Site icon The Bangladesh Chronicle

বড় ঋণখেলাপিদেরকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে: সালেহউদ্দিন আহমেদ

রোববার আগস্ট ১৮, ২০২৪ ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: রোববার আগস্ট ১৮, ২০২৪ ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
‘আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ বিরাট কিছু নয়। আইএএফ বিশ্বব্যাংকের ঋণ দিয়ে শুধু রিজার্ভ বাড়ানো যাবে এটা ঠিক নয়।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন।

এর আগে বাংলাদেশ সরকারের নানা প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছে তিনি।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তবর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন আপনি। এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আপনারা মৌলিক বা বড় কোনো সংস্কারে হাতে দেবেন কি?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: এতদিন অনেক রকমের অনিয়ম হয়েছে। উন্নয়নের নামে অনিয়ম হয়েছে, প্রশাসনেও হয়েছে। আমাদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা করা। বিভিন্ন কারণে অর্থনীতির চাকা বেশ মন্থর হয়ে গেছে। এর পেছনে কিছু বৈশ্বিক কারণ আছে, আবার কিছু অভ্যন্তরীণ কারণ আছে। আমি মনে করি বেশিরভাগহ কারণ অভ্যন্তরীণ। তা না হলে তো সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত। করোনা হয়েছিল, এরপর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নানান টানাপোড়েন ছিল। আমাদের যে অর্থনৈতিক সমস্যা আছে, তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি একটি বিরাট সমস্যা। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, রাজস্ব আয়ের ব্যাপারে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে।

জ্বালানির ব্যাপারে কতগুলো সমস্যা আছে। এর সঙ্গে অর্থপাচার, দুর্নীতি আছে। আমাদের ইমিডিয়েট লক্ষ্যগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, কর-জিডিপি আয়, রিজার্ভ কমে যাওয়া, মুদ্রা বিনিময়ে টালমাটাল অবস্থা-এগুলো নিয়ে কাজ করা। এরসঙ্গে আমাদের দেশীয় শিল্প, আমদানি ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি।

যেমন: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চলে যাওয়ার পর পদটি শূন্য ছিল। আমরা গভর্নর নিয়োগ দিয়েছি। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়ে অনেক ইস্যু হলো, সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আর্থিক খাতে নিয়ম নীতিমালা পরিপালন করা হয়নি। সেগুলোর বেশিরভাগ বিশেষ ক্ষমতায় রহিত করা হয়েছে। যেমন সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিট না মেনে বহু টাকা নিয়ে গেছে। এগুলো এখন বন্ধ করা হয়েছে, গতকাল কয়েকটা প্রোপোজাল এসেছিল, কিন্তু বলেছি এগুলো দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা নিয়ে এসেছি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। আমি বলেছি পাসিং দ্য বাক (একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপানো) চলবে না, আমি করিনি আরেকজন করেছে বা আমার আগে করেছে এগুলো চলবে না। প্রত্যেককে দায়িত্ব নিতে হবে, প্রত্যেককে জবাবদিহি করতে হবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে আপনারা বড় কোনো সংস্কারে যাবেন কি না?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: অবশ্যই করব। যেমন আর্থক খাত সংস্কার, ব্যাংক খাত সংস্কার। সংস্কার নিয়ে আমরা দাতাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। সুতরাং সংস্কার আমরা করব। কিছু সংস্কার জরুরিভিত্তিকে দরকার, সেটা আমরা করব। আর কিছু আছে দীর্ঘমেয়দী সংস্কার। যেমন ব্যাংকিং কমিশন। আমরা এগুলো করব, হয়তো সব শেষ করতে পারব না। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে দাতারা জানতে চেয়েছে এগুলোর কী হবে। যেগুলো চালু আছে সেগুলো চলবে। তবে কিছু বড় প্রকল্প যা এখনো চালু হয়নি তা আমরা একনেকে পাঠাব।

গত দুই থেকে তিন বছর ধরে শুনছি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আপনারা তাদের চিহ্নিত করে কোনো ব্যবস্থা নিবেন কি না?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থপাচার নিয়ে একটা কমিটি আছে। আমরা ইতোমধ্যে সেই কমিটির বৈঠক করেছি। আড়াই বছর পর এই বৈঠক হয়েছে। অথচ বৈঠক তিন মাস পর পর হওয়ার কথা। আমি আসার সাত দিনের মধ্যে বৈঠক করলাম। এর আগে, অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে এই বৈঠক করেছিল। আমি এজন্য অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছি, আপনারা আড়াই বছর পরে কেন বসেছেন? এখন এগুলো আমাদের কাছে নিয়ে আসছেন!

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি, যারা অর্থপাচার করেছে তাদের তালিকা আপনাদের কাছে আছে। জরুরিভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। ওরা সম্প্রতি কয়েকটি তালিকা করেছে। আমি বলেছি, সাম্প্রতিক না, পুরনো যেগুলো আছে দ্রুত সেগুলোর তালিকা করবেন। তদন্ত সংস্থাগুলোকেও বলা হয়েছে, জরুরি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে। চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। মানুষ যেন জানতে পারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।

আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। আপনার জানার কথা, ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এদের ব্যাপারে আপনারা কী করবেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর উপস্থিত ছিলেন। ওনাকে খেলাপি ঋণের ব্যাপারে বলা হয়েছে। আমার সময়ে ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটা কয়েক গুণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে মূল দায়টা যেমন ব্যাংকের, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়ও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ বারবার পুনঃতফশিল করেছে, রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে। আমি বলেছি, এগুলো দ্রুত বন্ধ করতে হবে। আর কোনো নতুন রেয়াতি সুবিধা দেওয়া যাবে না। ঋণ পুনঃতফশিল করা যাবে না। আর যারা করেছে তাদের চিহ্নিত করে বিশেষ করে বড়গুলোকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।

প্রয়োজনে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলে বিশেষ বেঞ্চ বসানো হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো বলেছে, তারা ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এখন আর কোনো ছাড় নয়। ওই যে বললাম, সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিট থাকতেও একজনকে ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছে।

বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নেই। সরকারি হস্তক্ষেপসহ আরও নানা কথা বলা হয়। এটা আইনের সমস্যা নাকি ব্যক্তির সমস্যা, আপনার কী মনে হয়?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমি মনে করি এটা ব্যক্তির সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনটা যথেষ্ট ভালো এবং যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, কিছু কিছু জিনিস আছে, যেটা সরকারের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। কিন্তু সেটা ডে টু ডে না। এমনকি মনিটরি পলিসি কী হবে, সুদহার কত হবে, বিনিময় হার কী হবে- এগুলো সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এরপর আছে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, এটাও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব।

আমার সময়ে সরকার অনেক সময় যা বলত সঠিক মনে না হলে সেটা করতাম না। অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকে, আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ থাকে এবং আর যারা কাজ করে তারা ভয়ে বা কোনো কারণে হস্তক্ষেপ মেনে নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে তো অনেক উদ্যোগ নিতে পারে। হঠাৎ করে ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। অথচ এটা নিয়ে কোনো হোমওয়ার্কও করেনি। আমার মনে হয় এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমার মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে ততটা নয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনে কিছুটা ত্রুটি আছে।

রিজার্ভের ওপর চাপ আছে। এই অবস্থায় বাজেট সহায়তা, আইএমএফের ঋণ ইত্যাদি নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী হবে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: প্রথমত আমাদের এফডিআই আনার জন্য ব্যবসায়ের পরিবেশ ঠিক হতে হবে। ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে হবে। এর আগে, অনেক সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না। এখন আমরা বলেছি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে, যেসব প্রয়োজন দেখা দেবে সেগুলো দ্রুত সমাধান করা হবে। দ্বিতীয়ত, রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

আরেকটা হলো, আমরা শুনেছি টাকা-পয়সা চলে যাচ্ছে। কীভাবে যাচ্ছে, টাকাকে ডলারে কনভার্ট করে যাচ্ছে কি না- এগুলো আমরা অবশ্যই দেখব। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ক্ষেত্রে আর্থিক হিসাব বড় আকারে নেগেটিভ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে এটাকে পজিটিভ করা। কারণ এর একটা প্রভাব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রয়েছে।

এজন্য বাজেট সহায়তা, আইএমএফের ঋণ নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমার ব্যক্তিগত মত, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ বিরাট কিছু নয়। আইএএফ বিশ্বব্যাংকের ঋণ দিয়ে শুধু রিজার্ভ বাড়ানো যাবে এটা ঠিক নয়। তবে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণে কিছু শর্ত থাকে। যেমন আইএমএফের ঋণে সংস্কারের তাগিদ থাকে। তারা কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, ব্যাংক খাতে সংস্কারের কথা তারা বলেছে। এই সংস্কারগুলো কিন্তু আমাদেরও তাগিদ। অতএব ওদের চাওয়ার সঙ্গে আমাদের মিলে যাচ্ছে। ওরা দেখে আমাদের পারফরম্যান্স। সেটা কয়েক মাস হয়তো একটু ধীর হয়ে গেছে। তবুও আমরা তাদের পাশে পাব, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। ওরা বলেছে, তোমরা যেভাবে যাচ্ছ এটা যদি হয়, আমাদের বাজেট সহায়তা ও প্রজেক্ট সহায়তা আছে। আমরা তোমাদের সহযোগিতা করব।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ বাড়াতে হয়তো পিলিসি রেট বাড়ানোর দরকার হবে। পাশাপাশি ক্রলিং পেগে ডলারের যে মিডরেট আছে, সেটা হয়তো আরেকটু বাড়াতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কি সরকারের সমর্থন পাবে?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও বলেছেন, কতগুলো রেট রিভিজিট করতে হবে। এখানে যে ব্যবধান আছে তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। অবশ্যই তিনি এগুলো নিয়ে কাজ করবেন। এগুলো না হলে প্রবাসী আয় আসা ও বাজারে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। অতএব তারা এটা নিয়ে অবশ্যই কাজ করবেন। একইসঙ্গে ক্রলিং পেগ নিয়েও কাজ করবেন তারা।

অর্থনীতির জন্য রেভিনিউ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ এই সিস্টেমে ফাঁকি আছে, গোলমাল আছে- এগুলো নিয়ে আপনারা কী করবেন?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: ইতোমধ্যে সিস্টেম ঠিক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের লোকবল ঠিক করতে বলা হয়েছে। র্দীঘদিন ধরে ডিজিটালাইজেশনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু হয়নি। এই দুইটা ঠিক করলে কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকার কোনো কারণ থাকবে না। মানুষের কর দেওয়ার সক্ষমতা আছে, কর দিতে চাচ্ছে। আর যারা ফাঁকি দিতে চাচ্ছে, পায়তারা করছে- সিস্টেম ঠিক হলে তারা ফাঁকি দিতে পারবে না। তাই সিস্টেম ঠিক করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। গভর্নরকে এটা বলা হয়েছে। কারণ রাজস্ব না এলে আমরা খরচ করতে পারব না।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: এটাতো সরকার করেছে। বাকিগুলো আমরা রিভিজিট করব। শিক্ষকদের কিছু ব্যাপার আছে, আমরা অবশ্যই তাদের সঙ্গে কথা বলব।

জানতে চাচ্ছিলাম, সর্বজনীন পেনশন স্কিম থাকবে কি থাকবে না?

সালেহউদ্দিন আহমেদ: সর্বজনীন পেনশন স্কিম থাকবে। পৃথিবীর সব ভালো দেশেই সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য বিমা এগুলো থাকে। সুতরাং আমরা এগুলো করব।

 

Exit mobile version