- মাসুম মুরাদাবাদী
- ১৯ অক্টোবর ২০২২, ১৯:৫৪
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ মামলায় যা কিছু বলেছেন, তাতে ন্যায়বিচারের শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেল। সুপ্রিম কোর্ট এই ইস্যুতে আদালত অবমাননার একটি মামলাকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য শুধু নির্দেশই দেননি, বরং এমন একটি কথাও বলেছেন, যা তার জন্য মানানসই নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত উমা ভারতী ও বিনয় কাটিয়ারের মতো ফায়ারব্রান্ড নেতার বিরুদ্ধে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ইস্যুতে চলমান আদালত অবমাননার কার্যক্রমকে এ বলে বন্ধ করে দিয়েছেন যে, ‘মৃত ঘোড়াকে চাবুক মারার কোনো অর্থ হয় না।’
আদালত এ কথাও বলেছেন, সাংবিধানিক বেঞ্চ ৯ নভেম্বর, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের রায়ে রামমন্দির নির্মাণের রাস্তা পরিষ্কার করে সুরতহাল স্পষ্ট করে দিয়েছে। বেঞ্চ বলেন, আদালত অবমাননা মামলার আবেদনকারী আসলাম ভুরের মৃত্যু হয় ২০১০ সালে। আর আদালতে মামলাটি দেখভালের জন্য অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের আবেদনও প্রত্যাখ্যান করে দেয়া হয়। এ জন্য এখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস ইস্যুতে আদালত অবমাননা মামলার কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো।’ এভাবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ইস্যুতে আদালতের পক্ষপাতিত্ব পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেল। আর প্রকারান্তরে এ কথাও ঘোষণা করা হলো যে, না বাবরি মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করা হয়েছে, না তার নিপীড়নমূলক শাহাদতে কারো হাত ছিল। অযোধ্যায় ছয় ডিসেম্বরে যা কিছুই হয়েছে, তার সবটুকু আচমকা হয়েছে; তার কোনো অপরাধীই ছিল না।
এ কথা সবার জানা যে, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে যারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসে যোগ দিয়েছিল, সিবিআই আদালত আগেই তাদের দায়মুক্তি করে দিয়েছেন। যে সময় নামসর্বস্ব করসেবকরা মসজিদকে শহীদ করে, ওই সময় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পুরো প্রশাসনযন্ত্র উপস্থিত ছিল। আর মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং দেশের সর্বোচ্চ আদালতে হলফনামা দাখিল করে মসজিদ রক্ষার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। কিন্তু সব আইনি নিরাপত্তা সত্ত্বেও মসজিদের গম্বুজে আরোহণকারী উগ্রপন্থীদের থামানো যায়নি। তারা পাঁচশত বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনাকে ধ্বংস করে দেয়। দুঃখের বিষয় হলো, যে মানুষগুলো বাবরি মসজিদের শাহাদতের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এবং যারা নামসর্বস্ব করসেবকদের সাহস জোগানোর জন্য ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলা দাঁড় করায় এবং তাদের গ্রেফতারও কার্যকর করে। কিন্তু আফসোস দীর্ঘ ২৮ বছরের খুঁড়িয়ে চলা আদালতি কার্যক্রমের পর ওই সব মূল অপরাধীকে ‘সসম্মানে’ মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতের বিচারক ওই সব প্রমাণকে যথেষ্ট নয় বলে অভিহিত করেন, যা ২৮ বছর ধরে চিৎকার করে করে ওই অপরাধীদের দোষী হওয়ার কথা ঘোষণা করছিল। সিবিআই এ ইস্যুতে তাদের রাজনৈতিক গুরুদের সন্তুষ্ট করার জন্য সেসব কাজ করেছে, যা ওই অপরাধীদের বাঁচানোর পথ সুগম করে। সিবিআইয়ের অসদুদ্দেশ্য এ বিষয়টাতেই পরিমাপ করা যায় যে, দুই বছর অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তারা এখনো রায়বেরেলি আদালতের রায়কে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেনি এবং ওই লোকগুলোও হাত গুটিয়ে বসে আছে, যারা এই ইস্যুতে সমুচ্চ স্বরে উচ্চ আদালতের দরোজায় কড়া নাড়ার দাবি করেছিলেন।
বাবরি মসজিদ ইস্যু মূলত এই দেশে অন্যায়-অবিচারের এমন এক মর্মন্তুদ কাহিনী, যার নজির আপনি স্বাধীন ভারতে পাবেন না। ১৯৪৯ সালে যে সময় বাবরি মসজিদের ভেতর জোরপূর্বক মূর্তি রাখা হয়েছিল, ওই সময় দেশভাগের ক্ষত একেবারে তরতাজা ছিল। আর মুসলমানরা অকারণ অপরাধবোধের শিকার ছিল। তাদের মনোবল ছিল ভাঙা। তারা তাদের বিক্ষিপ্ত অস্তিত্বকে জড়ো করার চেষ্টা করছিল। এদিকে দেশের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সংবিধানের শপথ গ্রহণকারী জাতীয় নেতারা তাদের আশ্বাস দিচ্ছিলেন, এ দেশে তাদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার সর্বাত্মক রক্ষা করা হবে। সুতরাং তারা যেন মন থেকে সব ধরনের হীনম্মন্যতা দূর করে দেয়। কিন্তু যখন স্বাধীনতার মাত্র দুই বছর পর সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ভারতকে অযোধ্যায় সেক্যুলারিজমের প্রথম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হলো, তখন এ নেতারা তাদের কথামত মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে পারেননি। তারা সংবিধান ও আইন রক্ষার পরিবর্তে সংখ্যাশক্তির সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন। যদি তাদের নিয়ত পরিষ্কার থাকত, তাহলে ওই সময়ই মসজিদের পবিত্রতা বহাল রাখা হতো এবং এ ইস্যুকে পুরাতন ক্ষতে রূপ নেয়ার জন্য রেখে দেয়া হতো না। যারা এই মারাত্মক ভয়ঙ্কর বিতর্ককে তরতাজা হওয়া ও বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছিল, তারা পরবর্তীতেও তাতে ইন্ধন জুগিয়ে কপটচারিতার প্রমাণ দিয়ে গেছে। এট ভিন্ন কথা যে, দুই নৌকার আরোহী তাদের দুর্গত অঞ্চলে ডুবিয়ে দিয়েছে এবং আজ সে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে ব্যস্ত।
বাবরি মসজিদের ভূমি রামমন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দু পক্ষকে অর্পণের পর সিবিআই আদালতের বিশেষ বিচারক ন্যায়বিচারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার কাজ সম্পাদন করেছেন। তিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার ৩৫ অপরাধীর সবাইকে এ বলে খালাস করে দিয়েছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো প্রমাণ বিদ্যমান নেই। অথচ এরা বাবরি মসজিদ শাহাদতের অপরাধকর্মে গলা পর্যন্ত ডুবেছিল। আর তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদির এত স্তূপ ছিল যে, কোনো মামলায় এত প্রমাণ খুব কমই একত্র হয়।
সিবিআই বিচারক এস কে যাদব তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত কোনো প্রমাণকেই মানতে অস্বীকার করেন। তিনি তার রায়ে এ কথাও বলেছেন যে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিংঘল ভবন রক্ষা করতে চাচ্ছিলেন, কেননা তার ভেতর রামের মূর্তি ছিল। যে ৩২ জন অপরাধীকে বাবরি মসজিদ শাহাদত মামলায় বেকসুর খালাস দেয়া হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন লাল কৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী, কল্যাণ সিং, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, সাধ্বী ঋতম্ভরা ও রামমন্দির ট্রাস্টের বর্তমান সেক্রেটারি চম্পাত রায়। উল্লেখ্য, এই ৩২ জন অপরাধীর সবাই আদালতে নিজেদের একেবারে নির্দোষ দাবি করেন। কেউই অপরাধ স্বীকার করেননি। সবাই তাদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগসমূহকে এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অভিহিত করেন। আর এর জন্য তারা তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে দোষ দেন। অপরাধীদের যুক্তিকে সর্বান্তকরণে মেনে নিয়ে বিশেষ আদালতের বিচারক বলেন, সিবিআই ৩২ জন অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আদালতে যে ভিডিও রেকর্ডিং উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়ে হাসাহাসি হয়। বিচারক বলেন, সরকারি উকিল অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। সিবিআই যে অডিও, ভিডিও প্রমাণ দিয়েছে, তার নির্ভরযোগ্যতা হওয়া প্রমাণিত হয়নি। অপরাধীরা ঘটনাস্থলে যে বক্তৃতা করেছিল, তার যে অডিও আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তাতে আওয়াজ স্পষ্ট নয়। তবে আদালত ন্যায়বিচারের লাজ রক্ষা করতে গিয়ে বলেছেন, মসজিদের গম্বুজে আরোহণকারীরা অবশ্যই সমাজবিদ্বেষী গোষ্ঠীর সাথে তুলনীয়। কিন্তু এখন সুপ্রিম কোর্ট ওই সমাজবিদ্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলাও বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর দ্বারা তো এটাই প্রমাণিত হয় যে, ভারতকে ওলটপালট করে দেয়া এই মামলায় কেউ অপরাধীই ছিল না। সব কিছু আপনাআপনিই হয়েছিল। বাবরি মসজিদ ইস্যুতে রাষ্ট্রের চার স্তম্ভ যে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, তা ন্যায়বিচার ও আদালতের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট