বাংলাদেশে আদানির ব্যবসা প্রসার নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন

২০২৩-০১-১৭

জেররি শিহ, নিহা মাসিহ এবং অনন্ত গুপ্ত
 

বাংলাদেশে আদানির ব্যবসা প্রসার নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন রাজনৈতিক মদদে একজন কয়লা-কোটিপতির উত্থান

বিষাক্ত জ্বালানির অনুকূলে রাজনৈতিক ক্ষমতা কিভাবে নতজানু ভূমিকা পালন করে, গৌতম আদানির দৈত্যাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তা ঠিকঠাক বোঝা যায়

ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশের গোড্ডায় গৌতম আদানির কয়লা শক্তিকেন্দ্র। ছবি: ওয়াশিংটন পোস্ট

গোড্ডা, ভারত– বহু বছর ধরে কোনোকিছুই পূর্ব ভারতে ধান ও পামগাছের বনের বুকে বিশালকায় কয়লাচালিত শক্তিকেন্দ্র বন্ধ করতে পারেনি।

স্থানীয় কৃষকদের আপত্তি, পরিবেশের ওপর প্রভাব বিষয়ক নানা বোর্ড, এমনকি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাও একে থামাতে পারেননি। ভারতের নেতাদের নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের আহ্বানও অরণ্যে রোদন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

এই প্রকল্প থেকে যে কেবল হাতেগোনা কিছু ভারতীয় নাগরিক উপকৃত হবেন, এই সত্যও একে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। শক্তিকেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা সামনের সপ্তাহে। যে বিদ্যুৎ এখান থেকে উৎপন্ন হবে, তার সবটাই উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হবে প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের কাছে, তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী যে দেশ অত্যন্ত ঋণগ্রস্ত এবং যে দেশের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎশক্তি আছে, যার বেশি দেশটির আর প্রয়োজন নেই।

এই প্রকল্প থেকে অবশ্য এর নির্মাতা ভারতীয় কোটিপতি গৌতম আদানি লাভবান হবেন। গ্লোবাল এনার্জি মনিটর এর তথ্য অনুযায়ী, আদানি বিশ্বের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতের এবং কয়লা খনির বৃহত্তম বেসরকারি বিনিয়োগকারী। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর কোম্পানিগুলোর স্টক শীর্ষে পৌঁছানোর পর ব্লুমবার্গ ইনডেক্স অনুযায়ী আদানি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনীতে পরিণত হন। এ তালিকার শীর্ষে আছেন ইলন মাস্ক।

দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা কয়লা বর্জন করার জন্য পশ্চিমের অনুরোধ উপেক্ষা করে আসছেন। কয়লা শক্তির একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হলেও এটি শক্তির একটি কলুষিত রূপ, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিকারী মোট কার্বন নির্গমনের এক-পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী। ভারতের দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতি বিশ্বে কয়লার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা এবং তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী। কর্তাব্যক্তিদের মতে, আরো অন্তত কয়েক দশক ভারতকে স্বেচ্ছায় নয়, বরং প্রয়োজনের তাগিদেই কয়লা ব্যবহার বহাল রাখতে হবে।

৬০ বছর বয়সী আদানি সেপ্টেম্বর মাসে সিঙ্গাপুরে এক কনফারেন্সে বলেন, “বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে যে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন, সমালোচকেরা তাকে এক কথায় বাতিল করে দিতে চান। ভারতের জন্য সেটা ফলপ্রসূ হবে না।”

কিন্তু এই কলুষিত জ্বালানির এবং দেশটির কয়লাশিল্প যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন সেই মহাশক্তিধর ব্যক্তির পক্ষপাতিত্ব করতে ভারতের রাজনীতি কীরকম একপেশে অবস্থান নেয়- গোড্ডায় অবস্থিত আদানির শক্তিকেন্দ্রের গল্প তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

প্রাক্তন ভারতীয় কর্তাব্যক্তি, আদানি গ্রুপের সাবেক কর্মী, কারখানা নির্বাহী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দুই ডজনেরও বেশি সাক্ষাৎকার এবং শক্তি ক্রয়ের একটি গোপনীয় চুক্তিসহ কোম্পানি ও সরকারের একশোরও বেশি পৃষ্ঠার নথিপত্র থেকে দেখা যায়, কীভাবে ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা অনবরত এমন একটি প্রকল্পে সহায়তা যুগিয়ে গেছেন যা অর্থনৈতিকভাবে তেমন উপকারী নয়।

এসব সাক্ষাৎকার ও নথিপত্র থেকে একজন স্বয়ম্ভু কোটিপতির উল্লেখযোগ্য প্রভাবের বিষয়টিও সামনে আসে, যার উত্থান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উত্থানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সফরকালে মোদি গোড্ডা শক্তিকেন্দ্রের ভিত্তি রচনা করেন। সেটা ছিলো এক বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।

গৌতম আদানি ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: দ্য ওয়্যার

একজন জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কর্মকর্তা আদানিসহ অন্যান্য রাঘববোয়ালের কাছে হ্রাসকৃত দামে কয়লা সরবরাহের বিষয়ে আপত্তি জানালে মোদি প্রশাসন তাঁকে চাকরিচ্যুত করে। একজন স্থানীয় আইনপ্রণেতা শক্তিকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অনশন করলে তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

একজন জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কর্মকর্তা আদানিসহ অন্যান্য রাঘববোয়ালের কাছে হ্রাসকৃত দামে কয়লা সরবরাহের বিষয়ে আপত্তি জানালে মোদি প্রশাসন তাঁকে চাকরিচ্যুত করে। একজন স্থানীয় আইনপ্রণেতা শক্তিকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অনশন করলে তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় 

কর্মকর্তাদের সূত্রে এবং নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে, অন্তত তিনবার আদানির কয়লা-সংক্রান্ত ব্যবসায় সহায়তা করার জন্য আইন সংশোধন করেছে সরকার, যার ফলে আদানির অন্তত ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। জাতিসংঘে মোদি কয়লার ওপর কর বসানো এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বাড়ানোর কথা বলার পরেও এটি ঘটেছে।

বিস্তারিত প্রশ্নের জবাবে আদানি গ্রুপের একজন মুখপাত্র গোড্ডা শক্তিকেন্দ্র অথবা আদানির সঙ্গে মোদির সম্পর্কের বিষয়ে উল্লেখ না করলেও জানান যে, ভবিষ্যতে ব্যাপক আকারে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটি্‌র, সেইসঙ্গে এটি ধীরেধীরে কয়লা থেকেও সরে আসবে। মন্তব্যের জন্য মোদির দফতরে বারবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। সরকারি কর্তাব্যক্তিরা জানান যে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার চালু করার জন্য তাঁরা জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁরা আশা করছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের মোত বিদ্যুৎ চাহিদার অর্ধেক এই খাত থেকে পূর্ণ হবে এবং তাঁদের লক্ষ্য ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।

বর্তমানে আদানি গ্রুপের মালিকানাধীন আটটি বিমানবন্দর ও ১৩টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে। এ শিল্পগোষ্ঠীটি অত্যন্ত দ্রুত গণমাধ্যম, প্রতিরক্ষা ও সিমেন্ট খাতেও বিস্তার লাভ করেছে, এমনকি হয়ে উঠেছে ভারতের শীর্ষস্থানীয় নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনকারী। ২০২০ সালে আদানির মোট সম্পদের পরিমাণ যেখানে ছিলো ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার, এ মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৭০০ কোটি মার্কিন ডলারে।

এরপরেও, সাতটি গণ-ব্যবসায়িক কোম্পানির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন এবং শিল্প বিশেষজ্ঞদের সূত্রে জানা যায় যে, আদানি গ্রুপের মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশেরও বেশি আসে কয়লা সম্পর্কিত ব্যবসা থেকে। এসব ব্যবসার মধ্যে আছে চারটি কয়লা শক্তিকেন্দ্র, ১৮টি কয়লা খনি এবং একটি কয়লা ব্যবসা কার্যক্রম, যা ভারতের মোট আমদানির এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়বদ্ধ। এ কার্যক্রমটির ৭৫ শতাংশেরও বেশি শক্তি উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে।

সম্পদের এমন বিশদ বিবরণী থাকা সত্ত্বেও গোড্ডার গ্রামাঞ্চলের দৈত্যাকার দুই কুলিং টাওয়ার এবং একটা চিমনি আদানির প্রভাবের কথা যেমন প্রকটভাবে ঘোষণা করে, তেমনটা আর কোনোকিছুই করে না।

অল্প কিছুদিন আগে এক সকালে মৌসুমী বৃষ্টি যখন ধুলো আর গরম ধুয়ে নিয়ে গেছে, বচ্চন যাদব নামের এক ইঁটের কারিগর তখন বলছিলেন সেই দিনটির কথা, যেদিন আদানির প্রতিনিধিরা প্রথম এই এলাকায় এসেছিলেন।

আদানির কয়লা শক্তিকেন্দ্রের দেয়ালের ঠিক পাশেই এই নারীর মাটির ঘর। ছবি: ওয়াশিংটন পোস্ট

তখনও গ্রামের মানুষ এই প্রকল্প সম্বন্ধে জানে না, তখনও তারা এর বিরুদ্ধে মিছিল করেনি, তখনও শয়ে শয়ে পুলিশ অফিসার আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাটন চালায়নি এবং তাদের নেতাকে জেলে পোরেনি, তখনও বাসের পর বাস ভরে চীনা ইঞ্জিনিয়াররা এসে ধান আর ছোলার ক্ষেত উচ্ছেদ করে দৈত্যাকার এক প্ল্যান্ট বসায়নি।

ইঁট নির্মাতা বললেন, গ্রামের লোক তখন সাদাসিধা ছিলো। তারা জানতো না তারা কার বিরুদ্ধে, কীসের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে।

“বড়া আদমি, বড়া বাত,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।

বড়লোক, বড় ব্যাপার।

২.

‘পুরোদস্তুর প্রতারণা’

২০১৫ সালের জুন মাসে প্রথম বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় আসেন মোদি। বন্ধুপ্রতীম এই প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গে ভারতের গভীর সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক বন্ধন আছে। বাংলাদেশে এসে মোদি হিন্দু ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রার্থনা করেন, ৪০ বছরের পুরনো একটি সীমান্ত সম্পর্কিত বিবাদের মীমাংসা করেন এবং ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রয় করবে এই মর্মে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

চুক্তির বিষয়গুলোর মাঝেএকটি হলো বাংলাদেশে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবেন আদানি। মোদির রাজনৈতিক প্রচারণার সময়ে আদানি একটি কর্পোরেট জেটের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কানাডা ও ফ্রান্স সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন। মোদির বাংলাদেশ সফরের পর দেশটির বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আদানির সঙ্গে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ১৬০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সীমান্ত থেকে ৬০ মাইল দূরে গোড্ডা জেলার একটি গ্রামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে

চুক্তির বিষয়গুলোর মাঝেএকটি হলো বাংলাদেশে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবেন আদানি। মোদির রাজনৈতিক প্রচারণার সময়ে আদানি একটি কর্পোরেট জেটের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কানাডা ও ফ্রান্স সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন। মোদির বাংলাদেশ সফরের পর দেশটির বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আদানির সঙ্গে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ১৬০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সীমান্ত থেকে ৬০ মাইল দূরে গোড্ডা জেলার একটি গ্রামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে।

সে সময়ে মনে হয়েছিলো, প্রকল্পটি সব দিক থেকেই উপকারী হবে।

মোদির জন্য এটা ছিলো ‘সবার আগে প্রতিবেশি’ শীর্ষক বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়ন এবং ভারতীয় বাণিজ্যের উন্নতি করার একটা সুযোগ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভার বিবরণী অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মোদির চাওয়া ছিলো “বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও বণ্টন খাতে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির প্রবেশ সহজতর করা।”

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে ১৬৩ পৃষ্ঠার গোপনীয় যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি এসেছে, পত্রিকাটির অনুরোধক্রমে তিনজন শিল্প বিশেষজ্ঞ সেটি বিশ্লেষণ করার পরে দেখা যায় যে, ২৫ বছর মেয়াদি গোড্ডা চুক্তি বাংলাদেশের উপকারে আসবে সামান্যই

অন্য দিকে, হাসিনা ২০২০ সালের মধ্যে তাঁর দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সদাব্যস্ত পোশাক শিল্প এবং আয়তনে ক্রমশ বর্ধমান শহরগুলোর বিদ্যুতের চাহিদা ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে তিন গুণ হবে।

কিন্তু দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে ১৬৩ পৃষ্ঠার গোপনীয় যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি এসেছে, পত্রিকাটির অনুরোধক্রমে তিনজন শিল্প বিশেষজ্ঞ সেটি বিশ্লেষণ করার পরে দেখা যায় যে, ২৫ বছর মেয়াদি গোড্ডা চুক্তি বাংলাদেশের উপকারে আসবে সামান্যই।

শক্তিকেন্দ্রটির কাজ শুরু হওয়ার পরে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ধারণক্ষমতা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ হিসেবে আদানিকে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার দিতে হবে- তা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক আর না করুক। সিডনিভিত্তিক শক্তি-অর্থনীতি বিশ্লেষক টিম বাকলে মনে করেন, শিল্পের মানদণ্ডে এটি অত্যন্ত চড়া দাম। বাংলাদেশ কবে থেকে বিদ্যুৎশক্তি পেতে শুরু করবে সেটিও পরিষ্কার নয়, কারণ দেশটির ট্রান্সমিশন লাইন তৈরি এখনও শেষ হয়নি। তাছাড়া, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হয়তো বাংলাদেশের কাজেও আসবে না: সরকার তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এখন সর্বোচ্চ চাহিদার থেকেও ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে কয়লা এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ।

বিদেশী বিদ্যুৎ রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অন্যান্য চুক্তিতে কয়লার দাম বাড়লে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ যে মূল্য পরিশোধ করতে হবে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু গোড্ডা চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশকে বাজারদরই পরিশোধ করতে হবে

এছাড়া কয়লার দামের বিষয়টিও বিবেচ্য, ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এছাড়া ওয়াশিংটন পোস্টের নজরে এসেছে যে, বিদেশী বিদ্যুৎ রপ্তানিকারকদের সঙ্গে অন্যান্য চুক্তিতে কয়লার দাম বাড়লে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ যে মূল্য পরিশোধ করতে হবে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু গোড্ডা চুক্তিতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশকে বাজারদরই পরিশোধ করতে হবে।

রেলপথ নির্মাণ করছেন শ্রমিকরা। এ রেলপথ ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা স্টেশনের সঙ্গে আদানির শক্তিকেন্দ্রকে সংযুক্ত করবে। ছবি: ওয়াশিংটন পোস্ট

এছাড়া, গোড্ডায় প্রয়োজনীয় কয়লাও সম্ভবত আদানির নিজস্ব ব্যবসা থেকে সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পের পরিবেশ সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে দেখা যায় যে, প্রতি বছর ৭০ লক্ষ টন কয়লা আমদানি করা হবে। শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, কয়লা আদানির জাহাজে করে আদানির মালিকানাধীন পূর্ব ভারতীয় বন্দরে এসে পৌঁছবে, তারপর শক্তিকেন্দ্রে পৌঁছাবে আদানির নির্মিত রেলপথে। আদানি-নির্মিত উচ্চ ভোল্টেজসম্পন্ন লাইনের মাধ্যমে সীমান্ত পেরোবে উৎপন্ন বিদ্যুৎ। চুক্তি অনুযায়ী, পরিবহন ও বিতরণের খরচ জোগাবে বাংলাদেশ।

জ্বালানি বিষয়ক বিশ্লেষক টিম বাকলের বিশেষ মনোযোগের জায়গা দক্ষিণ এশিয়ার বাজার। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ দেশটিতে বিদ্যুতের পাইকারি দামের পাঁচ গুণ বেশি দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে। এছাড়াও বাকলে জানান, বাংলাদেশের নিজস্ব কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার যে দাম ঘোষণা করা হয়েছে, কয়লার দাম যুদ্ধের আগের অবস্থাতে ফিরে গেলেও আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে কিনতে হবে তার থেকে ৩৩ শতাংশ বেশি দামে

প্রধান অর্থনৈতিক ফার্মগুলোর দীর্ঘ সময়ের জ্বালানি বিষয়ক বিশ্লেষক টিম বাকলের বিশেষ মনোযোগের জায়গা দক্ষিণ এশিয়ার বাজার। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ দেশটিতে বিদ্যুতের পাইকারি দামের পাঁচ গুণ বেশি দামে আদানির বিদ্যুৎ কিনবে। এছাড়াও বাকলে জানান, বাংলাদেশের নিজস্ব কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার যে দাম ঘোষণা করা হয়েছে, কয়লার দাম যুদ্ধের আগের অবস্থাতে ফিরে গেলেও আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে কিনতে হবে তার থেকে ৩৩ শতাংশ বেশি দামে।

বাংলাদেশের কাপ্তাই সৌরকেন্দ্রের তুলনায় আদানির বিদ্যুতের দাম পাঁচ গুণ বেশি পড়বে।

বাকলে বলেন, “এটা পুরোদস্তুর প্রতারণা।”

বাংলাদেশী পরিবেশবাদী হাসান মেহেদি নিয়মিত বিদ্যুৎ শিল্পের হালচালের দিকে নজর রাখেন। তিনি বলেন, একটা সাধারণ দিনে তাঁর দেশের ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল থাকে। তিনি আরো বলেন যে, গোড্ডা কেন্দ্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে কয়লার সঙ্গে আরো দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করবে।

মেহেদি বলেন, “সৌরশক্তির জায়গা আরো সংকুচিত করে দেয় এটা। কিন্তু বৈশ্বিক জলুবায়ু সংকটে উষ্ণ স্থানে থাকা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সেই কয়লা শক্তিই বেশি দাম দিয়ে কিনবে, যার আসলে তাদের প্রয়োজন নেই।”

রহমতউল্লাহ আরো বলেন, “হাসিনা জানেন কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। কিন্তু তিনি এ-ও জানেন, ‘আদানিকে খুশি রাখলে মোদি খুশি থাকবেন।’ বাংলাদেশ এখন আর ভারতের অঙ্গরাজ্য নয়। দেশটির অবস্থান তার থেকেও নিচে।”

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক বেশি হওয়ার কারণে ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ১৮টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১০টিই বাতিল করে দেয়। জ্যেষ্ঠ বিদ্যুৎ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসাইন সাংবাদিকদের জানান, কয়লার বিষয়ে “বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ” লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো এবং বলা হচ্ছিলো যে, নবায়নযোগ্য শক্তি অপেক্ষাকৃত সস্তা।

কিন্তু আদানির প্রকল্প বহাল থাকবে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বি ডি রহমতুল্লাহও এই চুক্তিটি পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, চুক্তি তেমন সুবিধাজনক না হলেও ভারতকে রাগিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি হাসিনার পক্ষে নেয়া সম্ভব না।

শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদি। ছবি: বাসস

রহমতউল্লাহ আরো বলেন, “হাসিনা জানেন কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। কিন্তু তিনি এ-ও জানেন, ‘আদানিকে খুশি রাখলে মোদি খুশি থাকবেন।’ বাংলাদেশ এখন আর ভারতের অঙ্গরাজ্য নয়। দেশটির অবস্থান তার থেকেও নিচে।”

হাসিনার একজন মুখপাত্র এবং বাংলাদেশের শক্তি বিষয়ক কর্মকর্তাদেরকে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং মন্তব্য করতে বারবার অনুরোধ করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।

বিরাট উচ্চাশা

দুজন সাবেক সহকর্মীর বয়ান অনুযায়ী, একজন পোশাক ব্যবসায়ীর লাজুক কিন্তু সম্ভাবনাময় মধ্যম পুত্র গৌতম আদানির শুরুর বছরগুলো কেটেছিলো মোটের ওপর একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে, যিনি সবসময়ই ব্যবসার সুলুক-সন্ধানে ব্যস্ত। একটা মোটামুটি ভালো মানের বাজাজ স্কুটারে পশ্চিমের রাজ্য গুজরাটে ঘুরে বেড়ান তিনি। প্লাস্টিক ফিল্ম এবং পেলেট বিক্রেতাদের খোঁজে তিনি পূর্ব এশিয়া চষে ফেলেন।

১৯৯১ সালে ভারত উদারনৈতিক অর্থনীতির দিকে ঝুঁকলে আদানি প্রথম বড় মাপের একটা সুযোগ পান। গুজরাটের মুন্দ্রায় মিনেসোটার ফুড জায়ান্ট কারগিলকে লবণের খনির কাজে দালাল হিসেবে সহায়তা করছিলেন আদানি। কিন্তু কার্যক্রমটি ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে আদানির কাছে রয়ে যায় প্রকল্পশূন্য, নিষ্ফলা ২০০০ একর সাদা বালুর মরুভূমি।

কাজেই পুরো জিনিসটার খোলনলচে বদলে ফেললেন তিনি।

এক দশকের মধ্যেই মুন্দ্রা পরিণত হলো সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পণ্যের সম্ভারে বোঝাই ভারতের সবচেয়ে কার্যক্ষম বন্দরে। মুন্দ্রার তিনটি জেটি কেবল কয়লা নেওয়ার কাজের জন্যই ছিলো। ১০ মাইলব্যাপী উঁচু কনভেয়র বেল্টগুলো জাহাজ থেকে কয়লা নিয়ে যেতো বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা-প্রক্রিয়াজাতকারী টার্মিনালে।

২০০৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে কয়লা ব্যবহার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এমন একটি দেশে মুন্দ্রা বন্দর আদানিকে কেবল সরবরাহ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে নয়, বরং শক্তি খাতের কেন্দ্রবিন্দুতেও পরিণত করেছে। গবেষণা ফার্ম কোলমিন্টের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বার্ষিক কয়লা আমদানির ২৫ শতাংশই হয়েছে আদানির বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

ভারতের একজন প্রাক্তন অর্থ সচিব সুভাষ চন্দ্র গার্গ বলেন, “অবকাঠামোর মতো খাতে যেখানে কেউই সফল হয় না, সেখানেও তিনি সফল হয়েছেন। তাঁর বিরাটকায় উচ্চাশাগুলো সবসময় সেসব খাতেই দেখা দিয়েছে যেখানে সরকারের নজর ছিলো।”

আদানির দৌড় এখন কয়লা ছাড়িয়েও অনেক দূরে। তিনি এখন ভারতে প্যাকেটজাত পণ্যের বৃহত্তম বিক্রেতা, একইসাথে দেশটির শহরাঞ্চলের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারীও। ড্রোন প্রস্তুত, উপাত্ত কেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য শক্তির অন্যতম প্রযুক্তি হাইড্রোজেন জ্বালানির মতো নানা নতুন খাতেও তিনি প্রবেশ করেছেন সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসব উল্লিখিত হওয়ার পরপরই। অনেকেই মনে করেন তিনি আদতে রাষ্ট্রীয় নীতির একটা অঙ্গ।

আদানি গ্রুপের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্সের একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নারায়ণ হরিহরণ বলেন, “তাঁর প্রয়োজন হলে তাঁকে বাঁচাতে অক্সিজেন মাস্ক ছুটে আসবে।”

সমর্থক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের মতেই, ভারতের অন্যান্য রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীর ভাগ্যের কাঁটা যেখানে সরকার বদলের সাথেসাথে ওঠানামা করেছে, আদানি সেখানে কেবলই উঠেছেন। এর কারণ, সব দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গেই তিনি সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ১৯৯০ এর দশকে তাঁর পরিচয় হয় উদীয়মান গুজরাটি রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে, সে সময়ে যিনি ভারতীয় জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তিনি অঙ্গরাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভ্যন্তরীণ হালচাল সম্বন্ধে কথা বলতে রাজি হওয়া মোদি এবং আদানির সহযোগীরা জানান, তাঁরা রীতিমতো মানিকজোড়ে পরিণত হন।

 

একজন ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিবিদ, কঠোর কৃচ্ছ্রতায় জীবনযাপন এবং ধর্মে অটল ভক্তির জন্য যিনি পরিচিত। আরেকজন ছিলেন অখ্যাত, কাজপাগল শিল্পপতি, যিনি তেমন লোক-লস্কর ছাড়াই চলাফেরা করতেন, আর যাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিলো খরচ কমানো।

 

মোদির একজন সাবেক উপদেষ্টা, যিনি আদানির সঙ্গেও কাজ করেছেন, বলেন যে, আদানির বিভিন্ন প্রকল্প গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে সত্যিই প্রসন্ন করেছিলো। মুন্দ্রা বন্দরের ওপর দিয়ে বিমান ভ্রমণের সময়ে মরুভূমির মধ্যে আদানির বিস্তৃত রেলপথ দেখে মোদির সন্তুষ্ট হওয়ার বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

 

সেই প্রাক্তন উপদেষ্টা আরো বলেন, “বেসরকারি খাতে এই মাত্রার উন্নয়ন এর আগে কেউ দেখেনি, এবং পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে আদানি বরাবরই অনন্যসাধারণ ছিলেন।

 

সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৭ সালে গুজরাট সরকার নামমাত্র মূল্যে আদানিকে ১৪০ বর্গমাইল জমি বিক্রি করে এবং মুন্দ্রা ঘিরে তৈরি করে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা (SEZ)। এ এলাকার অন্তর্বর্তী ব্যবসার ওপর কর ধার্য হতো না। বিজেপি সে সময়ে বলেছিলো যে, এটি একটি উন্নয়ন প্রচেষ্টা।

 

