Site icon The Bangladesh Chronicle

বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্পনীতি

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপুল বিজয় দক্ষিণ এশিয়ায় কতটা কী প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ চলছে। জো বাইডেনের অধীনে মার্কিন প্রশাসনের অন্যতম মনোযোগের কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ এশিয়া। ‘বার্মা আইন’ পাসের মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রশাসন এ অঞ্চলে নিজেদের কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পরিচালিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া বাইডেন শাসনের চার বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকান নীতির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ দেখতে পেয়েছি আমরা। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকারের পতন হয়েছে। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্যেও পরবর্তী নির্বাচনে তার দল পিটিআইকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার এ সময়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। তবে এ নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় সরকার পরিচালনা করছে। ভারতে বিরোধী পক্ষ এখন পূর্ববর্তী দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। ভারতীয়দের ধারণা, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বাইডেনের সময় কৌশলগতভাবে নির্ভরতার মৈত্রীর পরিবর্তে যার যার সুবিধা মতো বন্ধুত্বের পর্যায়ে চলে আসে। ভারত একই সাথে কোয়াড ও ব্রিকসের সক্রিয় সদস্য হিসাবে দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের নামে দিল্লি সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রেখে চলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে।
একসময় ওয়াশিংটন দিল্লির চশমা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখার কথা বলা হলেও বাইডেন আমলে অন্য দেশগুলোর সম্পর্কে দিল্লি-ওয়াশিংটন যার যার স্বার্থের হিসাব-নিকাশ থেকে নিজেদের নীতি বিন্যাস করেছে। এটি বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের ক্ষেত্রে প্রায় সমভাবে সত্য। পাকিস্তান তার বিশেষ গুরুত্বের কারণে সব সময় ব্যতিক্রম ছিল।

ঢাকার জুলাই-আগস্ট বিপ্লব
বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ইন্দো-মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ বিপ্লবকে বাইডেন প্রশাসন কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান হিসাবে দেখলেও দিল্লির নীতি প্রণেতারা দেখেন ভিন্নভাবে। তারা ঢাকায় ভারতের মিত্র রাজনৈতিক শক্তির পতনে আমেরিকান ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত দেন আর সেই সাথে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের ভারতে আশ্রয় দেন।

ফ্যাসিবাদের পতনের পর ঢাকায় ক্ষমতাসীন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের সর্বাত্মক সমর্থন থাকলেও দিল্লির ভূমিকা অন্তর্বর্তী সরকারের বিপক্ষে দেখা যায়। এখন প্রশ্ন এসেছে, ডেমোক্র্যাট সরকারের বিদায়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন প্রশাসনের নীতি বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ায় পাল্টাবে কি না। এ কথা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশল এককভাবে প্রেসিডেন্ট নির্ধারণ করেন না। এতে সিনেট বা কংগ্রেসের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আবার প্রেসিডেন্ট চাইলে অনেক সময় পররাষ্ট্র কৌশলের নতুন অভিমুখ দিতেছেন এমন নজিরও বিভিন্ন সময় দেখা গেছে।

এ কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি পাল্টে যাবেÑ এমন ধারণা যেমন ঠিক নয়, আবার বাইডেনের নীতির প্রতিরূপ ট্রাম্প জামানায় আমরা আশা করতে পারি না। এ অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্প শাসনের প্রভাব বাস্তবে কতটা কী হবে সেটি বড় বিবেচ্য।

