Site icon The Bangladesh Chronicle

ফের ভাঙল জাতীয় পার্টি

ফের ভাঙল জাতীয় পার্টিসপ্তমবারের মতো ভাঙল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি (জাপা)। শনিবার রওশন এরশাদপন্থিদের সম্মেলনের মাধ্যমে এ ভাঙন দেখা দিয়েছে। যদিও জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার মতো রওশনপন্থিরা নিজেদের মূলধারা বলে দাবি করছেন। খণ্ডিত জাপার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে অশীতিপর রওশন বলেছেন, আদালতের রায় অনুযায়ী লাঙ্গল আমার।

শনিবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলনে রওশনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সম্মেলনে একমাত্র চমক ছিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপার উপস্থিতি। তিনি ছাড়া কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ থেকে পদ হারিয়ে অন্য নেতারা আগে থেকেই রওশনের সঙ্গে রয়েছেন। জাপার ১৩ এমপির কেউই রওশনের সম্মেলনে আসেননি।

কাউন্সিলে ছিলেন না রওশন এরশাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ, এস এম এম আলম, ইকবাল হোসেন রাজুসহ অনেকে। তারা আবার জি এম কাদেরের জাপায় ফিরতে যাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

সম্মেলনে ৯ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। বাকিদের নাম পরে ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়েছেন। রওশনের জাপায় নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছেন কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি জি এম কাদেরের জাপার কো-চেয়ারম্যান ছিলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সমালোচনা করে পদ হারান।

রওশনের জাপায় সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, তিনিও পক্ষ নিয়ে কো-চেয়ারম্যান পদ হারান। এ ছাড়া কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম, রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার মিলন ও সুনীল শুভ রায়। জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে বলে শফিকুল ইসলাম এবং সুনীল শুভ রায়ও দলের সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েন। আগেই বাদ পড়েন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন।

রওশনপুত্র সাদ এরশাদ এখনও জি এম কাদেরের জাপার যুগ্ম মহাসচিব পদে রয়েছেন। রওশন নিজে রয়েছেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদে। অন্যদের অব্যাহতি দেওয়া হলেও রওশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

শনিবারের সম্মেলনে চেয়ারম্যান হিসেবে রওশনের নাম প্রস্তাব করেন জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। অন্য নেতাদের নামও তিনি প্রস্তাব করেন। মহাসচিব হিসেবে কাজী মামুনুর রশীদের নাম প্রস্তাব করেন গোলাম সারোয়ার মিলন। উপস্থিত কাউন্সিলর এবং ডেলিগেটরা এতে সমর্থন জানান।

সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির দাবি, আজ সারাদেশ থেকে ১২ হাজার কাউন্সিলর এবং ডেলিগেট এসেছিলেন। সম্মেলন উপলক্ষে মৎস্য ভবন মোড় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটক পর্যন্ত ছিল রওশনপন্থিদের শোডাউন। তারা এরশাদ এবং রওশনের ছবি-সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে আসেন। জি এম কাদেরের জাপার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ এবং উত্তরের সদ্য পদ হারানো দুই সভাপতি আবু হোসেন বাবলা এবং শফিকুল ইসলামের বিপুলসংখ্যক অনুসারী জমায়েত হন সড়কে। সম্মেলন ঘিরে ছিল পুলিশ ও র‍্যাবের নিরাপত্তা।

সম্মেলনে আমন্ত্রণ করা হলেও আওয়ামী লীগের কেউ আসেননি। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেপির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলামসহ কয়েকটি ছোট দলের নেতারা। ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের সহকারী রাষ্ট্রদূত ফেং জিজিয়া এবং কয়েকটি দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

গত ২৮ জানুয়ারি জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন। যদিও নির্বাচন কমিশন এ ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এরশাদের জীবদ্দশা থেকেই জাপায় দ্বন্দ্ব চলছে রওশন এরশাদ এবং জি এম কাদেরের। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর সরকারের সমর্থনে রওশন বিরোধী দলের নেতার পদে টিকে থাকলেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বদলে যায়। জাতীয় পার্টি ফের বিরোধী দল হবে, জি এম কাদের হবেন বিরোধী দলের নেতা– এই দুই শর্ত পূরণের আশ্বাসে ভোটে অংশ নেয় দলটি। সাদ এরশাদের রংপুর-৩ আসনে জি এম কাদের নিজেই নির্বাচন করায় ভোটে অংশ নেননি রওশন। আওয়ামী লীগের সাদের জন্য বিকল্প আসন ছাড়তে রাজি থাকলে, তিনি এ প্রস্তাবে সাড়া দেননি।

দ্বাদশ নির্বাচনে মাত্র ১১টি আসন পেয়েছে জাপা। ভোটের পর দলটিতে ফের অস্থিরতা শুরু হয়। লাঙ্গলের পরাজিত প্রার্থীরা সভা করে অভিযোগ তোলেন, জি এম কদের ভোটে গিয়ে টাকা পেলেও অন্যদের দেননি। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় না পাওয়া, ছাড় পেয়েও হেরে যাওয়া নেতারা চেয়ারম্যানের সমালোচনায় মুখর হন। তাদের একটি অংশ যোগ দিয়েছেন রওশনের সঙ্গে। আবার কয়েকজন ফিরে গেছেন জি এম কাদেরের জাপায়।

তাঁর নেতৃত্বাধীন অংশই আসল জাপা দাবি করে রওশন বলেন, সম্মেলন না হলে দল হারিয়ে যেত। দেশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিত। সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জাতীয় পার্টি টিকে আছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর লাঙ্গল প্রতীক ধরে রাখতে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই সময় এরশাদ ও আমাকে লাঙ্গল প্রতীক দিয়েছিলেন। এখনও তা জাতীয় পার্টির আছে, আগামীতেও থাকবে। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে বিভেদ নেই। অতীতে যারা পার্টি ছেড়ে গেছেন, তারা কেউ এরশাদের নীতি-আদর্শ নিয়ে যাননি। তাই জাতীয় পার্টি ভেঙেছে বলে মনে করি না।

চাচা জি এম কাদেরের সমালোচনা করে সাদ এরশাদ বলেন, আব্বুর মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি থেকে পল্লীবন্ধুর নাম প্রায় মুছে ফেলা হয়েছিল। তবে তা করার শক্তি কারও নেই। এরশাদের আদর্শের অনুসারীরাই আসল জাতীয় পার্টি।

এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ছাড়াও দলটি ভেঙে জন্ম নেওয়া জেপি, বিজেপি এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নামে তিনটি নিবন্ধিত দল রয়েছে। জাতীয় পার্টি (জাফর) নামে আরেকটি অনিবন্ধিত দল সক্রিয় রয়েছে। অতীতে সক্রিয় ছিল জাতীয় পার্টি (জা-মো) এবং জাতীয় পার্টি (না-ফি) নামের দুটি অংশ।

সম্মেলনের প্রতিক্রিয়ায় মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ব্র্যাকেটবন্দি আরও ১০ জাতীয় পার্টি হলেও কিছু যায় আসে না। জি এম কাদের জাপার একমাত্র নেতা, লাঙ্গলও তাঁর।

সমকাল

Exit mobile version