আওয়ামী সরকারের বি-টিম হিসেবে এবার ভারতপন্থী তথাকথিত সুশীল এবং এনজিও মালিকদের সমন্বয়ে নতুন একটি প্লাটফর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। মরহুম ফজলে হাসান আবেদ-এর গড়া এনজিও ব্র্যাকের নেতৃত্বেই ভারতপন্থী সুশীল ও এনজিওদের এই প্লাটফর্মের সূচনা হয়েছে সম্প্রতি। আর এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন উপায়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকারের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা।
গত ২২ ডিসেম্বর ভারতীয় বাংলাদেশে কর্মরত এনজিও এবং কথিত নাগরিক সংগঠনগুলোর নতুন এই ভারতপন্থি বৃহত্তর জোট-এর ‘সিএসও অ্যালায়েন্স’ গঠন করা হয়েছে। এই জোটের কার্যক্রমের সমন্বয় করতে সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে ব্র্যাক। প্রাথমিকভাবে দুই বছর ব্র্যাক এই জোটের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে।
এই অ্যালায়েন্সের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষ্যে গত ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি ভার্চুয়াল সভা। ভার্চুয়াল সভায় নবগঠিত এই জোটের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়।
দেশের জাতীয় নির্বাচন গুলোতে বরাবরই এনজিও গুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে সরাসরি ভুমিকা পালন করে থাকে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রশিকা, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিও সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে মাঠে নেমেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনের নামে শেখ হাসিনার জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচিতেও সমর্থন দিয়েছিল এনজিও গুলো। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করা অনেকগুলো এনজিও প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্ত তখন জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসে চার দলীয় জোট সরকার। ২০০৪ সালে এনজিও গুলোর সহযোগিতায় চার দলীয় জোট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম জলিল ৩০ এপ্রিল সরকার পতনের ট্রম্পকার্ড ঘোষণা করেছিলেন। বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এই ট্রাম্পকার্ডের নেপথ্যে ছিল এনজিওদের ষড়যন্ত্র। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর গ্রামীণ ব্যাংকের ড. মুহাম্মদ ইউনূসে সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে এনজিওগুলোর ওপর চড়াও হয় ফ্যাসিবাদি সরকার। ফলে গত এক দশকে বেশ কোনঠাসা অবস্থায় ছিলো এনজিওগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সাথে চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যেক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার খবর চাউর হওয়ার পর দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে আওয়ামী লীগের পরম বন্ধু ভারতের। ফলে বাংলাদেশে নিজেদের অনুগত এনজিওদের মাঠে নামিয়েছে ভারত। এসব এনজিওকে আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। মূলত ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে তাদের পক্ষে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে এনজিও এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সুশীলরা কাজ করবেন। আর ভারতের এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্র্যাক।
উল্লেখ্য, ব্র্যাক এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ফজলে হাসান আবেদ এর মৃত্যুর পর এনজিওটিতে সরাসরি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করা শুরু করেছে।
এদিকে ভারতপন্থী সুশীলদের নেতৃত্বে এনজিওগুলোর ‘সিএসও অ্যালায়েন্স’ এর আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। সেদিন তিনি বলেন, ‘বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনগুলোর একটি বৃহত্তর জোট গঠন করা অত্যন্ত ইতিবাচক। এখন ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা দূরীকরণে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই জোটের বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা প্রয়োজন। তাহলে অ্যাডভোকেসি সফল হবে।’
আওয়ামী ঘরানার অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদও এই ভার্চুয়াল সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে মেলবন্ধন গড়ে তোলা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও প্রগতিমুখী সমাজ গঠনে বেসরকারি সব সংস্থার জোটবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। সেবাদানকারী সংস্থাগুলো বাংলাদেশের একটি বড় শক্তি। এই শক্তি একযোগে কাজ করলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার মধ্য থেকে কতটা স্বাধীনভাবে সংস্থাগুলো কাজ করতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
এখানে আরো উল্লেখ্য, তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা সারাদেশের পাঁচ শতাধিক এনজিও এবং সিভিল সোসাইটি সংস্থার নেতৃবৃন্দকে এই প্লাটফর্মে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্লাটফর্মের মাধ্যমে ভারততের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করবেন তারা। আর এতে সরাসরি সহায়তা দেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষা-বিষয়ক জোট ক্যাম্পের চেয়ারপারসন ও মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের জরুরী আইনের সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। এতে বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত, সিপিডি-র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবীর, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বানু, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম (ইন্ডিয়াপন্থি ডেউলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের স্ত্রী), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করবী রাখসান, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, এনজিও ফোরামের সফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনসুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।
উল্লেখ্য, গত এক যুগের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ শাসন করছেন শেখ হাসিনা। গুম-খুন, বাকস্বাধীনতা হরণের মতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে শেখ হাসিনার এই ফ্যাসিবাদি সরকার। ১৯৯১ সালের পর থেকে এনজিও গুলো ভোটের অধিকার নিয়ে গ্রামে গ্রামে কাজ করলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে ভোটের নামে ডাকাতির বিষয়ে তারা নীরব। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দলীয় করণ, সরকারদলীয় সরকারির কর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষের অবস্থা দিশেহারা। ফ্যাসিবাদী শাসনের সাথে সংশ্লিষ্টদের লুটপাটে ব্যাংক গুলো দেউলিয়া হওয়া পথে। এই অবস্থায় সরকারকে টিকিয়ে রাখতেই ভারতের মদদে ভারতপন্থী এনজিওগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
প্রসঙ্গত: ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর সাবেক এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা বি রমন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশ গুলোতে র’-এর কার্যক্রম নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি রাখ ঢাক না রেখেই বলেছেন, কিভাবে ভারত নিজের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং এনজিওগুলোকে র’এর মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে।
সেই বইতে বি রমন লিখেছেন, র’ প্রতিষ্ঠা করার পর প্রথম মিশন তারা বাংলাদেশেই ঠিক করেছিলো। এবং যেহেতু প্রথম দিকে তাদের লোকবল এবং আনুসঙ্গিক ক্ষমতা কম ছিল, ফলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং এনজিওগুলোতে নিজেদের লোক নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদি এজেন্ডা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এসে এই ধরণের জোট গঠনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়, যে, বাংলাদেশে ভারত নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে কতটা শক্তি অর্জন করেছে।