বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি?


ড. আব্দুল লতিফ মাসুম:   রাজনীতি সম্পর্কে মহৎ শব্দাবলির সাথে তির্যকভাবেই উচ্চারিত হয়, রাষ্ট্রচিন্তক স্যামুয়েল জনসনের সেই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত উক্তি- ‘Politics is the last refuge of the scoundrels’। উক্তিটির রকমফের আছে। তবে বার্তাটি একই রকম। রাজনীতির মতো ত্যাগ-তিতিক্ষা ও জনসেবার মতো বিষয়কে ‘বদমাশদের শেষ আশ্রয়স্থল’ ভাবার কারণ কী?
দর্শনে এর উত্তরটি এরকম- ‘অস্তি, নাস্তি ও স্বস্তি’। সহজ করে বললে বলতে হয়- হ্যাঁ এর মধ্যে না আছে, আবার না এর মধ্যে হ্যাঁ আছে। অবশেষে হ্যাঁ-না মিলে মিলন মোহনা আছে। প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই ভালো ও মন্দ আছে। একই ফুল থেকে মৌমাছি মধু আহরণ করে। আর বোলতা ও ভিমরুল গ্রহণ করে বিষ। আরেকটি পদ্য এরকম- ‘সুজনে সুজস গাহে কুজস নাশিয়া, কুজনে কুজস গাহে সুজস নাশিয়া।’ বঙ্কিমের ভাষায়- ‘গন্ধে বিষ আছে, লতায় কণ্টক আছে, কুসমে কীট আছে, স্ত্রী জাতি বঞ্চনা জানে’ অর্থাৎ- সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক কিছুর সন্ধান।

রাজনীতি সম্পর্কেও এসব কথা যে প্রচলিত তা রাষ্ট্র-দার্শনিকদের কথায়ও প্রকাশিত। সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো, অগাস্টিন ও একুইনাস রাজনীতিকে দেখেছেন নৈতিক বিষয় হিসেবে। অপর দিকে, ম্যাকিয়াভেলি ও চাণক্য রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করেছেন ছল-চাতুরী ও অন্যায়-অপকর্মের বাহন হিসেবে। কে না জানে! ম্যাকিয়াভেলির সে উক্তি- ‘শাসক হবে শেয়ালের মতো ধূর্ত ও সিংহের মতো সাহসী।’ খুব সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের আজকের রাজনীতি দেখেশুনে এসব কথা বলতে হয়।

যারা নেতিবাচক রাজনীতি করেন তারা ইতিবাচক কথা বলেন। এই কলামের অতীতের একটি শিরোনাম ছিল- ‘ভালো ভালো কথা, মন্দ মন্দ কাজ’। ইহা কত প্রকার ও কি কি, আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরে তার প্রকাশ্য প্রদর্শনী হয়েছে। গ্রাম-বাংলার লোকেরা মজা করে বলে- রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকছে। আবার কেউ কেউ ভিলেজ পলিটিক্সের উদাহরণ দেন। ভিলেজ পলিটিক্স মানে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা বানানো। মামলা-মোকদ্দমা, অন্যায়-অত্যাচার ও প্রতারণা-প্রচারণা, এসবই সিদ্ধ ভিলেজ পলিটিক্সে। আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল পলিটিক্সকে ভিলেজ পলিটিক্সে রূপান্তরিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রামীণ পর্যায়ের নির্বাচনেও এরা ‘পলিটিক্স’ ঢুকিয়েছে।
এর আগে কখনো ইউনিয়ন কাউন্সিলর নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়নি। ২০১৫ সালের পর থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন- ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা পরিষদ ও জেলা কাউন্সিলের নির্বাচন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। তাই তো ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনের সময় স্লোগান শোনা গেছে- ‘চেয়ারম্যান ওপেনে মেম্বার গোপনে।’ অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো চেয়ারম্যানের ভোটও প্রকাশ্যে নৌকায় দিতে হবে। আমার গ্রামের একজন সহজ-সরল মানুষ আমাকে বলেছিল, ‘আপনি কি আমাগো চেয়ারম্যানডা অইতে পারেন না?’ নিজেই উত্তর দিচ্ছে ‘না, আপনে অইতে পারবেন না, আওয়ামী লীগ যে ভোট দিতে দেয় না। তবে আপনে মেম্বার অইতে পারবেন। অইলে মোগো উপকার অয় আরকি!’

রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলো’কে আওয়ামী লীগ বড় বড় অশান্তির জায়গায় পরিণত করেছে। যেখানে তারা ‘আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় যেন ছিল তারা আত্মীয় হেন’ এখন তারা মারামারি, কাটাকাটি ও রাজনৈতিক ঝগড়াঝাঁটিতে গ্রামকে শত্রুতার ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই, যেখানে নগর থেকে, রাজধানী থেকে লোকেরা রাজনীতি শিখবে, সেখানে উল্টো গ্রামের লোকদের ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ ঢুকে গেছে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। পৃথিবীর কোনো দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে এরকম লাখ লাখ মামলার কোনো উদাহরণ নেই। মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা, সন্ত্রাসী মামলা, আজব মামলা, গজব মামলা- আরো কত কী! এখন এই বাংলাদেশে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অন্তত ৫০ লাখ লোক মামলার বেড়াজালে আটকে আছে।

পুলিশ গ্রামে গ্রামে গিয়েও তাদের গ্রেফতার করছে। প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াতের এমন কোনো সক্রিয় নেতাকর্মী নেই সে আতঙ্কে বসবাস করছে না। গোটা বাংলাদেশকে তারা জেল বানিয়েছে। গ্রামের লোকেরা নিজ সন্তানকে হত্যা করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে- এরকম উদাহরণ অনেক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আওয়ামী বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য তারা প্রকাশ্যে আদেশ দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উচ্চারণ অযোগ্য শব্দ প্রয়োগ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু কিংবা বিরোধী নেত্রী সম্পর্কে উক্তিগুলো একত্র করলে ভিলেজ পলিটিক্সের সন্ধান পাওয়া যায়।

বিরোধী শক্তিকে বা ব্যক্তিগত বিরোধী নেতাকে নিঃশেষ করার ইতিহাস এ দেশে নতুন নয়। এদের নীতি হচ্ছে- ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। সেখানে নীতি-নৈতিকতা, সভ্যতা-ভভ্যতা, রীতি-রেওয়াজ, আইন-কানুন ও ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বালাই নেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই যারা নীতি-নৈতিকতায় বিশ্বাস করেন তাদের পক্ষে কল্পনাও করা কঠিন তারা কত নিচে নামতে পারে। ২০১৪ সালে যখন ভোটবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ এলো, তিনি আশ্বস্ত করলেন ‘এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, শিগগিরই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ সে নির্বাচন কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি।

২০১৮ সালে তিনি বলেছিলেন- ‘আমায় বিশ্বাস করুন’। দিনের ভোট রাতে করে তিনি সে বিশ্বাসের জবাব দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের সমাগত নির্বাচন নিয়ে তারা নানা ধরনের খেলা খেলেছেন। তাদের ওবায়দুল কাদের আসলেই খেলা শব্দটিকে খেলায় পরিণত করেছেন। আমাদের সময়ে একটি জনপ্রিয় অনুবাদ ছিল এরকম- ‘পুকুর পাড়ে শিশুরা খেলার ছলে ব্যাঙের দিকে ঢিল নিক্ষেপ করছে। এই ঢিলগুলো শিশুদের কাছে খেলা হলেও ব্যাঙের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’ ওবায়দুল কাদেরদের খেলা এ দেশের মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এরা তা বুঝেও না বুঝার ভান করছেন। কারণ, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’

ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী করতে চায়। তাতে জনগণের আপত্তি নেই। কিন্তু তা হতে হবে তাদের সম্মতির ভিত্তিতে। তারা হাজার বছর ধরে ক্ষমতায় থাক। তারা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত তক’ ক্ষমতায় থাকুক। আপত্তি নেই। কিন্তু তা নিশ্চিতভাবেই হতে হবে ভোটের মাধ্যমে। আর সেখানেই তাদের আপত্তি। তারা জানে জনগণের ভোটের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় আরোহণের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই তারা নিজেদের আন্দোলনে তৈরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে। ২০২৪ সালের ভোটটি যদি সত্যিকার অর্থে ভোট হয় তাহলে তাদের ভরাডুবি হবে। তাই তাদের এত ছলা-বলা-কলাকৌশল।

