বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, সভা- সমাবেশের স্বাধীনতার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে বাংলাদেশ সরকার নিজেই জড়িত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার, জোরপূর্বক গুম করা, এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাও বন্ধ হয়নি।
গত ৩রা ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) প্রকাশিত HUMAN RIGHTS IN BANGLADESH: A MIDTERM ASSESSMENT OF IMPLEMENTATION DURING THE UPR 3RD CYCLE শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্বের রিপোর্টের চেয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত সুপারিশের কোন অগ্রগতি নেই। ক্ষেত্র বিশেষ মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
উল্লেখ্য, প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে মানবাধিকার পরিস্থিতির মূল্যায়নের মুখোমুখি হতে হয়। ২০০৬ সালে বর্তমান মানবাধিকার কাউন্সিলের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এর পর থেকে প্রতি চার বছর অন্তর এই মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ২০১৩ সালের এপ্রিল-মে মাসে এবং ২০১৮ সালের মে মাসে মোট তিনটি ইউপিআর রিভিউ এর মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশের ওপর মধ্যবর্তী পর্যালোচনা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ইউপিআর।
তৃতীয় ধাপের মধ্যবর্তীয় পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউপিআর-এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশে কার্যকর কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিশেষ করে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। ক্ষেত্র বিশেষে এ গুলোর অবনতি ঘটেছে।
‘প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সুপারিশ অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার প্রতিরোধ; বলপূর্বক গুম করা, এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাও বন্ধ হয়নি। এছাড়া, লিঙ্গ সমতা বাস্তবায়নেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু প্রসঙ্গে ইউপিআর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ২৬ জনকে হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। যা উদ্বেগনজক।
বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, ২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১০৭০ জন নাগরিক।
এতে আরো বলা হয়, ইউপিআর এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার এখনও একটি বাস্তবায়ন কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে পারে নি।
ইউপিআর বলছে, এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য হলো তাদের সুপারিশগুলি বাস্তবায়নে সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউপিআর-এর ৮৩টি সুপারিশের কোনটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ৮৩টির মধ্যে মাত্র ৩০টি আংশিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে। অন্য ৫৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো রকমের অগ্রগতি বা পদক্ষেপ নেই।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার মূলত তাদের (ইউপিআর) সুপারিশগুলি বাস্তবায়ন করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ছিলো। যার মধ্যে রয়েছে সংস্থাগত সংস্কার; নির্যাতন, বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা; মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ, সমিতি এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের অধিকারের বিষয় গুলো।
মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়, মানবাধিকার সংগঠন গুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৭৩ জন সাংবাদিক শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়ে আহত হয়েছেন এবং ১০০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি বরাবরে একটি চিঠি পাঠায়। এই চিঠির মাধ্যমে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।
অথচ, সে সব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতাসহ অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনে বাংলাদেশ সরকার নিজেই জড়িত রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।