Site icon The Bangladesh Chronicle

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ভোট দেখাল মার্কিন তেজ আগের মতো নেই

পাকিস্তানে ইমরান খানের সমর্থকেরা বিভিন্ন আসনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন।
পাকিস্তানে ইমরান খানের সমর্থকেরা বিভিন্ন আসনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন।ছবি : রয়টার্স

 

এক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল এবং দুই দেশেই শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত খেলায় হেরে গেছে। কারণ, দুই দেশেই নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ও অবস্থানের বাইরে। আর এতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরাজয় এখন অনেকটাই স্পষ্ট।

দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের নির্বাচনের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ফাঁকা, আর পাকিস্তানের ভোটকেন্দ্রগুলোয় দিনভর ভোটারদের সারিবদ্ধ উপস্থিতি।

ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে বিপরীত চিত্র থাকলেও এই দুই দেশের নির্বাচনে জনমতের খুব বেশি প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভোট দিতে যায়নি বা ভোট দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। বাংলাদেশে একপক্ষীয় নির্বাচন হয়েছে বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করায়। কিন্তু পাকিস্তানে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল। জনসাধারণ ভোটও দিয়েছেন কিন্তু ফলাফলে জনমত প্রতিফলিত হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিশেষ করে কারাবন্দী ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পাকিস্তান (পিটিআই)-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসনে( কমবেশি ১০০) জিতলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা আরও বেশি আসনে জিতেছেন বলে দাবি করেছেন দলের নেতারা। ইমরান খানের সমর্থকেরা বিভিন্ন আসনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন।

কারাবন্দী ইমরান খান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এক ভাষণে দাবি করেছেন, পিটিআই ১৭০টি আসনে জিতেছে।

নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ের তথ্য আসতে থাকলে নির্বাচন কমিশন ফলাফল ঘোষণা স্থগিত রাখে। শুরুর দিকে পিটিআইয়ের নেতারা দাবি করেছিলেন, ১৬০টির মতো আসনে তাঁরা এগিয়ে আছেন। এরপরই ধীর গতিতে ফলাফল ঘোষণা করতে থাকে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। আর এ সময় পিটিআইয়ের আসন কমতে থাকে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ও আসিফ আলী জারদারির পিপলস পার্টির আসন বাড়তে থাকে। রাতের আঁধারে পাকিস্তানে নির্বাচনের ফলাফল ঘুরে গেছে অনেকটাই। নানাভাবে সেনা-সমর্থিত পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এন (পিএমএল-এন)-কে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেওয়ার চেষ্টা করছে পাকিস্তানের প্রশাসন। কিন্তু কোনোভাবেই তারা পিএমএল-এনকে টেনে তুলতে পারেনি।

বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনকে পাকিস্তানের কমিশনের মতো এত কষ্ট করতে হয়নি। ভোটাররা ভোটকেন্দ্র বা নির্বাচন কমিশনের অফিস ঘেরাও করে রাখেননি। দ্রুতই নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেছে কমিশন। আমাদের এখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যা হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

এই ধরনের একটি একপক্ষীয় নির্বাচন কোনোভাবেই জনমতের প্রতিফলন বলে মনে করা যাবে না।

এসব ঘটনার বাইরে এই দুই দেশের নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হচ্ছে মার্কিন নীতির পরাজয়। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দুর্দিন চলছে। আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর ইউক্রেনেও সুবিধা করতে পারেনি। বরং ইউক্রেনকে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বেহাত হয়েছে ইউক্রেনের ভূমি। রাশিয়া ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে বসে আছে।

সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধেও সুবিধা করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের উপস্থিতি ও প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই সেখানে একটু একটু করে চীনের কাছে জায়গা হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নিজেদের অবস্থান সংহত করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাববলয় বৃদ্ধির বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুই দেশের নির্বাচন ও সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব অবস্থান বলে আর কিছু থাকছে না।

মালদ্বীপে চীনপন্থী মোহামেদ মুইজ্জু ক্ষমতায় এসেছেন। শ্রীলঙ্কাতেও চীনপন্থীদের শক্ত অবস্থান আছে। আর বাংলাদেশের সরকারের দীর্ঘ মেয়াদের শাসনের প্রতি রয়েছে ভারত ও চীনের প্রত্যক্ষ ও জোরালো সমর্থন। বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পরাজয় হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।

পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষয়ে যাওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠেছে। ক্ষমতাচ্যুতির জন্য ইমরান খান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছিলেন। ইউক্রেন সংকট শুরুর দিকে ইমরান খান মস্কো সফর করেছিলেন। চীনের মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনার বিষয়ে ইমরান খানের আগ্রহ ছিল। ইমরান খান ক্রমেই রাশিয়া, চীন, ইরান অক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন। মূলত এখান থেকেই মার্কিনদের সঙ্গে ইমরান খানের দ্বন্দ্বের শুরু ও ক্ষমতাচ্যুতি।

যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবসুলভ কৌশলে পাকিস্তানের সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ইমরান খানের গদিচ্যুতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকলেও পেছন থেকে যুক্তরাষ্ট্রই সব কলকাঠি নেড়েছে বলে পিটিআইয়ের সমর্থকেরা বিশ্বাস করেন।

সেই ইমরান খানের নির্বাচনে প্রবলভাবে ফিরে আসা মার্কিন নীতির বড় পরাজয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।

গত দুই-আড়াই বছরে বাংলাদেশে মার্কিনদের সক্রিয়তা ছিল লক্ষণীয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাই ঢাকা সফর করেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বারবার কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুন্নকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলেছে।

কিন্তু দেখা গেল র‍্যাবসহ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে নিজেদের মতো নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগকে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটেও নিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ দিব্যি এককভাবে নির্বাচন করে সরকার পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতির ওপর বড় ধরনের পরাজয়ের চিহ্ন একে দিয়েছে।

 

বাংলাদেশের নির্বাচন ও পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতির ওপর বড় ধরনের পরাজয়ের চিহ্ন একে দিয়েছে। পাকিস্তানে সারিবদ্ধ ভোটারের উপস্থিতি ও আমাদের এখানে দিনভর ফাঁকা ভোটকেন্দ্র মার্কিন নীতির বেহাল অবস্থাই তুলে ধরেছে।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল সেনা-সমর্থিত নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু সেখানে ভোটাররা দল বেঁধে ইমরান খান-সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। আর আমাদের এখানে চেয়েছিল যেন সবাই ভোটকেন্দ্রে যান। কিন্তু ভোটকেন্দ্র ফাঁকা রেখেই আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার বাইরে গিয়ে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করে ফেলেছে।

ফলে সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখন খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি নতুন করে ভারত নির্ভর হয়ে পড়ছে বলে মনে হয়। যে কারণে ভারত ও চীনের কৌশলের কাছে মার্কিন কৌশল পরাজিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আমাদের এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। অথচ এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারত ও চীনের বড় ধরনের ভূমিকা প্রকাশ্যেই ছিল। এই দুই দেশ রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে। বলা যায় ভারতের কূটনীতির কাছে যুক্তরাষ্ট্র নতি স্বীকার করেছে। আর পাকিস্তানে চীন, রাশিয়া ও ইরানের কাছে পরাজয় ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের।

দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারেও মার্কিন নীতির পরাজয় ঘটেছে। বার্মা অ্যাক্ট করে যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কারভাবে মিয়ানমারের সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সঙ্গেও নিরবচ্ছিন্ন আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি।

বরং মিয়ানমারের বিদ্রোহী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে চীনের আস্থার জায়গা ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সামরিক শাসক ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী—উভয়ের সঙ্গেই চীন ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছে এবং সময়ের অপেক্ষা করছে। যারাই মিয়ানমার নিয়ন্ত্রণ করবে, তাদের সঙ্গেই চীন কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখবে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতনির্ভরতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র বের হতে পারছে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমেছে। আর ভারতের সঙ্গে সখ্য যুক্তরাষ্ট্রকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পিছিয়ে দিয়েছে।

এই সুযোগে বেড়েছে চীনের প্রভাব। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম বিশ্বস্ত রাজনৈতিক মিত্র আওয়ামী লীগকেও চীন নিজেদের আয়ত্তে আনতে পেরেছে অনেকটাই। রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপিকে বাদ দিয়ে চীন আওয়ামী লীগকে হাতে রাখতে চাইছে। এখানেও চীন সফল হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ ও ক্ষয়িষ্ণু।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকপ্রথম আলো
Exit mobile version