Site icon The Bangladesh Chronicle

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস: ২০২৩ সালে বিদেশী ঋণ দাঁড়াবে ১১৫ বিলিয়ন ডলারে

bonikbarta.net

হাছান আদনান

অক্টোবর ১৮, ২০২২

আগামী বছর শেষে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আর ২০২৪ সাল শেষে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ে করা এক পর্যবেক্ষণে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ নিয়ে এ পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২১ সালে সুদসহ দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশকে দ্বিগুণ বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২২ সাল শেষে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ঠেকবে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়েও প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট শুরুর পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল চলতি বছরের শুরুতেই। জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর খোলা আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬২ কোটি ডলারে। ফেব্রুয়ারিতে এলসি খোলা কিছুটা কমলেও মার্চে সেটি ৯৮০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এক মাসেই প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়ে গেলে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি কমাতে সক্রিয় হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ। বিভাগটির পক্ষ থেকে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট মুভমেন্ট’ নামে একটি প্রকাশনা তৈরি করা হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সৃষ্ট সংকটের কারণ নির্ণয় এবং সেটি থেকে উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশের রেকর্ড ১৭ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ তৈরি হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত এ ঋণ নিয়েছে। রেকর্ড এ বিদেশী ঋণের ৫৭ শতাংশই তৈরি হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের দায় বিলম্বের কারণে। এ সময় নভেল করোনাভাইরাসসৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের কারণে আমদানি দায় পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২১ সালের মোট আমদানি দায়ের ৩০ শতাংশ বিদেশী ঋণে রূপ নেয়। আমদানি দায় অপরিশোধিত থাকার কারণে স্বল্পমেয়াদি এ বিদেশী ঋণ সৃষ্টি হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকট সৃষ্টির প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশগুলোর একটি। করোনার আগের পাঁচ বছর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় ছিল ৭ শতাংশ। জিডিপির এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। রাজস্ব থেকে অর্থের সংস্থান না হওয়ায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েও এ সময়ে বিনিয়োগ করা হয়। এ কারণে দেশের জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সঞ্চয় ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও বিনিয়োগ হয়েছে ৩১ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগের বড় এ ব্যবধানই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

গত কয়েক বছর কৃত্রিম উপায়ে ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা। অনেক আগে থেকেই ডলারের বিনিময় হারকে মুদ্রাবাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের প্রতিবেদনেও একই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

চলতি বছরের এপ্রিলের বাজার বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময় নমিনাল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (এনইইআর) ভিত্তিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৭ টাকা ৭২ পয়সা। অন্যদিকে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের (আরইইআর) ভিত্তিতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৬ টাকা ৩৮ পয়সা। যদিও ওই সময়ে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকায় নির্ধারণ করে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের প্রতিবেদনটি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকটের আভাস তারা চলতি বছরের শুরুতেই উপলব্ধি করেছিলেন। ওই সময় বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছিল। তবে সে সময় বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিলের তথ্যের ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এতে সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান সংকট ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে পাঁচ ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের সুপারিশ তুলে ধরে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ। এতে বলা হয়, বিদেশী ঋণ গ্রহণ এবং সেটি পরিশোধের নীতির বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পাদন ও জাহাজীকরণের ব্যয় কমানোর জন্য বিকল্প পথ বের করতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের ভিত্তিতে তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক এলসি নিশ্চয়তার ফি কমানোর বিষয়েও। আমদানি নীতিও পুনর্বিবেচনার পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার যৌক্তিক অবমূল্যায়নের বিষয়েও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।

বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে এরই মধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে প্রায় অর্ধেকে। আবার ডলারের বিনিময় হারও বাজার পরিস্থিতির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাওয়া বিদেশী ঋণ পুনঃতফসিল বা মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়ার বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তিন মাসের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিস্থিতি ধরে রাখা সম্ভব হলে আগামী বছর ডলার সংকট অনেকটাই কমে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিদেশী উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারের নেয়া ঋণের চেয়েও এ সময়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বেসরকারি খাতে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশী উৎস থেকে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। বিপুল অংকের এ ঋণের ৭৩ শতাংশ সরকারের। বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের জুন শেষে বিদেশী এ ঋণের পরিমাণ ২৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় বেসরকারি খাতে বিদেশী এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকারও বেশিতে (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা দরে)। বিপুল অংকের এ ঋণের অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে করোনা মহামারীর দুই বছরে। ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণের ৬৮ শতাংশই স্বল্পমেয়াদি।

বেসরকারি খাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের। এর মধ্যে ৪১০ কোটি ডলার নিয়েছেন বিদ্যুৎ খাতের ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ কোম্পানি ছাড়াও রফতানি আয় নেই এমন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ডলারের সংকট ও দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতির অজুহাতে বিদেশী ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করতে চাচ্ছেন। এ অবস্থায় অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণের অর্থ জোগানদাতা ব্যাংকগুলোও বিপদে পড়েছে। আর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে সরাসরি বিদেশী ঋণ নিয়ে আসা কোম্পানিগুলোও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।

রেকর্ড এলসি দায় পরিশোধের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দিশেহারা পরিস্থিতি পার করছে দেশের ব্যাংক খাত। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তীব্র ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক চাইলেও যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার বিদেশী ঋণের কিস্তির ডলার সংস্থান করতে পারছে না কিছু ব্যাংক। এ অবস্থায় প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করেছে প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও গত বছরের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত প্রতি ডলারের দর ছিল ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও দেশের খুচরা বাজারে এ দরে ডলার মিলছে না। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ১১৬ টাকারও বেশি। স্বল্প সময়ে টাকার অস্বাভাবিক এ অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশী উৎস থেকে ডলারে ঋণ নেয়া ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে যে প্রতিবেদনটি দেয়া হয়েছে, সেটির কিছু সুপারিশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রতিনিয়তই মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই সতর্ক।

Exit mobile version