- বিপুল সংখ্যায় শ্রমিক ছাঁটাই
বিশেষ প্রতিনিধি
নারায়ণগঞ্জের রিএক্টিভ ড্রেস মেকার লিমিটেড রপ্তানি খাতের একটি মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত প্রায় একযুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটি কটন নীট টিশার্ট, কটন ওভেন ট্রাউজার, কটন ওভেন শার্টস, বেবিস কটন নীটেট গার্মেন্টস রপ্তানি করে আসছে। মূলত ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে এসব পোশাকের চাহিদাই বেশি। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের সঙ্গে কথা হয় গত ২১ ডিসেম্বর। জানতে চেয়েছিলাম বর্তমানে রপ্তানি পরিস্থিতি কেমন। তিনি জানালেন, গত দুই মাস ধরে তার প্রতিষ্ঠানটি আর রপ্তানি করছে না। একযুগ রপ্তানিতে মোটামুটি দাপট থাকলেও, এ বছরের অক্টোবরে এসে তিনি হাল ছেড়ে দেন। বন্ধ করে দেন প্রতিষ্ঠান। তাঁর কাছে আরেকটি প্রশ্ন ছিল, আর ক’টি প্রতিষ্ঠান এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে সেই তথ্য নিয়ে। বললেন, মাঝারি মানের ৪০ ভাগ কারখানা টিকে থাকবে না। কেউ বন্ধ করে দিচ্ছেন, আবার কেউবা সাব কন্টাক্ট-এ চলে গেছেন। রপ্তানিতে নেই এসব প্রতিষ্ঠান।
মাসুদ রানার তথ্য ধরে কথা হয় পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাদের হিসাবে বর্তমানে দেশে পোশাক কারখানা চালু আছে ২ হাজার ২৭৪টি। গত ৮ মাসে বন্ধ হয়ে গেছে ১ হাজার ৯২৬টি। অর্থাৎ মাসে ২৪০টি কারখানা গড়ে বন্ধ হয়েছে। হিসাবটির সাথে মিল পাওয়া গেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তর (ডিআইএফই)’র সঙ্গে। এই প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে করোনার সময়ে দেশের বিভিন্ন খাতের ১৫ হাজার ৯৯৫টি ছোটবড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যার মাঝে পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে ১৯১৫টি।
এতো শিল্প ইউনিট বন্ধ হওয়ার পরও সরকারি হিসাবে রপ্তানি আয় বাড়ছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে। এর রহস্য কি? জানতে চাইলে পোশাক খাতের একটি বড় গ্রুপের পরিচালক জানালেন, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ যে আয় করেছে, তার ৪৫ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক থেকে। মহামারীকালে অতি প্রয়োজনীয় কম দামের নিট পোশাকের ওপর ভর করে মোট রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির হার এ সময়ে (জুলাই-নভেম্বর) মাত্র শূণ্য দশমিক ৯৩ ভাগ। তিনি জানান, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট রপ্তানি আয় ছিল ৮১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার মধ্যে পোশাক খাতের আয় ছিল মাত্র ৩১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার। শতকরা হিসাবে এই হার মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ ভাগ। আর গেল অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ বছরে এসে দেশের মোট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৬৭৪ দশমিক ০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ। এর মাঝে শুধু পোশাক খাতের আয় ছিল ২৭ হাজার ৯৪৯ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। শতকরা হিসেবে বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ ভাগ আসছে এই খাতে। তিনি প্রশ্ন করেন ৮ মাসে যদি প্রায় ২ হাজার পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে শূণ্য দশমিক ৯৩ ভাগ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির তৃপ্তি কোথায়? বরং চরম বিপদ আসছে সামনের কয়েক মাসে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলার আশংকাও করেন বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের এই উদ্যোক্তা।
বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশ^বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা ৫৫ ভাগ কমে গেছে। গত ৮ মাসে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে বলে জানান তিনি। বিজিএমইএ’র সভাপতি আরো জানান, বিদেশী ক্রেতাদের ক্রয় আদেশ বাতিল হওয়ায় আগামী জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে আরও কয়েশ’ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ছাঁটাই হবে হাজার হাজার শ্রমিক।
এদিকে শিল্প এলাকা বলে পরিচিত গাজীপুরে সরজমিনে বিভিন্ন পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে মালিক পক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিক ছাঁটাই ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাদের। জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে গাজীপুর জেলায় মোট ১৭৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে ৭৬টি তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য এবং পাঁচটি নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য। বাকিগুলো সাবকন্ট্রাকটিং বা ঠিকা ভিত্তিতে কাজ করে এমন ধরনের কারখানা। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোয় কাজ করতেন প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তাঁদের মধ্যে অল্পসংখ্যক অন্য কারখানায় কাজ পেলেও অধিকাংশ এখনো বেকার রয়ে গেছেন। বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি হলেন্ড্রি এক্সপোর্টওয়্যার, প্যাসিফিক এ ওয়ান সোয়েটার, টেল্টা কোয়ালিটি, ওয়াগা স্টাইল ওয়াইজ, মার্ক মুড, ইউন্টেরিয়া টেক্সটাইল, ডিভাইন টেক্স সোয়েটার, আসিফ অ্যাপারেলস, এহসান ফ্যাশন, জারা ডেনিম, এলিগেন্স ওরিয়েন্টাল, সুপ্রিম ইন্ডাষ্ট্রিজ, অটো স্পিনিং, রেপিশন অ্যাপারেলস।