বহুকাঙ্ক্ষিত এক দিন
ড. শামসুল আলম জানুয়ারি ১০, ২০২০
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাগমন হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। সেদিন লাখ লাখ জনতার আনন্দ-উল্লাস, উচ্ছ্বাসে ঢাকা উদ্বেলিত ছিল। লাখ লাখ জনতা সেই সময়ের রেসকোর্সে স্বাগত জানায়। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথ গাড়িবিহীন জনারণ্য পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর মোটর শোভযাত্রার সময় লেগেছিল ২ ঘণ্টা। সারা দেশই ছিল আনন্দে উদ্বেলিত।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে প্রধান করণীয় ছিল ছিন্নমূল বিপর্যস্ত কোটি মানুষের পুনর্বাসন আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের বিষয়টি। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, সেখানে অন্য সব বিষয়ের ওপর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসে তা হলো: ‘অর্থনীতিকে অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে। খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্র অবশ্যই দিতে হবে মানুষকে’ (বাঙালির মহামানব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মো. ফজলুল হক, ২০১৮)। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা আমার কাছে সেদিনই প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলাদেশের কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে’ (উদ্ধৃতি, ঐ পৃ. ৫৩, ২০১৮)।
বাংলাদেশ সরকার দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কৃষি উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, কৃষক ও সম্প্রসারণ জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষায়িত সেবা প্রদান, রফতানি উপযোগী কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ ও চুক্তিবদ্ধ চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলনসহ কৃষি কার্যক্রম বহুমুখীকরণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করা।
কৃষির জন্য অন্তঃপ্রাণ এক মহান নেতার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব। গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের মাঠে প্রয়োগের ফলে দানা শস্যসহ অন্যান্য কৃষিখাদ্যের উৎপাদন আজকে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে। সময়োপযোগী কৃষিনীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকারের কৃতিত্ব এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আর কৃষিক্ষেত্রে এ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যথার্থই অনুভব করেছিলেন—সোনার বাংলা রূপায়ণে কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী এক ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার অতীতের সরকারগুলোর মতো নয়। এ সরকার জনগণের সরকার। এ সরকার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সরকার। আমাদের এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যে সমাজে এ কৃষকরা, এই শ্রমিকরা, এই ক্ষুধার্ত জনগণ আবার হাসতে পারবে। জনগণের প্রাণধারণের অন্যতম চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করা না গেলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। কাজেই সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, মূলত সংগ্রাম মাত্র শুরু হয়েছে। এবারের সংগ্রাম সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রাম’ (বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অর্থনীতি, মো. শাহাদাৎ হোসেন, ২০১০)।
দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে এবং জমির ফলন যাতে বৃদ্ধি পায়, তার জন্য দেশের কৃষকসমাজকেই সচেষ্ট হতে হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা হবে না। জনগণের ঐক্যবদ্ধ কিন্তু নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির দ্রুত পুনর্গঠনের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে’ (উদ্ধৃতি ঐ)। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে।
তিনি শুধু একটি নতুন স্বাধীন দেশের সূচনা করেননি, সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে রেখে গেছেন অর্থনৈতিক দর্শন। সংবিধানেই স্থান দিয়েছেন দারিদ্র্যমুক্তির পথনির্দেশনা। ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার, শিল্পের বিকাশ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান, কৃষকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আমলের সব সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, সুদসহ কৃষিঋণ মওফুক, কৃষির আধুনিকায়নে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ, সমবায় গঠন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড তিনি স্বাধীনতার সূচনালগ্নেই শুরু করেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে ভাষণদানকালে কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের সমাজে চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে সব খাদ্যশস্য সেনানিবাসে স্থানান্তর করেছিল পরিকল্পিতভাবে। নয় মাস যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য খাদ্য আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। যুদ্ধের জন্য অনেক ক্ষেতে ফসল বোনা সম্ভব হয়নি। ফলে স্বাধীনতার পর পরই দেখা গেল সরকারি খাদ্যগুদাম শূন্য। জনযুদ্ধের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রাথমিক জরিপে উল্লেখ আছে যে শুধু খাদ্যশস্য আমদানি নয়, আগামী ফসল আবাদের জন্য কৃষকের হাতে তিন ভাগের এক ভাগ বীজধানও ছিল না তখন। সার, কীটনাশক ওষুধ, হালের বলদ, পাওয়ার পাম্প, গভীর নলকূপ সবকিছুই নতুন করে সংগ্রহ করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। জরিপে আরো উল্লেখ করা হয়, বাহাত্তরের কৃষি মৌসুমেই তিন হাজার মণ গমবীজ, বোরো ধানবীজ দুই হাজার মণ, ৩২০ হাজার টন সার, আলুবীজ ১ হাজার ৫০০ টন, ২০ হাজার পাওয়ার পাম্প তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজন। অথচ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যা আছে, তার পরিমাণ এতই নগণ্য যে তাতে ১০০ ভাগের ১০ ভাগ চাহিদাও মিটবে না। বিশ্বব্যাংক জরিপে কৃষি আবাদের এক লাখ বলদ ছাড়াও দুগ্ধবতী গাভীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে আবাদে যেমন বিঘ্ন ঘটবে, তেমনি সারা দেশে শিশুরা দুধের অভাবে অপুষ্টিতে ভুগবে। বিশ্বব্যাংকের জরিপে বসতবাড়িসহ সরকারি-বেসরকারি যেসব অফিস-আদালত, খাদ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল, গুদামঘর, স্কুল পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ওই প্রতিবেদনে শুধু গ্রামাঞ্চলেই ৪৩ লাখ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। উল্লেখ করা হয়েছিল, যারা ফিরে এসেছে, তাদের জন্য কমপক্ষে ১০ লাখ বসতবাড়ি নির্মাণের প্রয়োজন তাত্ক্ষণিকভাবে। ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির কথা ওই জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানিরা চট্টগ্রাম বন্দরটি সম্পূর্ণভাবে শুধু ধ্বংসই করেনি, বন্দর থেকে বহুদূর পর্যন্ত সমুদ্রপথে মাইন পেতে রেখেছিল, ফলে খাদ্যশস্য নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কোনো জাহাজ এসে যে আউটারে নোঙর করবে, সে উপায় ছিল না। তাছাড়া স্থলপথের রেল যোগাযোগ প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। সড়ক যোগাযোগও ধ্বংস করা হয়েছিল সেতুগুলো উড়িয়ে দিয়ে। খাদ্য পরিবহনকারী ট্রাক ও রেল-বগিগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মোট ৪৫ মাইল রেলপথ পুনঃস্থাপন না করা গেলে রেল যোগাযোগ কার্যকর পর্যায়ে আনা যাবে না। রেল-ইঞ্জিন মেরামতের কারখানাটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল ডিনামাইট দিয়ে। সড়ক বিভাগের রিপোর্টে (১৯৭২) উল্লেখ করা হয়েছিল, তাত্ক্ষণিকভাবে ১৩০টি বড় ও মধ্যম ধরনের সেতু সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। ১৫০টি ইঞ্জিনচালিত ফেরির প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, যতদিন সেতু নির্মাণ না করা হয়। অভ্যন্তরীণ নদীপথের সংস্কার ও কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০টি খাদ্যবাহী কার্গোর প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এতসব অভাব পূরণ হলে তবেই সুষ্ঠু খাদ্যশস্য পরিবহন সম্ভব। ২৩৭টি মাঝারি ও বড় আকারের শিল্প-কারখানার ১৯৫টি কারখানাই আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত, এগুলো সংস্কারের জন্য যন্ত্রাংশ ও কারিগরিভাবে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। প্রায় সব মিল-কারখানারই মালিক ছিল অবাঙালি (ব্যবস্থাপক পরিচালকরাও)। ৬৬৩টি ছোট ধরনের কারখানার প্রায় সব কয়টিই বন্ধ। বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য ছিল, শুধু ছোট ছোট কারখানা চালু করার জন্যই প্রায় ১ কোটি ডলার প্রয়োজন বিদেশ থেকে কাঁচামাল খরিদের জন্য। ওই প্রতিবেদনে আরো মন্তব্য করা হয়েছিল, কলকারখানা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে আপাতত কোনো দক্ষ পরিচালক নেই। ৯০০ কলেজ, ছয় হাজার হাই স্কুল কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সব মিলিয়ে নতুন তিন কোটি পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন। কাগজ নেই। কাগজের কলসহ অন্যান্য কলকারখানায় ৬৫ শতাংশ বিহারি শ্রমিক ছিলেন। তারা ১৬ ডিসেম্বরের পর পালিয়েছেন। খুলনা ও চন্দ্রঘোনা দুটি কাগজকল নতুন করে চালু করতে কমপক্ষে ছয় মাসের প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক জরিপ হিসাবে বলা হয়েছিল, স্কুল-কলেজগুলোর জন্য তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন ১০ হাজার শিক্ষকের। সারা দেশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। স্থানীয়ভাবে কোনো রকমে কিছু বিদ্যুৎ ব্যবস্থা টিকে ছিল। শিল্পের জন্যও বিদ্যুতের ব্যাপক অভাব ছিল। তবে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রয়োজন ছিল ১১ হাজার বিদ্যুৎ খুঁটির। ১৬ ডিসেম্বর সকালে স্টেট ব্যাংকের টাকা ব্যাংকের সামনে চত্বরে এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। এক হিসাবে দেখা যায়, যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে সম্পদ ধ্বংস হয়েছে এবং যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তার যে অর্থনৈতিক প্রভাব, সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ তত্কালীন বাজারমূল্যে প্রায় ২৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তত্কালীন বিনিময় হার অনুযায়ী ১১ হাজার ২৩৮ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা। এক কথায়, ৩০ লাখ শহীদের আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে ১৯৭১-এ যখন স্বাধীনতা পেলাম, তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি বলতে কিছুই ছিল না। প্রতিটি গ্রাম ছিল যোগাযোগবিচ্ছিন্ন, বৃহত্তর অর্থনীতির সঙ্গে প্রায় সংযোগবিহীন। সবুজ-শ্যামল দেশকে বিরান শশ্মান করেই হানাদার বাহিনী এ দেশ ছেড়েছে। বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরু হয়ে ছিল।
ড. শামসুল আলম: সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব)
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন