রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১২৭-এর (বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২) বলে ১৯৭২ সালে পরিপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে যাত্রা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুরু থেকেই দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বিবেচিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নামেই, বাস্তবে এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান।’
এর মধ্যে ধারা ১০ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা গভর্নরের ওপর ন্যস্ত। আর সরকার চার বছরের জন্য যে কাউকে গভর্নর নিযুক্ত করতে পারেন। মেয়াদ শেষে তার পুনর্নিয়োগের সুযোগও আছে। আর আদেশের ১৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নর যদি এমন কোনো কাজ করে থাকেন, যাতে তার ওপর প্রদত্ত আস্থা লঙ্ঘিত হয় অথবা যদি তার স্বীয় পদে বহাল থাকাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তাহলে সরকার তাকে অপসারণ করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তথা দেশের ব্যাংক খাতের নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ। আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যদের নিয়োগ দেয় সরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশের ৭৭ ধারায় দেয়া ক্ষমতাবলে সরকার চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ বাতিলও করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বাধ্যবাধকতা পালনে ব্যর্থ হয়েছে, এমনটি মনে করলেই হলো। আদেশের ৮২ (২) ধারা অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীদের বাজেট, বেতন এবং ক্ষতিপূরণও সরকারের অনুমোদনসাপেক্ষে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ-১৯৭২-এর ৩৮ (এ) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। যদিও গত এক যুগে কোনো গভর্নর সংসদের জবাবদিহিতার মুখে পড়েছেন, এমন নজির দেখা যায় না। এ অবস্থায় আইনি সীমাবদ্ধতাগুলো পর্যালোচনার ভিত্তিতে আইএমএফ বলছে, নীতিগত সমন্বয় জরুরি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনকে অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে গত ২৮ জুন ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিপোর্ট’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমএফ। ২০২৩ সালের ১৩-১৭ আগস্ট সংস্থাটির সাউথ এশিয়া রিজিওনাল ট্রেনিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স সেন্টারের (এসএআরটিটিএসসি) প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শনের পর সে আলোকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এ প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আইনি সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরা হয়। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান কার্যপদ্ধতির মূল্যায়ন করে বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইনে যে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া হয়েছে, সেটিও কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়েও এখন দেশের ব্যাংক খাতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
১৯৯৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ব্যাংক খাত পরিচালনা ও নীতি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা শুধু আইনের বিষয় নয়। যে আইনগুলো আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে, সেটি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আইন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু যারা পদে আছেন, তাদের মানসিকতার ওপর আইনের যথাযথ প্রয়োগ নির্ভর করে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আইনি কাঠামো তৈরি না করেই আশির দশকে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এটি ছিল বড় ধরনের ভুল। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাংকগুলো খারাপ হয়ে যায়। এ নিয়ে ২০০২ সাল-পরবর্তী সময়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। বেসরকারি ব্যাংকের ৭০ জন পরিচালককে ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এর অন্যথায় পরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ওই সময় ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল, পরিচালকদের মেয়াদসহ বেশকিছু বিষয়ে আইন-কানুন শক্ত করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ভালো পথে চলতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু গত দেড় দশক ব্যাংক খাত ক্রমাগত খারাপের দিকে গেছে।’
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরেও এসএআরটিটিএসসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যপদ্ধতি মূল্যায়ন করে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, এসএআরটিটিএসইর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এসএআরটিটিএসইর মূল্যায়নের পর থেকে স্বায়ত্তশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাসন ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ সংশোধন করা হলেও সংস্থাটির সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন সীমিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারের ১০, ১৫ ও ৭৭ নং বিধান অনুসারে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ করতে পারে। সে সঙ্গে এ আদেশের ৮২ নং ধারা অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্রাধিকার খাতে (গ্রামীণ ক্রেডিট ফান্ড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ফান্ড, এক্সপোর্ট ক্রেডিট ফান্ড) ঋণ দেয়ার জন্য আর্থিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশের বিধানগুলো পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। আধা-আর্থিক প্রকৃতির এ ধরনের কর্মকাণ্ড তারল্য ব্যবস্থাপনাকে জটিল এবং আর্থিক নীতির প্রচারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে এগুলো নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। সে সঙ্গে এ স্কিমগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এমন যেকোনো ভর্তুকি আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে আরো ভালোভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে।
আইএমএফ বলেছে, সুদহারসংক্রান্ত তিন ধরনের রেট বা হারের সহাবস্থান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। এ তিন ধরনের রেট হচ্ছে ব্যাংক রেট, পলিসি রেট ও ‘স্মার্ট’ (এর মধ্যে ‘স্মার্ট’ সুদহার বাজারভিত্তিক করে দেয়ায় বাতিল হয়ে গেছে’)। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশের ২১ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয় ব্যাংক রেট। এছাড়া বিধিবদ্ধ সংরক্ষিত তারল্য (সিআরআর) সম্পর্কিত শাস্তির ভিত্তি হিসেবেও এটি কাজ করে। পলিসি রেট হলো নতুন মুদ্রানীতির অংশ। অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় চালু করা হয়েছিল ‘স্মার্ট’। দাপ্তরিক কাজে এমন কয়েক ধরনের হার থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ জটিল হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মত না হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্ট আইনি স্বাধীনতা আছে। তবে সে আইনের বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে না।
এ অর্থনীতিবিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের চাওয়ার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হচ্ছে। ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে আমরা সেটির প্রতিফলন দেখছি। ব্যাংক খাত থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ চাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটিই ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। অথচ সরকারের কথা না শোনার জন্য আমাদের কোনো গভর্নরকে পদচ্যুত করা হয়েছে, এমন নজির নেই।’
আইনে বাংলাদেশ ব্যাংককে জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের জবাবদিহিতা দৃশ্যমান নয় কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গভর্নর থাকা অবস্থায় আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে হাজির হয়েছি। সে সময় স্থায়ী কমিটিগুলোর যথেষ্ট তৎপরতা ছিল। কিন্তু এখন কমিটিগুলোর কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন আছে। গভর্নর যদি সংসদের কাছে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জবাবদিহির বিষয়ে বাধ্য হতেন, তাহলে দেশ উপকৃত হতো।’
স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করা ধারাগুলো সংশোধনের বিষয়ে সুপারিশ করেছে আইএমএফ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা দরকার। প্রকৃতিগতভাবে এটি স্বায়ত্তশাসিত হলেও এর আর্থিক নীতি পরিচালনায় সরকারের ভূমিকা সম্পর্কিত আইনি বিধানগুলো কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এসব অনিশ্চয়তা বাজারের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশের বিধানগুলো সংশোধন করা দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জবাবদিহির কাঠামোও উন্নত করা দরকার বলে মনে করে আইএমএফ। এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। তবে এর আর্থিক নীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্যের অনুপস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে জটিল করে তুলেছে। একবার মুদ্রানীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশে অন্তর্ভুক্ত জবাবদিহিতার বিধানগুলো মেনে চলতে হবে। এছাড়া অগ্রাধিকার খাতে সরাসরি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পৃক্ততা দূর করা উচিত বলেও মনে করে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, রাজস্ব নীতির মাধ্যমেই সরকারের এ নীতিগুলো স্বচ্ছ ও ভালোভাবে কাজ করতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক রেটকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। শুধু একটি অফিশিয়াল রেট থাকলে আর্থিক ব্যবস্থাপনা সহজতর এবং তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এ ধরনের সংস্কার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত নতুন প্রবর্তিত পলিসি রেটে জোর দিয়ে ব্যাংক রেটের ভূমিকা কমানো উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আইনে থাকলেও “লিডারশিপ” যদি স্বাধীনচেতা না হয়, তাহলে কোনো প্রতিষ্ঠানই স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগে যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নেই। সরকার যে কাউকে এখানে গভর্নর পদে নিয়োগ দিতে পারে। স্বায়ত্তশাসন বিষয়টি আইনি কাঠামো চেয়েও চর্চার বিষয়। আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে, তারচেয়েও বড় সীমাবদ্ধতা হলো আমাদের মননে। যে যেভাবেই বলুক, বাংলাদেশের মতো দেশে সরকার না চাইলে গভর্নর পদে থাকা যায় না।’
Bonik Barta