
মার্কিন দখলদার বাহিনী ২০২১ সালে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের কাছে হস্তান্তরের পূর্ব মুহূর্তে আফগানিস্তানের তৎকালীন দুর্নীতিবাজ পুতুল প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি বিমানভর্তি ডলার নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার দিন দুয়েকের মধ্যেই ইস্তানবুল থেকে কনক সারোয়ারের সঙ্গে তার ইউটিউব চ্যানেলে এক টক শোতে যোগ দিয়েছিলাম।
আমি সেদিন মন্তব্য করেছিলাম, আফগান প্রেসিডেন্ট পালিয়েছেন, হাসিনাও পালাবেন। সেইসঙ্গে আরও যোগ করেছিলাম, হাসিনাকে তার প্রভুর দেশ দিল্লিতেই পালাতে হবে। কনক সারোয়ারের ইউটিউব চ্যানেলে খুঁজলে ‘আফগান প্রেসিডেন্ট পালিয়েছেন, হাসিনাও পালাবেন’ থাম্বনেইলের ওই ভিডিও আজও পাওয়া যাবে। বিদেশি শক্তির তাঁবেদার সেই আশরাফ গনি এখন আমিরাতে আছেন। গনির পালানোর তিন বছর পর হাসিনাকেও পালিয়ে শেষ পর্যন্ত দিল্লিতেই যেতে হয়েছে। এদিকে হাসিনার পতনের বছরেই সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আসাদও রাশিয়ায় পালিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। ২০২৪ সালে মুসলিম বিশ্বের দুটি দেশ ভয়ংকর দুই স্বৈরশাসকের দীর্ঘ অপশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে।
আফগানিস্তানের গনি ও সিরিয়ার আসাদ, উভয়ই দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সপরিবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে বিদেশে নীরবে দিন কাটাচ্ছেন। পুরোনো মিত্রদের আশ্রয় দিলেও আফগানিস্তান ও সিরিয়ার বর্তমান শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি যাতে না হয়, সেজন্য আমিরাত ও রাশিয়া পতিত স্বৈরশাসকদের তাদের দেশে অবস্থান করার সুযোগ দিলেও কোনোরকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে দেয়নি। কিন্তু ভারত এতটাই দুর্বিনীত যে, হাসিনাকে কেবল আশ্রয়ই দেয়নি, তাকে ব্যবহার করে দেশটি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সব রকম অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর থেকেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য এক ভয়ানক বিপদ রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে দিতে সমর্থ হওয়ার পর এই অঞ্চলে ভারতের নীতি আরও আগ্রাসী হয়েছে। পাকিস্তানকে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের শাসকশ্রেণির মধ্যে আস্থা জন্মে গিয়েছিল যে, দেশটি এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একচ্ছত্র প্রভুত্ব কায়েম করে ফেলতে পারে। পাকিস্তান তো জন্ম থেকে শত্রু ছিলই। একাত্তর-পরবর্তী সময়কালে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকেও প্রতিনিয়ত আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিটির যাবতীয় কূটকৌশল মোকাবিলা করে নিজ নিজ সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সাধ্যমতো লড়াই করে যেতে হচ্ছে। ভুটান যেহেতু কখনোই প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি, সেজন্য হিমালয়ের রাজ্যটির কথা উল্লেখ আর করলাম না। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এবং ভারতে ক্রমাগত কট্টর হিন্দু রাজনীতির উত্থানের কারণে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। একটানা ১৫ বছর বাংলাদেশকে কার্যত অঘোষিত উপনিবেশ বানিয়ে রাখার পর জুলাইয়ের মহান বিপ্লবে এজেন্ট হাসিনার পতনে দিল্লি রীতিমতো লাজলজ্জাহীন উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে মোদির নালিশ।
বিপ্লব-পরবর্তী মাসগুলোয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি ও প্রকাশ্য সামরিক আক্রমণ পরিচালনা ছাড়া ভারত সরকার আর সব অস্ত্রই ব্যবহার করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ত্রিপুরায় পুলিশের নাকের ডগায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদীরা ভাঙচুর চালিয়েছে, বাংলাদেশের পতাকায় আগুন দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এবং সে দেশের উগ্র হিন্দুরা মিলে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর হামলা করে চলেছে। ভারতীয় মিডিয়া অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও চন্দন দাস নামে এক সন্ত্রাসী হিন্দুর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর জন্য যথাসম্ভব উসকানি দিয়েছে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন ইসকনকেও সেই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দোসর ও সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন অযৌক্তিক ইস্যু তৈরি করে প্রায় প্রতিদিন দেশকে বিশৃঙ্খল করার চেষ্টা করছে। নানা উপায়ে বাণিজ্য অবরোধের চেষ্টা করেও দিল্লি ব্যর্থ হয়েছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি চাঙ্গা থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতীয় চাপ মোকাবিলা করতে সমর্থ হয়েছে। অবশেষে সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি অতি ব্যবহারে জীর্ণ সেই পুরোনো হিন্দু কার্ড হাতে ট্রাম্পের দ্বারস্থ হয়ে রীতিমতো নাজেহাল হয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মোদির সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। বেশ তির্যক ভাষায় ট্রাম্প বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারত-বাংলাদেশ বিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার কোনো বাসনা নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি মোদিকেই তার সমস্যা সমাধান করতে উপদেশ দিয়েছেন। ট্রাম্পের কথার অর্থ প্রথমে ধরতে না পেরে উল্লসিত ভারতীয় মিডিয়া সোৎসাহে প্রচার শুরু করে দিয়েছিল যে, ট্রাম্প নাকি বাংলাদেশের ভাগ্য মোদির হাতে তুলে দিয়েছেন। সেসব মিডিয়ার মূর্খ সংবাদ বিশ্লেষকরা এমন ভাব দেখাচ্ছিলেন যেন ড. ইউনূস সরকার এই গেল বলে। বাংলাদেশেও ভারতপন্থি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রথম ২৪ ঘণ্টা ভারতীয় বন্ধুদের সুরে গান গাইতে শুরু করলে দেশপ্রেমিক জনগণ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিপদ বুঝতে পেরে কথিত সুশীল পত্রিকাটি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় এবং মিথ্যা সংবাদ সংশোধন করে নেয়। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে—বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সমস্যাটা আদতে কী?