২০০৯ সালে মুন্দ্রা এসইজেড এর ভেতরে আদানি একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে শুরু করেন, যেখানে কাছেই তাঁর সমুদ্রবন্দর থেকে তাঁর রেলপথ ধরে আমদানিকৃত কয়লা ব্যবহার করা হবে। তাঁর কোম্পানি যাকে “সমন্বিত কয়লা ব্যবস্থা” বলে, এটি তারই অংশ।

 

 

বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবসায় নামলেন আদানি

ওয়াশিংটন পোস্টের বিস্তারিত প্রশ্নের জবাবে আদানি গ্রুপের মুখপাত্র গোড্ডা প্রকল্প এবং আদানির রাজনৈতিক আন্তঃসম্পর্কের সঙ্গে বা প্ল্যান্টটির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। মুখপাত্র এ-ও জানান যে, সামনের দশকে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ১০০০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানিটির, এবং এটি ধীরেধীরে কয়লা খাত থেকে সরে আসবে।

 

তিনি বলেন, “ইউরোপে যেমনটা দেখা গেছে, কঠোর বাস্তব হলো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসাটা সহজ নয়। আমাদের মতো কর্পোরেটরা যখন সবুজ শক্তির দাম হাতের নাগালে নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছে, তখন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার ওপরও সমান জোর দিতে হবে যাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারে ডুবে না যায়।”

 

গোড্ডা ভারতের দ্বিতীয় দরিদ্রতম প্রদেশ ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত। বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় আইনে উল্লিখিত ছিলো যে, ঝাড়খণ্ডে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাঁদের উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে প্রদেশের কাছে বিক্রি করবে। কিন্তু গোড্ডার ক্ষেত্রে আদানি এক বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছেন বলে জানালেন সাবেক কর্মকর্তারা। তাঁর প্ল্যান্টে উৎপন্ন বিদ্যুৎ তিনি ঝাড়খণ্ডের বদলে ভারতের অন্যান্য অংশে পাঠানোর প্রস্তাব দেন- এবং অবশ্যই বেশি দামে

 

গোড্ডা প্রকল্প এবং আদানির সঙ্গে মোদির সম্পর্ক বিষয়ক বিস্তারিত একটি প্রশ্নমালা ইমেইলে পাঠানো হলে তার কোনো জবাব দেয়নি মোদির দপ্তর, সাড়া দেয়নি একই বিষয়ে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও। মোদিও কখনোই জনসমক্ষে তাঁদের সম্পর্কের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ভারতের বিরোধী দলের নেতারা মোদির কর্পোরেট শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে অভিযোগ জানালে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মিত্ররা প্রায়শই এই যুক্তি দিয়েছেন যে, একটি দেশের অর্থনীতিকে অগ্রসর করতে সফল কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে সাংসদ ও মোদির অধীনস্থ প্রাক্তন পর্যটন মন্ত্রী কে জে আলফনস বলেন, “এই দেশে মুনাফা সৃষ্টি করা প্রত্যেক শিল্পপতি কাজের সুযোগও সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা কাজের সুযোগ তৈরি করেছেন, তাঁদেরকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করতে হবে।”

 

 

উপেক্ষিত উদ্বেগ

২০১৫ সালে আদানি বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষর করার পরপরই কিছু ভারতীয় কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

 

গোড্ডা ভারতের দ্বিতীয় দরিদ্রতম প্রদেশ ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত। বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় আইনে উল্লিখিত ছিলো যে, ঝাড়খণ্ডে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাঁদের উৎপাদিত বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ হ্রাসকৃত মূল্যে প্রদেশের কাছে বিক্রি করবে। কিন্তু গোড্ডার ক্ষেত্রে আদানি এক বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছেন বলে জানালেন সাবেক কর্মকর্তারা। তাঁর প্ল্যান্টে উৎপন্ন বিদ্যুৎ তিনি ঝাড়খণ্ডের বদলে ভারতের অন্যান্য অংশে পাঠানোর প্রস্তাব দেন- এবং অবশ্যই বেশি দামে।

 

ঝাড়খণ্ডের অর্থনীতি ও শক্তি বিষয়ক কর্মকর্তারা এতে বাধা দেন।

 

২০১৬ সালে প্রদেশটির শক্তি বিষয়ক কর্মকর্তাদের করা একটি বিশ্লেষণ ওয়াশিংটন পোস্টের নজরে এসেছিলো। সেটি অনুযায়ী, আদানির প্রস্তাব অনুযায়ী আগালে প্রতি বছর ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ক্ষতি হবে ২৪ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ, আর প্রকল্প চলাকালে আদানির ১১০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ সাশ্রয় হবে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল ডট ইন এর তথ্য অনুযায়ী, প্রদেশের হিসাবপরীক্ষকেরাও এ ব্যবস্থার বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন।

 

প্রকল্প নিশ্চিত হওয়ার পর গৌতম আদানির ছোট ভাই এবং আদানি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজেশ আদানি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এবং মোদির দল বিজেপির সদস্য রঘুবর দাসের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে যান। পরদিন সকালে সোভিয়েত প্রকৌশলীদের তৈরি ঝাড়খণ্ডের সরকারি ভবন প্রজেক্ট হাউজের কেবিনেট কক্ষে তাঁর সহকারীদের ডেকে পাঠান দাস। এমনটাই স্মৃতিচারণ করছিলেন সেখানে উপস্থিত একজন প্রাক্তন প্রাদেশিক কর্মকর্তা।

 

প্রতিহিংসার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে রাজি হওয়া সেই প্রাক্তন কর্মকর্তার বয়ান অনুযায়ী, দাস তাঁর সহকারীদের বলেন যে, “এটা অবশ্যই জলদি করতে হবে। যেটাই করা দরকার হোক না কেন, করে ফেলুন।”

 

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ঝাড়খণ্ড সরকার ২৫ শতাংশ নীতি সংশোধন করে। আদানির প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়।

 

কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো এক স্মারকলিপিতে প্রাদেশিক কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা করেন যে, মোদির প্রদেশ সফরের ফলেই এই প্রকল্পের সূচনা হয়েছে এবং তাঁরা সরকারের উচ্চতম মহল থেকে “অ্যাপ্রুভাল ইন প্রিন্সিপল” পেয়ে গেছেন- আদানির নির্বাহীরা এ কথা জানানোর পর তাঁরা প্ল্যান্টটির বিষয়ে অনুমতি দেন।

 

ঝাড়খণ্ডের কর্মকর্তারা যখন এই প্রকল্প নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিলেন, তখন একই ধরনের অন্য একটা প্রকল্প নয়া দিল্লিতে পরিবেশগত অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিলো।