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্ধ কারখানাগুলোর বেকার শ্রমিকদের বেশির ভাগই নতুন চাকরি না পেয়ে নিজ নিজ গ্রামে চলে গেছেন। তাঁদের অনেকেই বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে না পেরে রাতের আঁধারে বাসা ছেড়েছেন। যে কারণে তাঁরা যেসব বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেগুলো খালি পড়ে আছে। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক এলাকা ছেড়ে যাওয়ায় মহল্লায় মহল্লায় গড়ে ওঠা মুদিদোকানসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে। এর প্রভাবে স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
গাজীপুর মহানগরীর ছয়দানা এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সাঈদ আলী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ছয়তলা বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ির ২৪টি ফ্ল্যাটে পোশাকশ্রমিকেরা ভাড়া থাকতেন। কিন্তু তিন মাস ধরে ১৫টি ফ্ল্যাটই খালি রয়েছে। সাঈদ আলী বলেন, ‘একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে ভাড়াটে মিলছে না। অধিকাংশ ফ্ল্যাট খালি পড়ে থাকায় ব্যাংকের কিস্তিও দিতে পারছি না। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে ব্যাংকের কিস্তি ও সংসার চালানো দায়। এভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় নামতে হবে।’
বিসিক শিল্পনগরের নাইটিঙ্গেল ফ্যাশন লিমিটেডের তিনটি কারখানা গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে বন্ধ। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় মাসের পর মাস লোকসান গুনতে হচ্ছিল। তাই কারখানাগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক গত বছর গাজীপুরে বিজিএমইএর ৭৬টি সদস্য পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছেন।
গত ৮ মাসে যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে তার মধ্যে রাজধানীর অদূরে সাভার ও আশুলিয়ার সিগমা ফ্যাশনস লিমিটেড, ন্যাচারাল সোয়েটার ও পূর্বা সোয়েটার, মদিনা অ্যাপারেলস, নিউ আইডিএস সোয়েটার কারখানা রয়েছে।
সরজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে চোখে পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিগমা ফ্যাশনের নোটিশে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির কারণে কারখানা কর্তৃপক্ষ শত চেষ্টা করেও পর্যাপ্ত কাজ সংগ্রহ করতে পারেনি। ক্রমাগত ক্রয়াদেশ কমার ফলে কাজ বর্তমানে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এ কারণে কারখানা ক্রমাগত আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে, এমনকি দিন দিন ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ৩০ নভেম্বর থেকে কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে শ্রমিকদের ত্রিপক্ষীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আইনানুগ যাবতীয় সুবিধা পরিশোধ করা হবে।’
লে-অফ ঘোষণা করা মদিনা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘করোনার কারণে কারখানায় কাজ নেই। তাই কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু ক্রয়াদেশ স্থগিত আছে, সেগুলোর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলেই কারখানা আবার চালু করা হবে।’
সূত্র মতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার মূলত ইউরোপ এবং আমেরিকা কেন্দ্রীক। কিন্তু করোভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সেসব দেশের বড় ব্র্যান্ডগুলো তাদের অর্ডার বাতিল কিংবা স্থগিত করেছে। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক প্রাইমার্ক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে তারা ব্রিটেন, ইটালি, ফ্রান্স, স্পেন এবং অস্ট্রিয়াতে তাদের সব স্টোর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। শুধু ব্রিটেনজুড়ে তাদের প্রায় ২০০টি স্টোর রয়েছে।
আরেকটি নামকরা ব্র্যান্ড জারা বিশ্বজুড়ে তাদের প্রায় চার হাজার স্টোর বন্ধ রেখেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে।
গত কয়েক বছর ধরেই নানা কারণে দেশে শিল্পোদ্যোগের বড় অংশই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখছে না। তাই টিকতে না পেরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকেই বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের তোড়জোড় শুরু হলেও বাংলাদেশে এর প্রকোপ শুরু হয় মার্চ থেকে। ক্রমেই সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকার মার্চের শেষের দিকে এসে লকডাউনের আদলে দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করে। দুই থেকে আড়াই মাস শেষে অর্থনীতি ধীরে ধীরে চালু করা হলেও গতি আসেনি। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানিও কমে গেছে ব্যাপক হারে।
জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বাইরেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হচ্ছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) হিসাবে করোনা পরিস্থিতিতে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।