন না। আদালতে হাজির করলে জানা যাচ্ছে। আটক নেতাদের দিয়ে বিএনপি ও ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের জড়িয়ে শেখানো কথা বলানো হচ্ছে। সেগুলো আবার সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারও করানো হচ্ছে। শামীম মাহমুদের মতো ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক জামাল হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজনকে দিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি দেখানো হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

বিএনপির তরফ থেকে দাবি করা হয়, গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার পর থেকে সারাদেশে ১৬৬ মামলায় ১৯ হাজার ৩১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৫ জন। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সারাদেশে ৪৩৫ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭ হাজার ১০ জন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগ আবারও অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকতে বিরোধী নেতাকর্মীর ওপর নির্যাতনের সব সীমারেখা অতিক্রম করেছে। শুধু গণগ্রেপ্তারই করছে না; ভয়াবহ নির্যাতন চলছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে গুমের সংস্কৃতি শুরু হয়। মাঝখানে সেটা কিছুকাল কমেছিল। এখন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে নিখোঁজ আর নির্যাতন।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, বিএনপি যে অভিযোগ করছে, সেটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। কাউকে গ্রেপ্তার করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা সেটার ব্যত্যয় ঘটাতে পারি না। আমরা আইন অনুযায়ী সবার সঙ্গে সমান আচরণ করি।

আইনজীবী সৈয়দ মেজবাহ মো. জয়নুল আবেদীন মেসবাহ বলেন, আইন যদি আইনের গতিতে চলে, তাহলে এসব অভিযোগ উঠত না। এখানে ক্ষমতাসীনদের জন্য এক ধরনের আইনের প্রয়োগ; বিরোধী দলের জন্য আরেক ধরনের প্রয়োগ হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময়ে পুরো আইনি ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। সবাইকে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি সম্মান জানাতে হবে; মানতে বাধ্য করতে হবে। তাহলে এসব অভিযোগ উঠবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের অপব্যবহার রোধে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বহাল রেখেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, উচ্চ আদালতের বেশির ভাগ নির্দেশনা মানছেন না সংশ্লিষ্টরা।

Exit mobile version