এ বছর অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনীগুলোকে ইতোমধ্যে আবেদনের ভিত্তিতে স্টল-প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হলেও ‘আদর্শ’ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে না বাংলা একাডেমি। স্টল না দেওয়ার অজুহাত হিসেবে ফাহাম আব্দুস সালাম রচিত ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়। বইটির প্রকাশক আদর্শ। এদিকে এই বিতর্কের মধ্যে বইটির বিক্রিও বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ‘আদর্শ’র প্রকাশক।
বইটি বিক্রির বিষয়ে প্রকাশনা সংস্থা ‘আদর্শ’র প্রধান নির্বাহী মাহাবুব রাহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ফাহাম আব্দুস সালামের বইটি খুবই কম মানুষ পড়েছিল, বিক্রিও ছিল কম। তবে বাংলা একাডেমির এমন সিদ্ধান্তে বর্তমানে বইটির বিক্রি বেড়েছে অন্তত ১০ গুণ।
একইসঙ্গে প্রকাশক মাহাবুব রাহমান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই বইটি নিষিদ্ধেরও চেষ্টা করছে একটি মহল। আর এমন ঘটনা ঘটলে বইটির পিডিএফ কপি অসাধু চক্র অনলাইনে ছড়িয়ে দেবে। এতে আমি ব্যবসায়িকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বর্তমান অবস্থায় আমার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে—এ বইটি যারা কিনছেন, তারা তাদের বন্ধুবান্ধবদেরও পড়তে দিচ্ছেন। অর্থাৎ, বইটির ক্রেতার চেয়ে ভোক্তার সংখ্যা ২-৩ গুণ বেশি।
তিনি আরও বলেন, ‘আজকের দুনিয়ায় বই নিষিদ্ধ করা যায় না। আর বই বিক্রি বন্ধ আরও সম্ভব না। এই বিবেচনায় আদর্শকে স্টল যে দেওয়া হলো না—সেটাকে আমি সমর্থন করি না। এর আগে রোদেলা, শ্রাবণ প্রকাশনীর সঙ্গেও এমন করা হয়েছিল। এটাকে আমি স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করি। এটা গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে না। যারা মেলা পরিচালনায় আছেন, এটি তাদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’
কোনও বই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষিদ্ধ না হলে বাংলা একাডেমি কোনও বইয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে কিনা, এই বিষয়ে ব্যারিস্টার অনীক আর হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০২৩-এর স্টল নীতিমালায় আছে—যদি কোনও নিষিদ্ধ বই বা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, এমন বই যদি কোনও স্টলে বিক্রি করা হয়, তাহলে বাংলা একাডেমি সেই স্টলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু মেলা শুরুর আগেই তারা স্টলই বরাদ্দ দেবে না—এমন কোনও সিদ্ধান্ত বাংলা একাডেমি নিতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত তার পরিপন্থি বলে আমি মনে করি। যে বই নিষিদ্ধ না, সেই একটি বইয়ের জন্য পুরো প্রকাশনার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে না।’
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারিতে স্টল বরাদ্দের একটি তালিকা প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। এই তালিকা ধরেই পরবর্তী সময়ে লটারির মাধ্যমে স্টলের নম্বর বা জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই তালিকার কোথাও ‘আদর্শ’ প্রকাশনীর নাম ছিল না। এ বিষয়ে আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী মাহাবুব রাহমান বাংলা একাডেমির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেও কোনও তথ্য পাননি।
এ বিষয়ে মাহাবুব রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার থাকায় বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিতে পারিনি। ১৫ জানুয়ারি রবিবার আমি বাংলা একাডেমিতে গেলে মেলা কমিটির সচিব ডা. কে এম মোজাহিদুল ইসলাম আমাকে বললেন, তার কাছে এ বিষয়ে কোনও কাগজপত্র নেই। তারপর আমি ডিজি মহোদয় বরাবর একটা চিঠি দিয়ে আসি। পরে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি—আদর্শকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না।’
প্রকাশককে কেন স্টল দেওয়া যাচ্ছে না, সেটি নিয়ে সরাসরি কথা বলা যেতো কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নিজে তার সঙ্গে কথা বলেছি। সচিব হিসেবে আমার এবার প্রথম মেলা। আমি চাইনি এরকম কিছু ঘটুক। উনি শুনতে রাজি হননি।’
বাংলা একাডেমির বিবৃতি ও ‘আদর্শ’র অবস্থান
বাংলা একাডেমি ২২ জানুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলা একাডেমি এখনও কাউকে স্টল বরাদ্দ দেয়নি। তবে অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানার পর ফাহাম আব্দুস সালাম রচিত ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটি সংগ্রহ ও পাঠ করে। এরপর কমিটি দেখতে পায়—বইমেলা ২০২৩-এর ‘নীতিমালা ও নিয়মাবলি’-এর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ১৪.১৪, ১৪, ১৫-এ বর্ণিত শর্তাবলি পূরণে সক্ষম হয়নি।
এ বিষয়ে আদর্শের প্রকাশক মাহাবুব রাহমান বলেন, ‘১২ জানুয়ারি স্টল বরাদ্দের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। সাধারণত স্টলের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, সে তালিকা থেকে পরবর্তী সময়ে লটারির মাধ্যমে স্টলের নম্বর বা জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই তালিকার কোথাও আদর্শ’র নাম ছিল না।’