 

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কমিটি সদস্য সি আর বাবু জানান, আদানির প্রস্তাব বিবেচনার জন্য গঠিত প্রথম পরিবেশ নিরীক্ষা কমিটিটি বাংলাদেশের কাজে আসবে কিন্তু ভারতের ভেতরে দূষণ বাড়াবে এমন একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে অস্বস্তি অনুভব করছিলো। পাঁচ মাস ধরে প্যানেলটি বারবার কোম্পানির সঙ্গে পাল্টাপাল্টি আলোচনায় বসেছে, কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে কমিটি বাতিল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এটি প্ল্যান্টটিকে অনুমোদন করেনি।

 

দ্বিতীয় আরেকটি কমিটি গঠনের পর ২০১৬ সালের শেষের দিকে তখনকার পরিবেশ মন্ত্রী অনিল দেব প্যানেলকে মোদি সরকারের মূলমন্ত্র “ব্যবসাকে সহজ করে তোলা”র বিষয়ে মনে করিয়ে দিতে এর প্রথম সভায় উপস্থিত হন। এমনটাই স্মরণ করছিলেন সেই নতুন কমিটির একজন সদস্য পরিবেশ গবেষক শরচ্চন্দ্র লেলে।

 

নতুন এই কমিটি গোড্ডার গ্রামবাসীদের চিঠির বন্যায় একরকম ভেসে গেলো, যেসব চিঠিতে থাকতো দূষণ বিষয়ক উদ্বেগ এবং প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা। লেলে বলেন, তা সত্ত্বেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা অনড় থাকলেন এবং বললেন যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির স্থানীয় সমর্থকও আছে।

 

একটি সভার পরেই নতুন এই প্যানেল গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়।

 

২০১৮ সালের শুরুর দিকে আদানি প্রয়োজনীয় সব অনুমতিই পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপরও একটা বাধা ছিলো: তা হলো শত শত কোটি ডলার মূল্যের কয়লার ওপর সম্ভাব্য যে কর ধার্য হবে, সেটি।

 

সে বছর ফেব্রুয়ারিতেই কোম্পানিটি গোড্ডা সাইটে একটি এসইজেড তৈরির জন্য আবেদন করে। এই অনুরোধ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছিলো, কারণ ২০১৬ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে করমুক্ত জোন তৈরির বিষয়ে বিশেষভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেছিলো। নীতির বিষয়ে উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়টি এই অনুরোধ রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

 

এক মাস পরেই অবশ্য মন্ত্রণালয় মন বদলে ফেললো। সভার বিবরণী থেকে দেখা যায় যে, মোদির মিত্র তখনকার বাণিজ্য মন্ত্রী সুরেশ প্রভুর নির্দেশনায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্মকর্তারা এসইজেড নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দেন এবং বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেন। কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিলো, আদানির প্রস্তাবিত এ ধরনের করমুক্ত এলাকা বিদ্যুৎ রফতানির পক্ষে সহায় হবে। এক মাস পরে আদানি তাঁর এসইজেড পেয়ে যান।

 

ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাব থেকে দেখা যায়, আদানি কেবল গোড্ডায় কয়লা আমদানির ক্ষেত্রেই বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা সাশ্রয় করবেন। আমদানিকৃত প্রতি টন কয়লার ওপর সাধারণত ৪০০ রুপি বা ৫ মার্কিন ডলারের মতো কর ধার্য হয়।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কীভাবে এসইজেডের অনুমোদন করলো, ভারতের তথ্য অধিকার আইন অনুসারে এ বছর ওয়াশিংটন পোস্ট সে সংক্রান্ত তথ্য জানতে চায়। ছয় মাসব্যাপী আপিল প্রক্রিয়ার পরে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান যে, এ ধরনের কোনো তথ্যের অস্তিত্ব নেই।

 

প্রাক্তন বাণিজ্যমন্ত্রী প্রভু এবং ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দাস তাঁদের ব্যক্তিগত সহকারীদের মাধ্যমে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বিদ্যুৎ প্রকল্প তদারককারী পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা তন্ময় কুমারের দপ্তরও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

 

 

ক্রমবর্ধমান প্রভাব

২০১৪ সালের মে মাসে বিজয়ী মোদি গুজরাটের রাজপথ থেকে হাত নাড়েন, তারপর শপথ গ্রহণের জন্য দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন। ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীকে যে এম্ব্রেয়ার জেটটি বহন করছিলো, সেটি প্রচারণার পুরো সময় জুড়েই মোদির ভ্রমণের সঙ্গী ছিলো। বিমানটির গায়ে আলাদা ধরনের একটা বেগুনি-নীলরঙা লোগো ছিলো, যাতে লেখা: আদানি।

 

 

আদানির বিমানে ওঠার সময়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন বিজয়ী মোদি। ছবি: পিটিআই

 

 

ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের নবনির্বাচিত নেতা ঘোষণা করেন যে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন তাঁর “প্রধান লক্ষ্য” এবং এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তিসহ যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি মূল ভূমিকা পালন করবে। ২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলন অনু ষ্ঠিত হওয়ার আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে মোদি জানান যে, ২০২২ সালের মধ্যে ভারত ১৭৫ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তির সংস্থান করবে এবং কয়লার ওপর কর বসাবে।

 

দেশে ফেরার পর তাঁর প্রশাসনই হ্রাসকৃত দামে কয়লা দিয়ে দিতে সহায়তা করে।

 

মোদির প্রাক্তন কয়লা সচিব অনিল স্বরূপ জানান যে, ২০১৫ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে এমন কতিপয় “সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী” রাষ্ট্রের কয়লা খনি জায়ান্ট কোল ইন্ডিয়া কর্তৃক উৎপন্ন কয়লা হ্রাসকৃত দামে পাওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানায়। মোদির সহকারী স্বরূপকে ডেকে পাঠান এবং বারবার কয়লা দিয়ে দিতে বলেন। স্বরূপ জানান, তিনি এরপরও তা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং দ্রুতই তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

 

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দিনে ১৮০০০ টন কয়লা পোড়াবে এবং বছরে এর জন্য বছরে ৩.৬ কোটি কিউবিক লিটার পানি প্রয়োজন হবে

 

এর কিছুদিন পরেই মোদির মন্ত্রীসভা কোল ইন্ডিয়া যাতে বেসরকারি ক্রেতাদেরকে কম দামে কয়লা দিতে পারে সেজন্য নীতিমালা সংশোধন করেন। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, আদানি এক কোটি টনের সবথেকে বড় শেয়ারটা পান, যা মোট কয়লার এক-তৃতীয়াংশ। কয়লা বণ্টনের পর সরকার এক বিবৃতিতে বলে যে, এই নীতি সবার জন্যই কল্যাণকর। কারণ এর ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকেরা “দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহের নিরাপত্তা পাচ্ছেন… আর ভোক্তারা এর সুবিধা পাবেন” বিদ্যুতের দাম কমার মাধ্যমে।

 

আদানির বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি হননি স্বরূপ। কিন্তু পুরো বিষয়টা সম্বন্ধে সাধারণভাবে তিনি বলেন, “নির্দিষ্ট কয়েকজন শিল্পপতিকে শক্তিশালী করে তুলতে সরকার পদ্ধতিগতভাবে চেষ্টা করে গেছে।”

 

আদানির কয়লার ব্যবসা বেড়েই চলেছে। গোড্ডাসহ মোট ৮৭৬০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে আছে তাঁর। শুধু গত দুই বছরেই নতুন নয়টি কয়লাখনির মালিক হয়েছেন আদানি। এর মধ্যে ভারতীয় কর্মকর্তারা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্বিগুণ করেছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, তাঁদের পরিকল্পনা হলো সামনের বছরগুলোতে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ সক্ষমতা আরো ২৫ শতাংশ বাড়ানো।

 

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অন্তত সাতটি মানহানির মামলা করতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন আদানি। কর কমাতে আদানির এসইজেড এর ব্যবহার বিষয়ে অনুসন্ধানী তথ্য প্রকাশকারী দুই সাংবাদিক পরাণজয় গুহঠাকুরতা এবং আবীর দাশগুপ্তের ওপর তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা (gag orders) জারি করেছে গুজরাটের একটি আদালত

 

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ ঈশ্বরণ সোমনাথন বলেন, “সরকারের কয়লা ব্যবহার বহাল রাখতে চাওয়ার একটা কারণ হলো কয়লা সম্পদের মালিক যারা তারা অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি, আর তারা এই সম্পদের শেষ রুপিটা পর্যন্ত নিংড়ে নিতে চায়।”

 

কয়লার ব্যবসার সঙ্গেসঙ্গে আদানির নজরদারি এড়ানোর ক্ষমতাও বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর দেশের বৃহত্তম কয়লা খনি তৈরির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের কয়েক বছর ধরে চলা আন্দোলন রুখে দিয়েছেন তিনি। আদানির কারমাইকেল খনি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে, যা সম্ভবত গোড্ডা কেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহ করবে।

 

প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কোম্পানিটির ১০০০ একর জমি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন দরকার ছিলো। যেসব কৃষকের জমি ছিলো তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় কোম্পানিটি, আর খামারের যেসব মজুরের জমি নেই তাদেরকে কাজ দেয়। এছাড়া গ্রামবাসীদের নতুন জুতো, পোশাক, বিদ্যালয় এবং শৌচাগারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে কোম্পানিটি

 

ভারতে আমদানিকৃত কয়লা এবং যন্ত্রাংশের দাম বাড়িয়ে বলে আদানি গ্রুপ জনগণের কাছে বিদ্যুৎ বাবদ বেশি টাকা দাবি করছে এরকম অভিযোগ থাকলেও কর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে তদন্ত করতে হিমশিম খেয়েছে। আদানির উকিলেরা অভিযোগ করেন যে, ভারতের কর কর্তৃপক্ষ অনধিকার চর্চা করছে। কর তদন্তকারীদের কোম্পানির রেকর্ড প্রাপ্তির প্রচেষ্টা আদালতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং তদন্ত চলবে কিনা সে বিষয়ে রাজস্ব বিভাগ উচ্চ আদালতে আদানির বিপক্ষে লড়ছে।

 

একইভাবে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অন্তত সাতটি মানহানির মামলা করতে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন আদানি। কর কমাতে আদানির এসইজেড এর ব্যবহার বিষয়ে অনুসন্ধানী তথ্য প্রকাশকারী দুই সাংবাদিক পরাণজয় গুহঠাকুরতা এবং আবীর দাশগুপ্তের ওপর তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা (gag orders) জারি করেছে গুজরাটের একটি আদালত। জুলাই মাসে পুলিশ মানহানির অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে রবি নায়ার নামে আরেকজন সাংবাদিকের দিল্লির বাড়িতে উপস্থিত হয়।

 

নায়ারকে গ্রেফতার করা না হলেও তিনি গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেন। আদানির কয়লা খনি এবং অন্যান্য পার্শ্ব-বিনিয়োগকারী (offshore investors) সম্বন্ধে নিবন্ধ লিখেছেন নায়ার। তিনি জানান, কোম্পানির কয়েকজন নির্বাহী তাঁকে দেখা করতে ডেকেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, আদানি একজন “ক্ষমতাবান ব্যক্তি।”

 

নায়ার জানান, “প্রথমে তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমি কী চাই। তারপর হুমকিটা আসে।”

 

 

অপূর্ণ প্রতিজ্ঞা

২০১৫ সালে যখন আদানির প্রতিনিধিরা গোড্ডায় আসেন, তারাও বন্ধুসুলভ প্রস্তাব নিয়েই এসেছিলেন বলে গ্রামবাসীরা জানান।

 

প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কোম্পানিটির ১০০০ একর জমি এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন দরকার ছিলো। যেসব কৃষকের জমি ছিলো তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় কোম্পানিটি, আর খামারের যেসব মজুরের জমি নেই তাদেরকে কাজ দেয়। এছাড়া গ্রামবাসীদের নতুন জুতো, পোশাক, বিদ্যালয় এবং শৌচাগারের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে কোম্পানিটি।

 

 

গোড্ডায় আদানির কয়লাকেন্দ্রের বাইরে বিশ্রাম করছেন শ্রমিকরা। ছবি: ওয়াশিংটন পোস্ট

 

 

দরিদ্র একটি অঞ্চল, যেখানে ৬০ শতাংশ নারীই নিরক্ষর এবং বেশিরভাগ বাসিন্দাই খড়ের চালার নামমাত্র ঘরে বাস করে, সেখানে এই প্রকল্পটিকে প্রথমে সম্ভাবনাময় বলেই মনে হয়।

 