কিভাবে বুঝব ট্রাম্প কোন পথে
প্রথম ট্রাম্প শাসনে যে নীতি কৌশল অনুসৃত হয়েছে তার সাথে এবার নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প যেসব নীতি কৌশলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; তা মেলালে আমরা নতুন রিপাবলিকান শাসনে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকান নীতির ধরন মোটামুটি বুঝতে পারব।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে প্রধান দুই খেলোয়াড় হলো চীন ও ভারত। এই দুই দেশের সাথে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিপক্ষ রাশিয়ার নিজস্ব হিসাব-নিকাশ। তিনটি দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে প্রধান চ্যালেঞ্জ ব্রিকসের মূল স্থপতি দেশ। আমেরিকান ডলারের বিকল্প বৈশ্বিক মুদ্রা চালুর যে প্রক্রিয়া তাতেও কমবেশি তিন দেশ সমান্তরাল ভূমিকা পালন করছে।
আবার চীন ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত বিরোধ ও নানা প্রভাব বিস্তারের স্বার্থগত দ্বন্দ্বে দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় উত্তেজনামুখর হয়ে ওঠে। এ উত্তেজনাকর সম্পর্কে দিল্লি যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পেতে চায়। আবার যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে চীনকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করে। বেইজিংকে কনটেইন করতে ভারতকে পাশে রাখতে চায় ওয়াশিংটন। এসব বিবেচনার প্রভাব নিঃসন্দেহে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতিতে পড়বে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে অনুসৃত নীতি এবং এবারের নির্বাচনী প্রচারণা ও অন্যান্য বক্তব্যে তার পররাষ্ট্র সম্পর্কের সম্ভাব্য কিছু পদক্ষেপ দ্বিতীয় মেয়াদে অনুমান করা যায়। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে চীনের সাথে ট্যারিফ বা বাণিজ্যযুদ্ধ ট্রাম্প আবার শুরু করবেন। তিনি বিজয়ের পর প্রথম ভাষণে নিজেকে ‘ট্যারিফ ম্যান’ হিসাবে তুলে ধরে ঘোষণা করেছেন, চীনা পণ্যে শুল্ক ৬০ ভাগ এবং অন্য দেশের পণ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগ আরোপ করা হবে। আগের মেয়াদে চীনা পণ্যে পাইকারিভাবে শুল্ক আরোপ করে তিনি দেখিয়েছেন নতুন দফায় তার বক্তব্য কথার কথা হবে না। ট্রাম্প এমনটিও বলেছেন, শি জিন পিন তাকে ভালো করে চেনেন। শি জানেন ট্রাম্প ‘পাগলাটে’, যা বলেন তা করেন।
এ পর্যন্তকার বক্তব্যে মনে হয়, ট্রাম্প নতুন উদ্যমে চীনের সাথে বাণিজ্যযুক্ত শুরু করবেন। তবে এটি আমেরিকানদের বেশ খানিকটা প্রভাবিতও করবে। ট্রাম্পের জয়ের পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল বাইডেন জামানার ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। চীনা পণ্যে ৬০ শতাংশ আর অন্য দেশের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে আমেরিকান বাজারে সব কিছুর দামে উল্লম্ফন ঘটবে। সেটি ট্রাম্প যদি বিবেচনায় নেন তাহলে কিছুটা ধীরগতি নিতে পারেন।

এর পরও ট্রাম্প শাসনে চীনের সাথে যে একটি যুদ্ধংদেহীভাব থাকবে সেটি আমেরিকার স্থায়ী কৌশলগত সমীকরণের সাথেও মেলে। এখন প্রশ্ন হলো এই চীনবিরোধী ট্রাম্প মানস দক্ষিণ এশিয়াকে কতটা প্রভাবিত করবে। যে অঞ্চলটিতে বেইজিংয়ের প্রবল প্রভাব রয়েছে নানা কারণে। ভারতের মোদি সরকার নিঃসন্দেহে এর সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে। রাষ্ট্রীয় সমীকরণের বাইরে নরেন্দ্র মোদির সাথে ট্রাম্পের রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। মোদি সমর্থক উগ্রপন্থী হিন্দু ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানরা ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন যদিও তার প্রতিপক্ষ কমলা হ্যারিস একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী।

নতুন পথে দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্ক?
ট্রাম্পের প্রতি মোদির ব্যক্তিগত অনুরক্তি বাইডেনের সময় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে কিছুটা আচ্ছন্ন করেছিল। এবার সেটি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। তার একটি সঙ্কেত হলো বিজেপি নেতাদের সাথে সুর মিলিয়ে নির্বাচনী প্রচারের সময় বাংলাদেশে হিন্দু-খ্রিষ্টান নিরাপত্তার বিষয়ে ট্রাম্পের উদ্বেগ প্রকাশ।

ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ডিভিডেন্ট পেতে পারে। ট্রাম্পের সাথে পুতিনের নিজস্ব একটি হিসাব-নিকাশে রাশিয়ার সাথে দিল্লির বেশি মাখামাখি ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ককে যে প্রভাবিত করেছিল; তা কিছুটা পাল্টাতে পারে। গত সপ্তাহে, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও ট্রেজারি বিভাগ ‘রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধে সহায়তার জন্য’ ১৯টি ভারতীয় কোম্পানি এবং দুই ভারতীয় নাগরিকসহ প্রায় ৪০০টি সংস্থাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