বইমেলা ২০২৩-এর নীতিমালা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৪.১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়ে— বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনও বই বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে— আপনি তো আমাকে স্টলই দেননি এবং ফেব্রুয়ারি মাসও আসেনি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমার স্টল বরাদ্দ বাতিল করা হলো।’
কোনও প্রকাশনী সংস্থাকে যদি স্টল দেওয়া না হয়, সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় কিনা—এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি ২০২৩’-এর সদস্য রামেন্দু মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকেই বোঝা যায় কে থাকছে আর কে থাকছে না।’
আদর্শ প্রকাশক মাহাবুব রাহমান ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে অভিযোগ করেন–যারা তার বইটি নিয়ে বাংলা একাডেমিকে পৌঁছে দিয়েছে, তাদের দুজন হলেন তাম্রলিপি প্রকাশনীর প্রকাশক তরিকুল ইসলাম রনি ও অন্বেষা প্রকাশনের প্রকাশক শাহাদাত হোসাইন। এর আগেও ২০১৯ সালে আদর্শ প্রকাশনীর স্টল স্থগিত রাখে বাংলা একাডেমি। তখনও মাহাবুব রাহমান পরোক্ষভাবে তাম্রলিপি প্রকাশককে অভিযুক্ত করেন।
কেন এই দুই জন আদর্শের প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহাবুব রাহমান বলেন, মেলা কমিটিতে থাকা একজন প্রকাশক প্রতিনিধি আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আমাকে নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমরা রনি (তাম্রলিপির প্রকাশক) ও শাহাদাতকে (অন্বেষা প্রকাশক) বাংলা একাডেমিতে ডেকে আনিয়েছি। তাদের আমরা জিজ্ঞাসা করেছি—যে বই সরকার নিষিদ্ধ করেনি, সেই বই কেন তোমরা বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছো।’
এ বিষয়ে তাম্রলিপির প্রকাশক তরিকুল ইসলাম রনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি প্রতিবেদককে বাংলা একাডেমির কাছ থেকেই সবকিছু জেনে নিতে পরামর্শ দেন। তারপরও মাহাবুব রাহমানের অভিযোগ নিয়ে তার কোনও বক্তব্য আছে কিনা, প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনি কার কাছ থেকে কী অভিযোগ শুনেছেন, সে বিষয়ে আমি জানি না। আমি এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
একই অভিযোগের বিষয়ে অন্বেষা প্রকাশনের প্রকাশক শাহাদাত হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে তার মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কোনও সাড়া দেননি।
প্রকাশনী সংস্থা আদর্শ’র স্টল বরাদ্দ বাতিলের জন্য অন্য দুই জন প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির উপদেষ্টা ওসমান গনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সগোত্রীয় কারোর বিরুদ্ধে এভাবে অভিযোগ করা দুঃখজনক। এরকম বই হয়তো অনেক আছে। ওদের দুজনের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার, সেটা পাবলিকলি করেছি।
বইমেলা কর্তৃপক্ষ যদি প্রকাশককে ডেকে কথা বলতো, তাহলে সমস্যার সমাধান অন্যরকম হতে পারতো কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘শুরুতে আদর্শের প্রকাশককে ডেকে কথা বলেছেন সদস্য সচিব। কিন্তু তখন এই তিন বই বাদ দিয়ে মেলায় তিনি যোগ দিতে চাননি।’
যদিও ২৪ জানুয়ারি আদর্শের প্রকাশক বাংলা একাডেমির কাছে একটি আবেদন করেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, বাংলা একাডেমি যে বইটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, সেটি তিনি মেলায় রাখবেন না। তারপরও ২৯ জানুয়ারি একাডেমি থেকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়—আদর্শ স্টল বরাদ্দ পাচ্ছে না।
একই বিষয়ে অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি ২০২৩-এর সদস্য রামেন্দু মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরুতে যখন আপত্তি জানানো হয়েছে— তখন তো তিনি (আদর্শ প্রকাশক) রাজি হননি। ২৪ জানুয়ারি তিনি একটি চিঠি দিয়েছেন, তবে নীতিমালার বিষয়ে সেখানেও প্রশ্ন তুলেছেন। সংশোধন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এখন তো আর স্টল বরাদ্দ দেওয়ার কোনও উপায় নেই।’
একজন প্রকাশককে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে সমাধানের কোনও চেষ্টা করা হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি ও বইমেলা স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক শ্যামল পাল বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি। কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি উঠেছিল। আমরা সেটা সমাধান হয়ে যাবে বলার পরেও মাহাবুব নানা অ্যাকটিভিজম চালিয়ে গেছে। যখন স্বাধীনতাবিরোধী বা বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করার মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়—তখন তার পক্ষে আমাদের কণ্ঠ জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারিনি।’
এদিকে কলকাতা বইমেলায় যেন ফাহাম আব্দুস সালামের বইটি বিক্রি থেকে বিরত থাকে, সে বিষয়ে ৩০ জানুয়ারি আদর্শকে একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। এ ধরনের চিঠি তারা কোনও প্রকাশককে দিতে পারেন কিনা, সে বিষয়ে শ্যামল পাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন বইটা নিয়ে সমালোচনা চলছে, তখন কলকাতায় এই বই নেওয়া হলে, বিতর্কিত হতে পারে। যে কারণে পুরো বাংলাদেশ স্টলটাই যদি বন্ধ করে দেয়, সেই শঙ্কা থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’