‘কোয়াড’-এর মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবাধ, মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ বজায় রাখতে উভয় দেশের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির ওপরও তাঁরা জোর দেন। মূল বিষয়ের মধ্যে আরও ছিল নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব, অস্ত্র ক্রয় ও নির্মাণে সহযোগিতা, আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিস্থিতি, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন, আফগানিস্তান, সন্ত্রাসবাদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা আর দুই দেশের জনগণের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি দুই দেশের প্রতিশ্রুতির কথাও ছিল, তবে যা ছিল না তা হলো বাংলাদেশ ও তার আশু নির্বাচন প্রসঙ্গ।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র—দুটি দেশেরই বাংলাদেশের আশু নির্বাচন নিয়ে চিন্তাভাবনা ও বেশ খানিকটা উদ্বেগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এ ব্যাপারে স্পষ্ট, তারা এখানে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় এবং তা নিশ্চিত করতে তারা বাংলাদেশ সরকারের ওপর বহুবিধ চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। শুধু গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা বা বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নই তাদের উদ্দেশ্য—এমনটি ভাবা উচিত হবে না। তাদের এ অবস্থানের পেছনে অবশ্যই ভূরাজনৈতিক বিবেচনা ক্রিয়াশীল।
পক্ষান্তরে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের জন্য বাংলাদেশের নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এ বিষয়ে ভারত বরাবরই ভূমিকা রেখে আসছে। চীনের দ্রুত বর্ধনশীল প্রভাব নিয়ে ভারতের ভাবনা অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ। তবে তার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলবেই, এমনটা নয়।
আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের আরও হিসাব-নিকাশ আছে। সে যা-ই হোক, যেহেতু উচ্চপর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ হচ্ছে এই দুই শক্তিমান দেশের মধ্যে, বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের আলোচনায় থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। যৌথ ঘোষণায় এ নিয়ে কিছু না থাকায় অনেকেই সংশয়ে পড়েছিলেন।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে দুটি দেশের আলোচনার পর প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে শুধু মতৈক্য হয়েছে এমন বিষয়গুলোই স্থান লাভ করে। দুই দেশের চার মন্ত্রীর আলোচনায় যে বাংলাদেশের নির্বাচন ছিল এবং এই ইস্যুতে যে মতৈক্য হয়নি, তা স্পষ্ট হয়ে যায় এর পরপরই।
দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের জানান যে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে আমরা জানিয়েছি।’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার সঙ্গে যে ভারত একমত নয় এবং বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পাশে তাদের অবস্থানের যে পরিবর্তন ঘটেনি, যুক্তরাষ্ট্রকে সেই বার্তা দিয়ে দিয়েছে ভারত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পছন্দ করছে না দেশটি।
তবে ভারতের এই অপছন্দে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে বা আসবে, তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দিল্লিতে যখন সংলাপ চলছে, মোটামুটি একই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক ব্রিফিংয়ে উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল জানান, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের এই স্পষ্ট অবস্থানের কী প্রভাব হবে বাংলাদেশে? র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন অনেকটা কমেছিল। বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করারও সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল, যদিও যেকোনো কর্মসূচির পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগও একই দিনে ‘শান্তি সমাবেশ’ করেছে এবং পুলিশ ও দলীয় কর্মীরা বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগমে বাধা দিয়ে গেছে। এসব উসকানি সত্ত্বেও সমাবেশগুলো মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়।
তবে পুরো চিত্র বদলে যায় ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ক্ষেত্রে, পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারে সেদিনের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। নবোদ্যমে ধরপাকড় ও গায়েবি মামলা শুরু হয় এরপর। বিএনপির উচ্চ নেতৃত্বের বড় অংশ এখন জেলে আটক।
সরকারের হঠাৎ এই হার্ডলাইনে যাওয়া নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ১০ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যা বলেছেন, ‘তলেতলে’ তা হয়তো সরকার জেনেছে আগেই।
বাংলাদেশে অনেকেই ধারণা করেছিলেন (যা এখন ভুল বলেই মনে হচ্ছে) যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভূরাজনৈতিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সম্ভবত একটা ঐকমত্যে উপনীত হবে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে। বিশেষত বাংলাদেশ যেহেতু দৃশ্যমানভাবেই অনেকটা চীনের দিকে হেলে পড়ছে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত উভয়েই এ অবস্থার পরিবর্তন চাইবে। নিকট অতীতে অবশ্য আমরা দেখতে পাই, যতই বৈরিতা থাকুক, চীন ও ভারতের মধ্যে মিয়ানমার প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে একজোট হতে তাদের সমস্যা হয়নি।
ভারতের এই সুস্পষ্ট অবস্থান সরকারের জন্য একটি স্বস্তির কারণ হয়েছে অবশ্যই। ভারতের জন্য ঢাকায় একটি আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই কাম্য এবং ২০২৪ সালে একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পুনরায় ক্ষমতাসীন হোক, এটাই তারা আশা করছে। চীনও তা-ই চায়, রাশিয়াও সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর এখানে উল্লেখযোগ্য। ৫০ বছর পর তিনটি রুশ যুদ্ধজাহাজের একটি বহর চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করেছে। নভেম্বর ৭-৯ আন্দামান সাগরে মিয়ানমার নৌবাহিনীর সঙ্গে যৌথ মহড়া শেষে জাহাজগুলো বাংলাদেশে এসেছে। বন্ধুপ্রতিম দেশের নৌবাহিনীর জাহাজের এমন সৌজন্য সফর একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এত দীর্ঘদিন পর এ সময়ে এ সফরকে ঠিক কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ঘিরে তাহলে কি একটি সমীকরণ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যার একদিকে চিরশত্রু চীন-ভারত, সেই সঙ্গে উভয়ের বন্ধু রাশিয়া আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা?
সত্যি যদি তা-ই হয়, বাংলাদেশের জন্য তা হবে দুর্ভাগ্য আর দুর্ভোগের।
■ মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
প্রথম আলো