বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদীর সফর নিয়ে ২২ মার্চে প্রচারিত কবীর সুমনের ‘জরুরি ভিডিও বার্তা’ শুনলাম। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং তাদের ‘অনুগামী’ ও ‘অনুসারী’—অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ, যুবলীগের নেতা কর্মীদের কাছে ‘সম্মানীয়’ নরেন্দ্র মোদীকে কেন বাংলাদেশে আসতে দেওয়া উচিত না, সেই যুক্তি দিয়েছেন তিনি। কলকাতায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি থেকে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের নামোল্লেখও করেছেন তবে মনে হয়েছে তারা গৌণ, অনেকটা কথার কথা হিশাবে বলেছেন।
গুজরাট গণহত্যার হোতা নরেন্দ্র মোদী কবির সুমনের কাছে ‘সম্মানীয় ব্যক্তি’। নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে তাঁর প্রধান আপত্তি মোদী সরকার বাংলা ভাষাকে ক্লাসিকাল ভাষার মর্যাদা দেন নি। কিন্তু পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যার ভাষা সেই মর্যাদা পেয়েছে। দ্বিতীয় আপত্তি নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতকে ‘সেকুলার দেশ’ হিশাবে স্বীকারই করে না। আর তাঁর তৃতীয় আপত্তি বিজেপির নথিতে রয়েছে যারা বাংলা ভাষায় কথা বলে তারা ‘বাংলাদেশের লোক’। বিজেপির কাছে পশ্চিম বঙ্গের কেউ ‘ভারতের লোক না’।
আলবৎ। আপনি যদি নিজেকে বাঙালি ও বাংলাভাষী গণ্য করেন, তাহলে আপনি ভারতীয় থাকবেন কেন? বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালি মুসলমান বলে বাঙালিকে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে হবে তার কোনই যুক্তি নাই, তাদের স্বাতন্ত্র্য বোধের জন্য তারা জীবন দিয়ে নিজেদের স্বাধীন করেছে। তেমনি বাঙালি হিন্দু হলে তাকে ভারতের সঙ্গে থাকতে হবে তারও কোন যুক্তি নাই। বিজেপি অন্যায় কিছু বলে কি? বলে না। আসলেই তো সুমন বাংলাদেশেরই লোক। ভারতে আছেন কেন? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জায়গা থেকে বিজেপি বাঙালিদের প্রসঙ্গে কথাটা অন্যায় ভাবে বলে, কিন্তু ইতিহাসের স্ববিরোধিতার দায় মীমাংসার ভার বিজেপির নয়, বাঙালির। কারন এর ভোগান্তি বাঙালিকেই ভুগতে হবে।
বিজেপি কেন পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের বাংলাদেশের লোক বলে তার জন্য অবশ্য সুমনের অনেক ব্যথা, কারন আফটার অল, তিনি ‘ভারতীয়’। মোদী পশ্চিম বঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ, বিশেষত মতুয়াদের ভোট নিজের বাক্সে সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে আসতে চাইছেন। তাদের দেবালয় ভিজিট করবেন। টেলিভিশানে সেইসব দেখানো হবে পশ্চিম বাংলার মানুষ তা দেখবে। পশ্চিম বাংলার ভোটের রাজনীতির সুবিধা করবার জন্যই মোদীর বাংলাদেশে সফর। নইলে এই দেশের তরুণদের দ্বারা অপমানিত হওয়ার সাধ তাঁর হোত না। সুমন এইসব আমাদের বোঝাচ্ছেন।
সুমন দাবি করেছেন পশ্চিম বাংলার মানুষ ‘সেকুলার’। ধর্মান্ধতার রাজনীতি পশ্চিম বাংলায় হালে পানি পায় নি। সুমন আরও দাবি করেছেন তিনি পশ্চিম বাংলা নিয়ে গান লেখেন নি, কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন। আমি পড়ে অবাক! লেখেন নি কেন? আমাদের তো নিজের দেশ নিয়ে লিখবার মানুষের অভাব নাই। বাংলাদেশ এই দেশের কবি সঙ্গীত শিল্পীদের ধমনিতেই আছে। তাঁরা লিখেছেন, লিখছেন। তবু সুমন ভারতীয় হয়েও বাংলাদেশ নিয়ে লিখেছেন, আমাদের প্রভূত আনন্দ হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের দেশ নিয়ে লিখবেন না কেন সেটা আমি একদমই বুঝতে পারলাম না। একটা ব্যাপার বুঝেছি। তিনি তাঁর ভাষণে দাবি করেছেন যেহেতু তিনি আমাদের নিয়ে গান লিখেছেন, অতএব তাঁর কথা আমাদের শোনা কর্তব্য। তাঁর প্রতি আমাদের কিছু দায় আছে।
সুমন ঠিকই বলেছেন ভারতের একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের দেবালয় দেখতে মোদী আসছেন, কারণ পশ্চিম বঙ্গে ভোটার হিশাবে তাদের নির্ধারক ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে বিজেপির জন্য ভোট আহরনের সম্ভাবনা নিশ্চিত করাই মোদীর সফরের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। সে যাই হোক কবীর সুমন ‘সম্মানীয়’ নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশে আসতে না দেবার জন্য বাংলাদেশের সরকারকে যে যুক্তিই দিন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ তো জানিয়েছেন, তাতেই আমরা খুশি।
বাংলাদেশে আমরা সুমনকে ভালবাসি। ভারতীয় বলে নয়, বাংলাভাষী এবং বাঙালি বলে। পশ্চিম বাংলাসহ দুনিয়ার সকল বাঙালি ও বাংলাভাষীদের সঙ্গে আমাদের প্রাণের বন্ধন দৃঢ় করা আমাদের নিজেদের গরজেই দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রবাদী জাতিবাদের সঙ্গে ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বোধের বিশাল ফারাক আছে। যদি ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বোধকে কোন জনগোষ্ঠি রাজনৈতিক রূপ দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আজ হোক কাল হোক সেই জনগোষ্ঠি তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। পশ্চিম বাংলা ‘ভারতীয়’ হতে গিয়ে কিম্বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে নিজের পরিচয়ে পর্যবসিত করতে গিয়ে বাঙালি ও বাংলাভাষী হবার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। ফলে কবীর সুমনদের বাঙালি হিশাবে বেঁচে থাকাটা অনেকাংশেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব কিম্বা টিকে থাকা না থাকার ওপর নির্ভরশীল। বাঙালি হওয়াটা স্রেফ জেনেটিক, নৃতাও্বিক বা ধর্মীয় ব্যাপার না। রাজনৈতিক পরিসরে ‘রাজনৈতিক’ ভাবে পরিগঠনের কর্তব্যও বটে। এই ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার চিন্তা চেতনায় মারাত্মক ঘাটতি আছে। তারপরও বাংলা ভাষাকে ‘ক্লাসিকাল’ সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়া হোল না বলে সুমনের আক্ষেপে যে বেদনা দেখছি তাতে কিছুটা আপ্লূত হয়েছি বলা যায়।
কবীর সুমন আরো অনেক কিছু এড়িয়ে গিয়েছেন, তাঁর ‘সম্ভাষন’-এ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নি। যেমন, গুজরাটের গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা, কাশ্মিরের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ ও দমন-নিপীড়ন তীব্রতর করা, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ও রাজনৈতিক নেতা হিশাবে নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ চরিত্র, বিশেষত ভারত হিন্দুর দেশ এবং ইসলাম ও মুসলমান ভারতে ‘বহিরাগত’ এই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের সর্দারগিরি; মোদী আইন ও বৈধ কাগজপত্র না থাকবার ছুতায় জনগণের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়; যে জন্মভূমিতে মানুষ জগত দেখে সেই ভূমিতে তার আবাসের অধিকার স্রেফ আধুনিক রাষ্ট্রের আইনের বিষয় নয়, প্রাক-রাষ্ট্রীয় মানবিক অধিকারের বিষয় — মোদী, তার দল এবং সরকার সেই অধিকার হরণ করে। সর্বোপরী পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে নরেন্দ্র মোদী আন্তর্জাতিক পুঁজির উপমহাদেশীয় প্রধান এজেন্ট, ইত্যাদি। পাশ্চাত্য পরাশক্তি মোদীকে দিয়ে চিন ঠেকানোর কঠিন কাজ করিয়ে নিতে চায়, যে কোন মূহূর্তে চিন-ভারত সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সম্প্রতি ভারত-চিন সীমান্তে সংঘর্ষ সেই ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ থেকে তাঁকে এই দিকগুলো ধরিয়ে দেওয়া জরুরি মনে করি।
বাংলাদেশের তরফ থেকে কবির সুমনকে অতীব বিনয়ের সঙ্গে কয়েকটি কথা ভাবতে বলব।
১. ভারতকে ‘সেকুলার দেশ’ বলা ঠিক না। ভুল। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল তার ভিত্তি ছিল পাকিস্তান হবে মুসলমানদের জন্য আর ভারত হিন্দুদের। শুরু থেকেই পাকিস্তানের মতোই ভারত একটি সফট হিন্দু রাষ্ট্র হিশাবেই ভাগ হয়েছে। কবীর সুমনের সেকুলার ঘোর কাটলে তিনি নেজেই সেটা বুঝতেন।