টেস্ট কেস হিসেবে ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলি লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ সময়কাল ধরে পরম ধৈর্যসহকারে বিএনপি নেতৃত্ব জনগণের রাগ, দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ ও ক্রোধকে প্রশমিত করে কুশলতার সাথে আন্দোলনকে সফলতার প্রান্তসীমায় নিয়ে এসেছিল। তারা এর আগে স্ব-ইচ্ছায় নয়, পরের ইচ্ছায় কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে। এখন যখন বিএনপি ও বিরোধী শক্তির বিজয়ের সম্ভাবনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে তখন তারা তা নস্যাৎ করে দিয়েছে। সেই পুরনো কৌশল- ম্যাকিয়াভেলিয়ান স্ট্র্যাটেজি অব পলিটিক্স। এখন ২৮ অক্টোবরের আগের ও পরের দৃশ্যাবলি ধারণ করলে স্পষ্টই বোঝা যাবে- এটি ছিল একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তারা খেলেছে অনেক দূর থেকে। তাদের লোকেদর পোশাক-আশাক ও আচরণ ধারণ হয়ে আছে ফুটেজে।

বোঝা যায়, আন্দোলনকে বিপথগামী করার জন্য তারা পুলিশ, হাসপাতাল ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে বেছে নিয়েছে। এটি কোনো স্বাভাবিক আচরণ নয়। অস্বাভাবিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উসকানিসঞ্জাত। প্রকাশ হয়ে যাওয়া অডিওতে শোনা যায়, কাকরাইলের গির্জা ও ফকিরাপুলের মন্দির আক্রান্ত হয়েছে কি না! তার মানে পরিকল্পিতভাবে একটি নীলনকশা এঁটে রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা এখন সেই পুরনো বুলি- আগুন, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের বুলি আউড়িয়ে যাচ্ছে। এই অজুহাতে বিএনপি তথা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্মম শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল তাদের জন্য একটি সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ নির্ণয় করেছে। ২৮ অক্টোবরের আগে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দ্বারা পরিচালনার পরিবেশ ছিল না। একই সাথে প্রশাসন ও পুলিশে দোলাচল সৃষ্টি হয়েছিল। বিচার বিভাগ সুপারসনিক গতিতে বিএনপি নেতাদের শাস্তি দিয়ে মহাপারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছে। ২৮ অক্টোবরের আগে যে ভারসাম্যের ইঙ্গিত মিলছিল তা এখন নষ্ট হয়েছে। শক্তিমদমত্ততার এই সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এখন তারা একটি নতুন কারসাজি শুরু করেছে। সেটি হচ্ছে ভোট পেছানো। রাজনৈতিক সমঝোতা হলে এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে নির্বাচন কমিশন পুনঃতফসিলের বিষয়টির বিবেচনা করবে। ওবায়দুল কাদেরের বহুল কথিত খেলা এটি। খেলোয়াড়ের হাত-পা বেঁধে তাকে বলছেন দৌড়ান। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এমন কোনো নেতা বাকি নেই যারা তথাকথিত দরকষাকষিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিএনপিকে উপদেশ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কখনো বলছেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ করা উচিত। আবার কেউবা শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

তার মানে হচ্ছে, বিএনপি বিরোধী দল হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। চিরকালই ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ। এর দ্বারা তারা কয়েকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। প্রথমত, গণতান্ত্রিক পাশ্চাত্যকে তারা দেখাতে পারবে- অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্র্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক পরিবেশ রয়েছে। তৃতীয়ত, তাদের ক্ষমতায় আরোহণকে লেজিটেমেট বা আইনানুগ দেখাতে পারবে। চতুর্থত, তারা যে সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার করছে তার সারবত্তা প্রমাণ করতে পারবে। পঞ্চমত, নির্বাচনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাস্তবতা নাকচ করতে পারবে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগ কিছু বিশ্বাসঘাতককে ভাড়া করতে পেরেছে। তারা বলছে, বিএনপির নির্বাচনের বিকল্প নেই। তারা তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নেতিবাচক কথাগুলোকে ইতিবাচক টোনে বলছেন। তারা বলছেন, বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককভাবে লড়ার কারো ক্ষমতা নেই। তারা বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্বকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তোষামোদি খোশামোদির মাধ্যমে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মুক্ত করার অপস্বপ্ন দেখাচ্ছে। সরকার শক্তি মদমত্ততার ভীতি প্রদর্শন করছে। সেই সাথে এমপি ও অঢেল অর্থের লোভ দেখাচ্ছে।

