বিআইএফসির অর্থ আত্মসাৎ
মেজর (অব.) মান্নানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
দুদকের উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ওই ১১ জনের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধমূলক অসদাচরণের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
মামলায় বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন বিআইএফসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদ মালিক ও ইনামুর রহমান, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব বিজনেস সৈয়দ ফাখরী ফয়সাল, সাবেক এভিপি অ্যান্ড ইউনিট হেড আহমেদ করিম চৌধুরী, সাবেক সিনিয়র অফিসার (বিজনেস) মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, সাবেক অফিসার মো. সৈকত আজাদ ও মাসুদ-উল-রেজা চৌধুরী, সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার তানিজা মাজেদ, সাবেক সিনিয়র অফিসার ও রিজিওনাল ম্যানেজার আফ্রিদা আহসান, ডি আফরোজ সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি গোলাম জিলানী দিদার ও ক্লিক টু ডিজাইনের এমডি মো.নাজমুল বাশার। এঁদের মধ্যে শেষের পাঁচজন একটি করে এবং অন্যরা দুটি করে মামলায় আসামি।
একটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ডি আফরোজ সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে দুটি ঋণচুক্তির আওতায় বোর্ড সভায় অনুমোদনের বাইরে অতিরিক্ত অর্থসহ নেওয়া ঋণের মধ্যে ২৮ কোটি ৮৪ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে মঞ্জুরি করা ৪৫ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চেক এবং পে-অর্ডারের মাধ্যমে অতিরিক্ত ৬১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬৭ টাকা অবমুক্ত করা হয়। এর মধ্যে কিছু অর্থ পরিশোধ করা হয়। বাকিটা এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি।
দুদক অনুসন্ধানের সময় দেখেছে, ডি আফরোজের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে বরাদ্দ অতিরিক্ত টাকার ইস্যু করা চেকের অধিকাংশ টাকাই মেজর (অব.) মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গেছে। এর মাধ্যমে দুদক বলছে, এই জালিয়াতির প্রধান সুবিধাভোগী মেজর মান্নান এবং তিনি নিজেই এই অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
অন্য মামলাটি ক্লিক টু ডিজাইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার। প্রতিষ্ঠানটি ১৪ কোটি ৩০ লাখ ৬৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণের অর্থও মেজর মান্নানের মালিকানাধীন ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গেছে বলে এজাহারে বলা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, বিআইএফসি থেকে বিপুল পরিমাণের ঋণ অনিয়মের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের সম্পৃক্ততা পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে ২০১৫ সালের শেষ দিকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুদক ও সিআইডিকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
অভিযোগে বলা হয়, ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রুপের ৩৪ কোম্পানির নামে-বেনামে বিআইএফসি থেকে ৭০৩ কোটি টাকা বের করে নেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। এর মধ্যে ২৭ প্রতিষ্ঠানের নামে ৫৭০ কোটি টাকা সরাসরি নেওয়া হয়। একই গ্রুপের সাত প্রতিষ্ঠানকে গ্যারান্টার দেখিয়ে নেওয়া হয় আরও ১৩৩ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার পরও কিছু ঋণ হিসাবকে নিয়মিত দেখানো ও সিআইবিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ঋণ হিসাবের রিপোর্ট না করার মতো বিষয়ও ধরা পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, তাঁর স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান ও মেয়ে তানজিলা মান্নানকে অপসারণের পাশাপাশি বিআইএফসিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে আত্মসাত্কৃত অর্থ আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে বিআইএফসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে মেজর (অব.) মান্নান আত্মসাৎ করা অর্থের মধ্যে ২০০ কোটি টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ফেরত দিয়েছেন ১২০ কোটি টাকা। দুদকের অভিযোগের তথ্য অনুসারে মান্নানের আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ ৫১৮ কোটি টাকা।
এ দিকে এই ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট একটি মামলা করে। মুদ্রা পাচার আইনে করা ওই মামলায় মান্নানসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন বিআইএফসির সাবেক এমডি ইনামুর রহমান, সাবেক এসএভিপি আহম্মেদ করিম চৌধুরী, বিআইএফসির সাবেক ব্যবসা প্রধান সৈয়দ ফাখরী ফয়সাল, মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের স্ত্রী ও বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান উম্মে কুলসুম, শ্যালক বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে লিমিটেডের পরিচালক রইস উদ্দীন, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে লিমিটেডের পরিচালক রিজিয়া সুলতানা, আকবর হোসেন ও আমিনুর রহমান খান, মেজর মান্নানের মেয়ে তানজিলা মান্নান ও তাজরিনা মান্নান।