অনেক ভূস্বামীই একে সমর্থন দেন। কিন্তু অন্য অনেক গ্রামবাসীই বিষয়টা সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করা নিচু জাতের মজুর। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক চিন্তামণি সাহু সভা করতে শুরু করেন, যেখানে শত শত মানুষ আসতে থাকে। এর মধ্যে উদ্যমী স্থানীয় আইনপ্রণেতা প্রদীপ যাদব আদানির বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন এবং স্থানীয়দের মত বদলে যেতে থাকে।

 

পরিবেশবাদীরা সমবেত জনতাকে বলেন যে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দিনে ১৮০০০ টন কয়লা পোড়াবে এবং বছরে এর জন্য বছরে ৩.৬ কোটি কিউবিক লিটার পানি প্রয়োজন হবে। সাহু জানান, তারা এ-ও বলেন কীভাবে ৯০০ ফুট লম্বা চিমনিটা আট মাইল পর্যন্ত এলাকাকে দূষিত করবে এবং কীভাবে তা ফসল ও জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলবে। সাহু এখনও সহজেই সংখ্যাগুলো মনে করতে পারেন।

 

গ্রামবাসীরা জানান, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যখন স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রকল্পটি আগানো উচিত কিনা সে বিষয়ে শুনানির আয়োজন করেছিলেন, তখন সেখানে কেবল তাদেরই ঢুকতে দেওয়া হয়েছিলো যাদের সঙ্গে হলুদ রঙের আমন্ত্রণপত্র ছিলো। সেই আমন্ত্রণপত্র কে বিলি করেছিলো তা স্পষ্ট না হলেও সাহু এবং যাদবের বিশ্বাস, সেখানে কোম্পানির হাত ছিলো।

 

হলের বাইরে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এদিকে হলের ভেতরে জেলা প্রশাসক হাত তোলার মাধ্যমে মতামত নেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, উপস্থিত ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশই আদানির পক্ষে।

 

২০১৭ সালের মার্চে দ্বিতীয় একটি শুনানিতে কয়েকশো পুলিশ অফিসার যাদব এবং তাঁর সমর্থকদের মঞ্চে এসে কথা বলতে বাধা দেন, যার ফলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের হাতাহাতি হয়। প্রত্যক্ষদর্শী এবং সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাটন চার্জ করে, টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে এবং বাতাসে ফাঁকা গুলি চালায়।

 

যাদব বলেন, “স্থানীয় কর্মকর্তা আর পুলিশ সরকারের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করেছে। একটা প্রকল্পের বিষয়ে যদি জনসমর্থন থাকেই, তাহলে সেটা জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে কেন?”

 

২০১৭ সালের এপ্রিলে যাদব এবং সাহু শেষ একটি অস্ত্র প্রয়োগ করেন: সেটা হলো অনশন আন্দোলন। দিনের বেলা তাঁরা “বাড়ি যাও, আদানি!” (Go home, Adani!) স্লোগান দিয়ে গোড্ডাজুড়ে মিছিল করেন। রাতেরবেলা মাটিকে পবিত্র দেবী বলে জয়ধ্বনি দেওয়া এক বিশাল জনতার নেতৃত্ব দেন যাদব।

 

সপ্তম দিন ভোর হওয়ার আগেই পুলিশ এসে যাদবকে গ্রেফতার করে। গণবিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে ছয় মাস কারাগারে কাটান তিনি, এবং তাঁর আন্দোলন গতি হারায়। ভূস্বামীরা জমি বেচতে শুরু করেন। বিক্ষোভকারীরা হাল ছেড়ে দেন।

 

আদানির নির্মাণ এলাকায় দুই মাস পর কাজ হারানোর পরে প্রদীপ যাদবকে সমর্থন যুগিয়েছিলেন ইঁট প্রস্তুতকারী বচ্চন যাদব। তিনি বলেন, “হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম আমরা। আমি জীবনে কখনও এতো পুলিশ দেখিনি। আমাদের নেতাকেই যদি গ্রেফতার করতে পারে, তাহলে আমরা আর কী করবো?”

 

এখন মোতিয়া গ্রামের শেষ বাড়িটার ঠিক পেছনের দেওয়ালের পেছনেই আকাশচুম্বী বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু গড়ে ওঠেনি সেই স্কুল বা শৌচাগার, ব্যবস্থা হয়নি সার্বক্ষণিক পানি বা নতুন কাজের- অর্থার আদানি যেসবের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার বেশিরভাগেরই।

 

গ্রামের মানুষ জানান, কোম্পানির প্রতিনিধিরা ফিরে আসেননি। স্থানীয় পুরুষদেরকে কোম্পানি কাজে নিচ্ছিলো কম, এবং সেই সংখ্যাও দিনকেদিন কমছিলো। তাঁরাও অন্য জায়গায় কাজ খুঁজতে বাধ্য হয়ে চলে গেছেন। পেছনে পড়ে আছেন নারী ও শিশুরা, যে সামান্য আবাদী জমি অবশিষ্ট আছে তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন তাঁরা।

 

৪০ বছর বয়সী মীনা দেবী জানান, আদানি প্ল্যান্টে কাজ পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁর কিশোর পুত্র এই গ্রীষ্মে কাজের খোঁজে দিল্লি গেছে।

 

 

মীনা দেবী (৪০)। আদানি প্ল্যান্টে কাজ না পেয়ে কাজের খোঁজে দিল্লি গেছে তাঁর কিশোর ছেলে। ছবি: ওয়াশিংটন পোস্ট

 

 

দেবী জানতে চান, “আমরা আর কী করতে পারি? খাওয়ার জন্য আমাদের টাকা দরকার।”

 

কাদামাখা একটা জায়গায় দেবীকে ঘিরে জড়ো হন গ্রামের আরো মানুষ, শোনান আদানির বিরুদ্ধে তাঁদের নিজস্ব লড়াইয়ের কথা। কেউ বলেন তাঁকে তারা ভয় পেতেন, কেউ আবার তাঁকে দেখে বিস্মিত হতেন। অনেকেই স্বীকার করেন,যে খবরের কাগজ কেবল তাদের সন্তানেরা পড়তে পারে, সেই খবরের কাগজ আর টেলিভিশনে আসার মতো প্রভাবশালী একজন লোক সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা ছিলো খুবই ভাসা ভাসা। যখন বলা হলো তিনি পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের একজন, তখন হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে আশ্চর্য নীরবতা নেমে আসলো।

 

বচ্চন যাদব বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে কথাটা সত্যি।

 

ইঁট প্রস্তুতকারী বললেন, “লোকে বলে উনি যে কোনোকিছু করতে পারেন। আর যে কোনোকিছু উনি করাতেও পারেন।”

 

 

অনুবাদ: দীপান্বিতা কিংশুক ঋতি