‘দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা’ দিচ্ছে। বিএনপির অপভ্রংশ এনপিপি নামের দলটি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছে। ইসলামের নামে সবসময় ব্যবসাদার ‘উলামায়ে ছু’ চাতুর্যের ভাষায় ‘দেশ, জাতি, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে’ নাজায়েজকে জায়েজ করার অপচেষ্টা করছে। তাহলে গোটা জাতির সামনে এটি পরিষ্কার যে, সরকার বিএনপি বিভাজন, দরকষাকষি, ভীতি ও লোভ দেখিয়ে একতরফা নির্বাচনকে সম্ভব করার পাঁয়তারা কষছে। তবে ‘দিল্লি হনুজ দুরস্থ’-দিল্লি এখনো অনেক দূর।

আশার কথা এই যে, ২৮ অক্টোবরের নির্মমতার পর রাজনীতিতে নতুন করে দ্রুত মেরুকরণ ঘটেছে। বিএনপি ও তার মিত্র শক্তিগুলোর এখন অবরোধ ও হরতালের মতো কঠিন আন্দোলনে রয়েছে। একই সাথে আন্দোলন করছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার প্রশ্নে অনড় এই দলগুলো। এই ইস্যুতে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে তারা। বিএনপি ২৮ অক্টোবর পরবর্তীকালে যোগাযোগ বাড়িয়েছে এদের সাথে। রাজপথের আন্দোলনকে এরা আরো জোরদার করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষ করে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। অতীতে যাই ঘটুক না কেন এই সময়ে এই প্রধান তিনটি দল নিকটতরভাবে অবস্থান করছে।

জামায়াতের নিবন্ধন প্রশ্নে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘সংসদসহ সব স্তরে প্রতিনিধিত্বশীল দলের নিবন্ধন বাতিল সুবিচারের প্রমাণ বহন করে না।’ জামায়াতে ইসলামী প্রতিদিন গ্রেফতার ও নির্যাতন উপেক্ষা করে সরকারের অপশাসন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে থাকছে। চরমোনাই পীর সাহেব গত সপ্তাহে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সাথে পরামর্শক্রমে বৃহত্তর আন্দোলন ও সমন্বিত কর্মসূচির আহ্বান জানিয়েছেন। আশা করা যায়, চরমোনাই পীর সাহেবের নেতৃত্বে বহমান আন্দোলনটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক সফলতা অর্জন করবে।

এই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাধারণ নাগরিকও বোঝে যে, বিএনপির আশু নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্ভব নয় এবং কাম্যও নয়। যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি রাজপথ কাঁপিয়েছে তা শুধু ক্ষমতায় আরোহণের আন্দোলন নয়। রাষ্ট্র ও নির্বাচনের সংস্কার তার উদ্দীষ্ট বিষয়। নির্বাচনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বিষয়টি বিএনপির বর্তমান আন্দোলনের প্রধান ইস্যু, তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি নৈতিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। শক্তি ও ভীতি প্রয়োগের যে নীতি ক্ষমতাসীনরা গ্রহণ করেছে তার কাছে বিএনপি নতি স্বীকার করতে পারে না। রাজনীতি সম্পর্কে যারা সাধারণ খবর রাখেন তাদের কাছেই নিশ্চয়ই এই বার্তাটি আছে যে, দেশের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ মানুষ বিএনপির সাথে রয়েছে।

জনগণই যদি হয় ক্ষমতার উৎস তাহলে বিএনপির ক্ষমতা অর্জন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি শেষ হয়ে যাবে- এই তত্ত্ব যারা দিচ্ছেন তাদের মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে বিএনপি যখন এরশাদের বোগাস নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি তখন সুবিধাবাদীরা একই কথা বলেছিল। অবশেষে ১৯৯১ সালে এ দেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অভাবনীয়ভাবে বিএনপি জয়লাভ করে। সাহস-দৃঢ়তা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে বর্তমান সঙ্কট অতিক্রম করতে হবে। অবশেষে একজন রাষ্ট্রদার্শনিকের ভাষায় বলি- ‘দেশটি তোমাদের এবং আমাদের, অবশেষে আমাদের।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ

নয়াদিগন্ত