২. পাকিস্তান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়, বিশেষত প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল সংবিধান প্রণয়ণে ব্যর্থতা। পরিণতিতে পাকিস্তান ভেঙে যায় এবং বহু রক্তপাত ঘটিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ পশ্চিম বাংলার মতোই দিল্লীর অধীন, কিন্তু কাগজে কলমে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র। তবে ভারত কাগজে কলমে একটি ‘সেকুলার’ রাষ্ট্র হিশাবে সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছে , সেটা ঠিক। কিন্তু দেশ আর সংবিধান এক জিনিস না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর মনে ভারত হিন্দুর দেশ হিশাবেই গড়ে উঠেছে, ফলে হিন্দুত্ববাদ সহজেই উর্বর জমি পেয়ে গিয়েছে। বিজেপি নিজেকে সেকুলার দলই গণ্য করে। তাই ভারত নামক রাষ্ট্রটি সেকুলার ‘দেশ’ নয়। রাষ্ট্রকে দেশ গণ্য করে ভারত ‘সেকুলার’ বলার কোন অর্থ নাই। দেশ আর রাষ্ট্র সমার্থক না।
৩. এই ইতিহাস মনে রাখলে আমরা বুঝব পশ্চিম বাংলা হিন্দুত্ববাদের উর্বর জমি। মূলত হিন্দু জাতিবাদ বা হিন্দুত্ববাদের আঁতুড়ঘর হচ্ছে পশ্চিম বাংলা। পশ্চিম বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু আজ অবধি বাঙালি হিন্দুর শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে বাঙালি মুসলমানের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক। আবেগী না হয়ে কবীর সুমনকে বাস্তব অবস্থা আমলে নিয়ে কথা বলতে হবে।
৪. প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে এই উপমহাদেশ শুধুমাত্র ধর্মসূত্রে হিন্দুর আবাস হিশাবে পরিগণিত হোত না। বরং সিন্ধু নদ ঘিরে যে ভূগোল ও ভৌগলিক কল্পনা তা ধর্ম নির্বিশেষে সকল অধিবাসীদের আবাস বলেই পরিগণিত হোত। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর ‘হিন্দুস্তান’ হয়ে যায়‘ইন্ডিয়া’। এরপর থেকেই উপমহাদেশ শুধু হিন্দুদের আবাস এবং অন্যেরা বহিরাগত, এই কলোনিয়াল যুগের কেচ্ছা তৈরি হওয়া শুরু হয়। এখন সেটাই হিন্দুত্ববাদের প্রধান রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।
৫. ‘হিন্দু’ নামক কোন একাট্টা ধর্ম কস্মিন কালেও ছিল না। ইহুদি, খ্রিস্টিয় বা ইসলামের মতো ‘হিন্দু’ কোন কেতাবি ধর্মও না। তার রূপ ও চর্চার বহু বিচিত্র প্রকাশ রয়েছে। হিন্দু ধর্ম ঔপনিবেশিক আমলের আবিষ্কার।
৬. সুমন শুরু করেছেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের স্মৃতি নিয়ে। ভাল। কিন্তু শরণার্থিদের দুর্দশা বোঝার জন্য উপদেশ দিয়েছেন মার্কিন বীট জেনারেশানের কবি এলেন গিন্সবার্গের ‘যশোর রোড’ কবিতাটি পড়ার জন্য। গিন্সবার্গ পড়ে শরণার্থীদের দুর্দশা বোঝার পরামর্শ শরণার্থীদের প্রতি কিছুটা নিষ্ঠুর মনে হয়েছে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। কবিতা পড়ে ঘটনার ভয়াবহতা বোঝানো সুমনের কাব্যাক্রান্ত ছেলেমানুষী। শরণার্থীর বাস্তবতা কবিতা নয়। দেষীন রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়ার বেদনা অতিশয় গভীর। গিন্সবার্গের কবিতা পড়লে লাভ হবে না। জীবন অনেক অমোঘ ও জটিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম বাংলার মানুষ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের জায়গা দিয়েছেন। সুমন জানাচ্ছেন, শরণার্থীদের ভারে পশ্চিম বাংলার মানুষ ‘দুঃখভারাক্রন্ত’ হন নি। বাংলাদেশের জনগণ সেই দিনগুলো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। তবে বাংলাদেশকে তার জন্য খুবই চড়া দামে সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ আজ অবধি চড়া সুদে শোধ দিতে হচ্ছে। যা কোনদিন শেষ হবে মনে হয় না। চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে সুমন সেই সবের হদিস খুব একটা রাখেন না।
পরিশেষে একটা অনুরোধ করি। বাংলাদেশেরর তরুণেরা নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ আসা রুখতে রাস্তায় লড়ছে। কবীর সুমন শাহবাগের সমর্থনে গান বেঁধেছিলেন। মনে আছে? আশা করি এবার যারা মোদীকে চ্যালেঞ্জ করে রাস্তায় জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের জন্য তিনি একটি গান লিখবেন।
কবীর সুমনকে ভালবাসা।