Site icon The Bangladesh Chronicle

‘বাবাকে একটু দেখতে চাই, হাত ধরে হাঁটতে চাই’

‘বাবাকে একটু দেখতে চাই, হাত ধরে হাঁটতে চাই’বাবার কথা মনে করে কাঁদছে সাদিকা সরকার। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘মায়ের ডাক’ প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে। ছবি: সাজ্জাদ নয়ন

‘এগারো বছর বাবাকে দেখি না। এই এগারোটি বছর ধরে বাবাকে খুজে পেতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। এখন অন্তত বাবাকে ফিরিয়ে দিন। বাবাকে একটু দেখতে চাই। তার (বাবার) হাত ধরে হাঁটতে চাই। তাকে ছুঁয়ে একটু দেখতে চাই।’- এমন আবেগঘন বক্তব্য আর কান্না করে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হয়ে যাওয়া গাড়িচালক কাউসার হোসেনের ১৩ বছরের মেয়ে লামিয়া আক্তার মিম।

তার মতো আরও অনেক গুম, খুনের পরিবারের সদস্যরা, শিশুরা তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের কান্না আর আহাজারিতে পুরো প্রেস ক্লাব এলাকা ভারী হয়ে ওঠে। উপস্থিত অনেককে এ সময়ে চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। এসময় সবাই নিশ্চুপ হয়ে পড়েন। এ সময় তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গুম হওয়া তরিকুল ইসলাম ঝন্টুর মা হাসিনা বেগম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।  তাৎক্ষণিক তাকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

আগামীকাল রোববার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। প্রতিবছর এই দিবস উপলক্ষে ‘মায়ের ডাক’। গুম-খুন, ক্রসফায়ার, কারা নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে এই কর্মসূচি পালন করে আসছে।

‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, দেশের যে কোনো জায়গায় দাঁড়ানোর অধিকার তাদের আছে। অথচ, শাহবাগে জাদুঘরের সামনে তাদের দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। কেনো দেয়নি, সেটা সরকার জানে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও জানে। এই সরকার গুম খুনের বিচার তো করছেই না, উল্টো অন্যায় অত্যাচার ও গণগ্রেপ্তার চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে আছি। এই কথা শোনার মতো সাহসও নেই সরকারের।

এই অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, শাহবাগে এখন কাউকেই কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয় না। কর্মসূচি পালনের নামে ক্রসিংয়ে যদি মানুষজন বসে পড়েন, তাহলে পুরো এলাকায় যানজট তৈরি হয়।

গুম হওয়া পারভেজ হোসেনের মেয়ে হৃদি বলেন, ‘১০ বছর হয়ে গেলো, আমি আমার পাপ্পাকে দেখি না। আমরা যখন এসব কথা বলতে রাস্তায় দাঁড়াই, তখন পুলিশ আমাদের তাঁড়িয়ে দেয়। পুলিশ এতো নির্দয় কেনো? আমি তো শুধু পাপ্পাকে ফেরতে চাইতে এসেছি। পাপ্পার কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমার পাপ্পাকে ফিরিয়ে দেন, আমার পাপ্পাকে ফিরিয়ে দেন।’

হৃদি আরও বলেন, ‘পরীক্ষা শেষে সবাই যখন পাপ্পার সঙ্গে বেড়াতে যায়, আমিও যেন আমার পাপ্পার হাত ধরে ঘুরতে যেতে পারি। পুলিশ কেনো এমন করতেছে… কেনো পাপ্পাকে ফেরত দেয় না?’ ছোট মেয়ে হৃদি’র এমন বক্তব্যে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।

২০১৩ সালে গুম হওয়া সোহেলের কন্যা সাফা আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলেন, ‘আমার পাপ্পাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। ১০ বছর ধরে আমি আমার বাবাকে দেখিনি…. (কাদঁতে থাকে)। আমি এখনো রাস্তার মধ্যে পাপ্পাকে খুঁজি, তাকে পাই না। আমি বাবাকে পাপ্পা বলে ডাকতে পারিনি। আমার একটাই দাবি, প্লিজ প্লিজ প্লিজ; আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।’

গুম হওয়া সাজেদুল ইসলামের সমুনের ছোট মেয়ে আরোয়া বাবার ছবি বুকে ধরে বলে, ‘আমার বাবা আসে না, আমার কষ্ট হয়। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও।’

বংশাল থানা ছাত্র দলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আখতার বলেন, ‘আজকে ১০ বছর আমি আমার স্বামীকে খুঁজতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। কেনো আমার স্বামীকে খুঁজে পাবো না। কোনো আমার স্বামীকে গুম করা হলো? আমার স্বামীর কি দোষ, তা জানতে চাই।’

লক্ষীপুরের সাবেক ছাত্রদল নেতা শামসুল ইসলাম সোলায়মানের স্ত্রী নিজের আকুতি আর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘২০১৪ সালের ৪ নভেম্বর আমার স্বামীকে আটক করে এক কোটি ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। অনেক কষ্ট করে ২০ লাখ টাকা দেওয়ার চারদিন পর স্বামীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পেয়েছি। তার শরীরে ১৬টা গুলি করা হয়েছে। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। স্বামীকে মেরেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। আমারে পুরো পরিবারকে এখনও নির্যাতন করা হচ্ছে। এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

এ সময়ে স্বজনরা আরও বলেন, গুমের শিকার পরিবারের ট্রমা এখনো কাটেনি। ওইসব পরিবারের সন্তানরা যেভাবে বেড়ে ওঠার কথা, যেভাবে হচ্ছে না। বিগত ১৫ বছর ধরে এরকম নির্যাতন করা হচ্ছে বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে। প্রতিটা নির্বাচনের আগে মানুষজনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে। এর শেষ কোথায়?

তারা বলেন, ‘আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে আমাদের মানবাধিকার কোথায়? এভাবে আর কতদিন আমাদেরকে দমিয়ে রাখবেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসেও যখন আমাদেরকে কথা বলতে দেন না, তখন জাতিসংঘে রাষ্ট্রের পক্ষে যে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই স্বাক্ষর তুলে নিন।’

সংগঠনের সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আখির সভাপতিত্বে ও মঞ্জুর হোসেন ঈসার পরিচালনায় বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সভাপতি জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, জেএসডি’র সহ-সভাপতি তানিয়া রব, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব, বিএনপির নেতা হুম্মাম কাদের চৌধুরীসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।

সমকাল

Exit mobile version