১৯টি প্রাইভেট ফার্মের সাথে রয়েছে একটি ভিন্ন গল্প। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এ সংস্থাগুলো রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করতে প্রযুক্তি ও অন্যান্য উপাদান সরবরাহ করেছে। তাদের অনেকে বলে যে তারা নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খুব বেশি ব্যবসা করে না। এ ছাড়া ভারতীয় রুপিতে লেনদেনের অর্থ দেয়া হয়। তবে আমেরিকার এ নিষেধাজ্ঞার প্রভাবের চেয়ে প্রতীকী গুরুত্ব বেশি।

ট্রাম্পের আগমনে এ সম্পর্ক মৌলিকভাবে পাল্টাবে বলে মনে হয় না। বিজেপির কেউ কেউ এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন যে ট্রাম্প আসার অর্থ হলো দিল্লির দক্ষিণ এশিয়ার ইজারা পাওয়া। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণœœ করে এমন কিছু ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র করবে না।

বাংলাদেশ নিয়ে নতুন সমীকরণ
আমেরিকান দক্ষিণ এশিয়া নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের আনুকূল্যে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশবিরোধী ব্যাপক প্রচারণার পরও ওয়াশিংটন ঢাকায় প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যারা ভেতরের খোঁজখবর জানেন তারা বলেছেন, এ সমর্থনের ভিত্তি অনেক গভীর। এ গভীরতার কারণে ইউরোপ আমেরিকার পশ্চিমা বলয় ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে দাঁড়িয়েছে। ড. ইউনূসের প্রতি যখন শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছিল; তখন প্রফেসর ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিদাতা সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান দলে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটের প্রায় সমান সদস্য ছিলেন। ক্লিনটন পরিবারের সাথে ইউনূসের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের গভীর ক্ষমতা বলয়ের সাথে তার সংযোগ রয়েছে। ফলে ট্রাম্প আসার পর সব কিছু পাল্টে যাবে; এমন মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।

আমেরিকান বিশ্লেষক কুগেলম্যান তার লেখায় ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর ইউনূস প্রশাসন কিছুটা বৈরিতার মুখোমুখি হতে পারেন। তবে ঢাকার সাবেক মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত জন ডেনিলোভিজ সেটি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্ককে কৌশলগত বলে মন্তব্য করে বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য কর্মকর্তাদের সাথে ইউনূস সরকারের যোগসূত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বাইডেনের সাথে ইউনূসের ঘনিষ্ঠতা ট্রাম্পকে ঢাকায় পতিত স্বৈরাচারকে আবার ক্ষমতায় ফেরাবে এমন যেকোনো সম্ভাবনার কথা তিনি একেবারে নাকচ করে দেন।

কুগেলম্যান বলেন, প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক অনেক কৌশলগত অংশীদারত্ব দেখেছিল। সেই সময়কালে ট্রাম্প প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি চালু করেছিল। একই সাথে বাংলাদেশকে এর একটি বড় অংশ বলে মনে করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যও বেড়েছে। তবে আগামী চার বছরে কী ঘটতে পারে তাতে নতুন কিছু বিবেচনা সামনে রাখতে হবে।
প্রথমত, বাংলাদেশের নতুন নেতা ড. ইউনূস একসময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশ সমালোচক ছিলেন। কিন্তু এবার, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা হিসাবে তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্টত খুব আলাদা ছিল। ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানাতে তিনি একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ চিঠি লিখেছেন। প্রশ্নটি হলো, ট্রাম্প সম্পর্কের অবস্থাকে কিভাবে দেখবেন এবং বর্তমান সম্পর্কটিকে নতুন করে সাজাতে চান কি না। কুগেলম্যানের ধারণা তিনি তা করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে বৈদেশিক নীতি দেখেন তা খুব লেনদেনমূলক এবং বাস্তববাদী। আর তিনি মিত্র ও অংশীদারদের সাথে বোঝা ভাগাভাগির পদ্ধতিও গ্রহণ করেন। তাই ট্রাম্প সম্পর্কের বর্তমান প্রকৃতি চালিয়ে যেতে আগ্রহী নাও হতে পারেন।

নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে, ট্রাম্প বাংলাদেশকে নিয়ে একটি তথ্যহীন, উসকানিমূলক টুইট পোস্ট করেছিলেন। এটি তার প্রকৃত অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না। বরং মার্কিন নির্বাচনী রাজনীতির খেলায় বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট হিন্দু আমেরিকান কর্মী রয়েছেন; যারা প্রকাশ্যে বলেছেন যে ট্রাম্পের বিবৃতিগুলো তাদের সমর্থনের প্রচেষ্টার ফসল এবং এসব কর্মী মূলত মোদির সমর্থক।

