Site icon The Bangladesh Chronicle

বাপেক্সে কেন হঠাৎ অর্থ সংকট

ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস ক্ষেত্র। – ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কাজ করা রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্স সরকারি বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থার কাছ থেকে সময়মতো গ্যাসের বিল না পাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়েছে এবং এ কারণে সংস্থাটির নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেই একটি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।

একজন বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলছেন, বাপেক্সের এ সংকট আগে থেকেই চলছে এবং এর মূল কারণ হলো অব্যবস্থাপনা।

সংকট মেটাতে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নিজেদের এফডিআর ভেঙে সরকারের ভ্যাটের অর্থ শোধ করতে হচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: শোয়েব এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।

চিঠিটি বাপেক্সের তরফ থেকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি- বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে দিয়ে অবিলম্বে তাদের কাছে পাওনা ১১৪ কোটি টাকা শোধ করতে বলা হয়েছে।

যদিও মো: শোয়েব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে বাকি আছে কিন্তু সে টাকা আদায়ে চিঠিতে সংকটের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে এটি অর্থ আদায়ের জন্য চাপ দিতে লেখা হয়েছে।

‘এখানে সংকট নেই। নিয়মিত কার্যক্রম থেকে শুরু করে সবকিছুই স্বাভাবিক। তবে সময়মতো বিল ও ভ্যাটের টাকা না আসায় ওভাবে চিঠি লেখা হয়েছে,’ বলেন তিনি।

তবে বাপেক্সের মূল কর্তৃত্ব যাদের সেই পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, যেসব সরকারি সংস্থার কাছ থেকে বাপেক্সের টাকা পাওনা আছে সেগুলো আদায়ের জন্য তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করছেন।

‘যেভাবে সংকটের কথা বলা হচ্ছে পরিস্থিতি মোটেও তা নয়। এটা একটা রেগুলার ইস্যু। বিল হয় এবং ধারাবাহিকভাবে টাকা আসবে। কখনো কোনো সংস্থার কাছ থেকে টাকা আসতে দেরি হলে চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া হয়। এটাকে বড় করে দেখার কিছু নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

যদিও সব মিলিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কী পরিমাণ অর্থ বাপেক্সের পাওনা আছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য কর্মকর্তারা দিতে চাননি।

জ্বালানিবিষয়ক বিশ্লেষক অধ্যাপক বদরুল ইমাম অবশ্য বলেছেন, বাপেক্সের এ সংকট এখন তৈরি হয়নি বরং এটি আগে থেকেই চলছে, যার মূল কারণ হলো অব্যবস্থাপনা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন করে থাকে। এগুলো হলো- বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফসিএল) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)।

বাপেক্সের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ মুহূর্তে তাদের উৎপাদনক্ষম গ্যাসক্ষেত্র আছে সাতটি। এছাড়া তাদের হাতে অনুসন্ধান কূপ আছে ১৮টি।

বাংলাদেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাপেক্স অনেক দিন ধরেই সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এমনকি এক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানির চেয়েও বাপেক্সের সাফল্যের হার বেশি।

বাপেক্স কি আসলেই সংকটে!
সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: শোয়েব বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে গত ২০ আগস্ট যে চিঠি পাঠিয়েছেন সেখানে তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, গ্যাস বিল সময়মতো না পাওয়ায় বাপেক্সে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে।

ওই চিঠিতে বাপেক্সের সরকারি কোষাগারের নিয়মিত পাওনাসমূহ পরিশোধ, টেকসই অনুসন্ধান, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা ও বাপেক্সের আর্থিক তারল্য সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু চলতি বছরে মে মাসের বিল ও বকেয়াসহ মোট ১১৪ কোটি টাকা পাওনা বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানিকে পরিশোধের তাগিদ দেয়া হয়েছে।

অর্থাৎ এক মাসের বিল ও বকেয়ার পরিমাণই এই পরিমাণ টাকা।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বকেয়া অর্থ আদায় না হওয়ায় সংস্থার নিয়মিত কার্যক্রমে কিছু সমস্যা হবে।

মূলত গ্যাস কূপ খনন করার জন্যই বাপেক্স অর্থ ব্যয় করে থাকে এবং পরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিল পেলে তা দিয়ে তারা নিজস্ব খরচ বহন করে।

আবার গ্যাস বিক্রি করলে সরকারকে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয় ৯০ দিনের মধ্যে। অন্যথায় গুনতে হয় জরিমানা। বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সময়মতো ভ্যাটের টাকা না পেলে বাপেক্স নিজের তহবিল থেকে সেটি পরিশোধ করে।

এভাবেই কিছু সরকারি সংস্থার কাছে বিল ও ভ্যাটের টাকা দুটোই আটকে আছে। একই সাথে বিল ও ভ্যাটের টাকা আটকে থাকাতেই কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যদিও তার দাবি, এতে করে সংকটময় কোনো পরিস্থিতি সংস্থার কার্যক্রমে তৈরি হয়নি।

জানা গেছে গত বছরের শুরু থেকেই কিছু কোম্পানি ভ্যাট বাবদ অর্থ দেয়া বন্ধ রাখায় বাপেক্সকে নিজ তহবিল থেকে তা সরকারকে শোধ করতে হয়েছে।

আবার এর মধ্যেই সংস্থার নিয়মিত কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি কর্মকর্তা কর্মচারীদের একাধিক বোনাস দিতে হয়েছে। তবে কর্মকর্তারা দাবি করেন যে বিশেষ কিছু অর্জনের জন্য এ বোনাস দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে আবার এই প্রতিষ্ঠানই ডলার সংকটের কারণে পরিকল্পিত কিছু কাজ করতেই পারছে না। বিশেষ করে কিছু যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানি করা যায়নি ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায়।

কিছু কূপ খননযন্ত্র মেরামত ও আধুনিকায়নের জন্য ওই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল দু’বছর আগে। যদিও চার দশকের পুরনো খননযন্ত্র মেরামতের পরিকল্পনায় খুব বেশি সায় ছিল না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন বিভাগের।

অথচ এর মধ্যেই ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা আছে সরকারের জ্বালানি বিভাগের, যার বেশিরভাগই করার কথা বাপেক্সের।

এখন একদিকে অর্থ সংকট, অন্যদিকে কূপ খননযন্ত্র পরিকল্পনা অনুযায়ী মেরামতের পদক্ষেপ নিতে পারায় ওই পরিকল্পনা কতটা আলোর মুখ দেখবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

উত্তরণ : বাপেক্স, পেট্রোবাংলা ও বিশেষজ্ঞ মত
তবে বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: শোয়েব বলেন, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজই তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

জ্বালানিবিষয়ক বিশ্লেষক অধ্যাপক বদরুল ইমাম অবশ্য বলেন, বাপেক্সের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গ্যাসের গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করা হলেও সেই অর্থ অন্যত্র কাজে লাগানো হয়েছে।

‘এ তহবিল থেকে টাকা দেয়া হয়েছে এলএনজিতে। এতে বাপেক্সের কোনো কাজ হয়নি। আবার বাপেক্স সরকার থেকে এখন আর অনুদান পায় না। বরং তাদের সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সুদসহ ফিরত দিতে হয়। এসব মিলিয়ে অনেকদিন ধরেই বাপেক্স আর্থিকভাবে সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

তিনি বলেন, পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত বাপেক্সের পাশে দাঁড়ানো। কারণ গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সকে সহায়তা করা তাদেরই দায়িত্ব।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার অবশ্য বলেন, বকেয়া অর্থ আদায় বাপেক্সের নিয়মিত কার্যক্রম। এ থেকে উত্তরণের জন্য তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সাথে আলোচনা করছেন।

‘এটা এমন কিছুই নয়। সরকারি সংস্থাগুলো থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা আদায় হয়। সেজন্য কখনো কখনো দেরি হয়। এছাড়া আর কোনো সংকট নেই। বকেয়া অর্থও নিয়মিতভাবে চলে আসবে,’ বলেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি

Exit mobile version