জানা গেছে, প্রথম ধাপে শুধু নিবন্ধন হয়নি—এমন ১০৩টি প্লটের বরাদ্দ বাতিল করবে রাজউক। আর বরাদ্দসংক্রান্ত অনিয়ম থাকায় ২৫ থেকে ৩০টি প্লট বাতিল করবে জাগৃক। এর মধ্যে ‘মুজিব’ সিনেমার অভিনেতা আরিফিন শুভ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ১৫ গাড়িচালকসহ রাজনীতিবিদ, সচিব, বিচারপতি ও সরকারি কর্মকর্তাদের নামে বরাদ্দ করা প্লটও রয়েছে।
দেশে সংরক্ষিত কোটায় সরকারি প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া ষাটের দশক থেকেই চলে আসছে। এ সুবিধার আওতায় মূলত সরকার সমর্থক লোকজনই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৩ অনুযায়ী এসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। আইনটির ১৩/এ ধারা অনুযায়ী সংসদ সদস্য, বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা এবং যাঁরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রেখেছেন, তাঁরা প্লট বরাদ্দ পান। তবে এবার এই আইন বাতিলের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. নবীরুল ইসলাম গত সোমবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই মোতাবেক সংস্থাগুলোকে তালিকা তৈরি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব বরাদ্দে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা দেখে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জানা যায়, শুরুর দিকে ধানমন্ডি এলাকায় প্লট বরাদ্দ দিত সরকার। পরে পর্যায়ক্রমে গুলশান, বনানী-বারিধারা, মিরপুরের সরকারি আবাসন প্রকল্প থেকে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ একাধিকবার সরকার গঠন করে সংরক্ষিত কোটায় প্লট ও বাড়ি বরাদ্দ অব্যাহত রাখে। সংসদ সদস্য, বিচারপতি, সচিব, কূটনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানা পেশাজীবীর পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও এ সুবিধায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন।
বাতিল হচ্ছে অভিনেতা শুভর প্লট: মুজিব সিনেমা করে আলোচনায় আসা অভিনেতা আরিফিন শুভকে সংরক্ষিত কোটায় বরাদ্দ দেওয়া রাজউকের প্লটটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আরিফিন শুভর সঙ্গে ছবিটির প্রযোজক লিটন হায়দারের প্লটও বাতিল হচ্ছে। রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প থেকে শুভকে ১০ কাঠা আর প্রযোজক লিটন হায়দারকে ৩ কাঠা আয়তনের একটি প্লট গত বছরের ২৭ নভেম্বরে রাজউকের বোর্ড সভায় বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ প্লটের বিপরীতে শুভ সরকার-নির্ধারিত টাকা জমা দিয়ে একটি চুক্তিপত্রও গ্রহণ করেন। কিন্তু সময় স্বল্পতায় তিনি এ প্লটের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করে নিতে পারেননি। এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শুভর প্লটসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় বরাদ্দ দেওয়া প্লটগুলো নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আরিফিন শুভ ও লিটন হায়দারের প্লট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজউক।
আরিফিন শুভর প্লট বাতিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল রাজউকের চেয়ারম্যান মে. জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি। তবে কী পরিমাণ প্লট বাতিল হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। মূলত যেগুলো রেজিস্ট্রেশন হয় নাই, এমন শতাধিক প্লটের তালিকা তৈরি করা হয়েছে; যা বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে বরাদ্দ বাতিল করা হবে।’
১৫ গাড়িচালক, ৯ সচিবের প্লটও বাতিল হচ্ছে: সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন এমন ১৫ জন গাড়িচালককে প্লট দেওয়া হয়েছিল। রাজউকের ২০২৪ সালের চতুর্থ বোর্ড সভায় এসব প্লট দেওয়া হয়। যাঁরা প্লট পেয়েছেন, তাঁরা হলেন মো. সাইফুল ইসলাম, মো. সফিকুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম লিটন, রাজন মাদবর, মাহবুব হোসেন, মো. শাহীন, মতিউর রহমান, নূর হোসেন ব্যাপারী, বোরহান উদ্দিন, বেলাল হোসেন, মিজানুর রহমান, বাচ্চু হাওলাদার, নূরুল আলম, নূরনবী ইমন ও মো. শাহীন। এসব গাড়িচালক যৌথভাবে প্লট পেয়েছেন। অর্থাৎ ৩ কাঠা ও ৫ কাঠা আয়তনের একটি প্লট দুজনকে যৌথভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্লটও নিবন্ধন করা হয়নি বলে তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজউক। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিচারপতি, সচিবসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে থাকা নিবন্ধনকৃত প্লটগুলোও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আলোচনায় বিএনপি পল্লি ও আওয়ামী পল্লি: ১৯৯৯ সালে গুলশান, বনানী ও উত্তরায় প্লট বরাদ্দ পান আওয়ামী লীগের ৬৫ জন সংসদ সদস্য। এরপর চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বনানী আবাসিক এলাকার ২০ বিঘা জমি নিয়ে একটি প্লট প্রকল্প তৈরি করা হয়। সেখানে বিভিন্ন আয়তনের ৫৪টি প্লট তৈরি করে বরাদ্দ দেয় রাজউক। এ বরাদ্দের তালিকায় ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
এদিকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ থেকেও বিভিন্ন সরকারের সময় সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এসব বিষয়ে তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছে পূর্ত মন্ত্রণালয়। এরপর সংস্থাটির পক্ষ থেকে বরাদ্দসংক্রান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এ তালিকায় বাতিলযোগ্য কিছু প্লটও রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, জাগৃক থেকে সরকারি প্লট বরাদ্দে শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেরাই নিজেদের নামে কোটা চালু করেছেন। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সচিব কোটা’ ও ‘চেয়ারম্যান কোটা’। এসব কোটায় গত এক বছরে ২০ থেকে ৩০টি প্লট বিলি-বণ্টনও হয়েছে। এগুলোর আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। তাই এসব প্লট বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জাগৃকের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. হামিদুর রহমান খান বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বরাদ্দ হওয়া প্লটের তালিকা হচ্ছে। তবে যেসব প্লট বরাদ্দে অনিয়ম হয়েছে, তাই বাতিল করা হবে। কারণ, যা নিয়মমাফিক বরাদ্দ হয়েছে বা বরাদ্দগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধ করেছে, তা বাতিলের আওতায় আনা ঠিক হবে না।’
বাতিল হতে পারে আইনের ১৩/এ ধারা: টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৩ অনুযায়ী সংরক্ষিত কোটায় বিভিন্ন সময় বরাদ্দ করা প্লটগুলো নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দেয়। যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়, তারাই নিজেদের দলের ও পছন্দের লোকজনকে প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দিয়ে থাকে। ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ধারাটি বাতিলের জন্য কাজ করছে বলে নিশ্চিত করেছে দায়িত্বশীল সূত্র।
Ajkaler Patrika