ট্রাম্প স্বীকার করবেন যে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারিত্ব রয়েছে। আর মার্কিন প্রশাসনের অনেক গভীরে ইউনূসের যোগাযোগ থাকায় তিনি ছোটখাটো বহু গ্যাপ দ্রুত দূর করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়। ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের অ্যাজেন্ডা সীমিত হয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ গ্রহণের সুযোগ কতটা অবারিত থাকবে সেটি বলতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

বার্মা আইন ও মিয়ানমার বিবেচনা
বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব পাওয়ার একটি উপাদান হলো যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা আইন। এ আইনে মিয়ানমার ও সন্নিহিত অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের বৈদেশিক অঙ্গীকারের একটি অংশজুড়ে রয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো। বার্মা আইনকে এর অংশ মনে করা হলেও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এ আইনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন রিপাবলিকানরাও। তা ছাড়া এ আইনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্যের মধ্যে চীনকে কনটেইন করার কৌশলও রয়েছে। এ কারণে ট্রাম্প প্রশাসন আসার পর বার্মা আইন ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন উদ্যোগকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া হবে এমনটি স্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রশাসন মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে বড় কোনো কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে না। সঙ্গত কারণে যুক্তরাষ্ট্র একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনে বার্মায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয় একটি নিষ্পত্তিমূলক অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইবে। এ কারণে বাংলাদেশের বড় কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কৌশলগত বোঝাপড়ার প্রয়োজন হবে। সেটি যে আওয়ামী লীগ বা পতিত ফ্যাসিবাদের সাথে সম্ভব নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না দু’টি কারণে। প্রথমত, ফ্যাসিবাদী দলের দেড় দশকের দুঃশাসনের অবসান ঘটেছে ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিরোধ কার্যক্রমে। দেশের ১০ ভাগের বেশি মানুষ সে দলকে সমর্থন করে না বলে জরিপে উঠে এসেছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ ভারতীয় চশমার বাইরে গিয়ে বাকি বিশ্বকে দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা স্বার্থ বারবার উপেক্ষিত থেকেছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বড় দেশটি কেবল নিজের পাওনা বুঝে নিতে পেরেছে।

ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি বড় দিক হলো যুদ্ধের ইতি ঘটানো। প্রথম দফা শাসনের সময় ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আয়োজন শেষ করে এনেছিলেন। বাইডেন এসে সম্পন্ন করেন। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্র বা আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে জড়ালেও ট্রাম্প প্রশাসন চাইবে না নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করতে। এ কারণে শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারে এক ধরনের স্থিতাবস্থা থাকবে বলে মনে হয়।

নেপাল শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান
নেপালে আমেরিকার চীনবিরোধী বলয়কে শক্তিমান রাখতে চেষ্টা করে এলেও বড়ভাবে সেখানকার দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতে যুক্ত হয়নি। ট্রাম্প আমলে সে ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। অন্য দিকে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে-উত্তর ক্ষমতাসীনদের যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে গেছে। কট্টর চীনপন্থী রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে ওয়াশিংটন আর দিল্লির ভূমিকা সেখানে একমুখী থাকবে বলে মনে হয়।

আগেরবার ট্রাম্পের পররাষ্ট্র কৌশলের বক্তব্যে আফগানিস্তানের সেনা প্রত্যাহারের পাশাপাশি পাকিস্তানে উগ্রবাদী উত্থান প্রতিহত করার কথা এসেছে। ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকানদের সাথে পাকিস্তানের বোঝাপড়াটা ভালো। ট্রাম্প যে ধরনের বক্তব্য দিন না কেন; তার পাকিস্তান নীতি ভারসাম্যহীন হওয়ার আশঙ্কা কম। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসের সাথে ট্রাম্পের বিশেষ সম্পর্ককে পাকিস্তানের গভীর ক্ষমতা বলয় ইসলামাবাদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারবে।

সামগ্রিকভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন যতটা না যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মনোযোগী হবে ততটা বাইরে হওয়ার সম্ভাবনা কম। আগেরবার তিনি এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মার্কিন সম্পৃক্ততা কমিয়ে এনেছিলেন। এবারো সে ধারা অব্যাহত রাখতে পারেন। তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক প্রভাব আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের মধ্যে একটি ব্যবধান রেখা তৈরি করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও এর প্রভাব দেখা যেতে পারে।

nayadiganta

Exit mobile version