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ভারতের ইচ্ছা ছিল ভুটানের মতো আমাদেরও একেবারে কব্জা করে ফেলা। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশাল সরকারের পতন হলে ভারত বাংলাদেশ থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত দিল্লির পক্ষে বাংলাদেশকে পুনর্বার করায়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এলে দিল্লি ধরে নেয় ঢাকায় এত দিনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। আনন্দের আতিশয্যে দেশটির এক জেনারেল দম্ভভরে ঘোষণা দিয়েই ফেললেন, বাংলাদেশকে আর কোনোদিন ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। আত্মম্ভরী ও চরম হেজেমনিক ভারত যেকোনো মূল্যে হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়ার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যকার সময়কালে শেখ হাসিনার অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অনুপ্রবেশ ঘটানো হলে এ দেশের জনগণের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। সামরিক বাহিনী ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভারত একপ্রকার দিল্লির কর্মচারীতে পরিণত করেছিল। ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের সব সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনই এক হতাশাজনক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের লড়াকু তরুণ ছাত্রজনতা জুলাই বিপ্লব ঘটিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলল। কোনো ধরনের বিদেশি সহায়তা ছাড়াই নিরস্ত্র জনগণের অভ্যুত্থানে এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল—মহান আল্লাহ তায়ালাই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।
এদিকে ভারত এই লজ্জাজনক পরাজয় মেনে না নিতে পেরে বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লবে বিদেশি সংশ্লিষ্টতার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই ভুয়া তত্ত্ব নিয়ে মোদি ট্রাম্পের দরবারে হাজির হয়ে সবচেয়ে বড় ভুলটি করে ফেলেছেন। হাসিনার পতনের জন্য মোদি ও তার দলবল কেবল সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দোষারোপ করেই ক্ষান্ত হলেন না, স্পর্ধাভরে তারা মার্কিন ডিপ স্টেটকেও দায়ী করে বসলেন। চাণক্যের দেশের রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদদের এমন ভুল বিস্ময়কর। সচরাচর গণতান্ত্রিক পশ্চিমা দেশগুলোয় রাষ্ট্রক্ষমতায় ব্যক্তি বা দলের পরিবর্তন হলেও ডিপ স্টেটের পেশাদারিত্বের কোনো পরিবর্তন হয় না। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে সে দেশের ডিপ স্টেটের বিরুদ্ধে অন্য দেশের কোনো সমালোচনা মেনে নেওয়া অসম্ভব। ভারতের এই অভিযোগে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই বিরক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মোদির ওয়াশিংটনকে উত্তেজিত করার অপচেষ্টা তাই বুমেরাং হয়ে গেছে। তাহলে কি ড. ইউনূস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার অপচেষ্টায় ভারত সরকার এবার ক্ষান্ত দেবে, এখন থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করবে? দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আগ্রাসনের ইতিহাস থেকে এতটা আশাবাদী হওয়া কঠিন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা ভারত অব্যাহত রাখবে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি অপ্রত্যাশিতভাবে জিতে গেলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি খালেদা জিয়ার সরকারকে এক দিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। হাসিনা অক্ষরে অক্ষরে তার কথা রেখেছিলেন। এবারো মোদি-হাসিনা জুটি সব উপায়ে ইউনূস সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করে যাবে। পাশাপাশি ভারত আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য বিজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ারও চেষ্টা চালাবে, যাতে নির্বাচনের পর সরকার গঠিত হলে হাসিনা সরকারের আমলের মতোই বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যে ‘র’-এর এজেন্টরা আবার ঢুকে যেতে পারে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত বাংলাদেশের তরুণদের সেই নব্য ভারতীয় দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি এখন থেকেই নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় আমি প্রধানত তরুণদের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা জানার চেষ্টা করছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, কেমন করে তারা জীবনকে তুচ্ছ করে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে পারল। তাদের সাহস ও দেশপ্রেমে আমি প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত ও আশান্বিত হয়েছি।
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, ইনশাআল্লাহ এই তরুণরা আঞ্চলিক হেজেমনিক রাষ্ট্রের সব চক্রান্তকে রুখে দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে।